ভগিনী নিবেদিতা প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা
কর্মে, কীর্তিতে, প্রতিভায় সমুজ্জ্বল সেসব মহীয়সীরা, তাঁরা মৃত্যুঞ্জয়ী। তাঁরা মৃত্যুর পরেও মানুষের মনে অমর হয়ে থাকেন শ্রদ্ধা ও সন্মানের আসনে। এমনই একজন মহীয়সী নারী ছিলেন ভগিনী নিবেদিতা।
ভগিনী নিবেদিতার জন্ম ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে অক্টোবর আয়ারল্যান্ডের ডাঙ্গনন শহরে। তাঁর বাবার নাম স্যামুয়েল রিচমন্ড ও মায়ের নাম মেরী ইমাবেল হ্যামিলটন। তাঁর বাবা ছিলেন ধর্মযাজক। তিনি আয়ারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধে যোগও দিয়েছিলেন। স্যামুয়েল রিচমন্ডের পিতামহ জন নোেবল। নিবেদিতার শৈশব কাটে ধর্মীয় পরিবেশে। তাই তাঁর মধ্যেও ছিল প্রবল ধর্মীয় ভাব।
স্বামী বিবেকানন্দ ও নিবেদিতা
১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ইংল্যান্ডের এক সভায় স্বামী বিবেকানন্দের সাথে প্রথম তাঁর পরিচয় হয়। তারপর পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষা, যশ কীর্তিতে প্রতিষ্ঠা আয়ারল্যান্ডের কন্যা মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল বা নিবেদিতার ভারতে জন্মান্তর ঘটেছিল। স্বামী বিবেকানন্দের নির্দেশিত পথে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন ভারতের কল্যাণে। নিবেদিতার জীবন ‘ভারতের মাটিতে তিলে তিলে আত্মনিবেদনের দিব্য গাথা’। স্বামী বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে দীক্ষা দেন ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে। বিবেকানন্দের ধারণা সত্য-‘সেই স্ফুলিঙ্গ যে নিজে জ্বলে উঠে সকলের প্রাণে আগুন ধরাবে।’
তাঁর কর্মপরিধি ভারতের শীর্ষস্থানীয় মনীষীদের আকর্ষণ করেছিল। তিনি ছিলেন ভারতের প্রকৃত হিতৈষিণী। তাই এখানের সকল মনিষীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাঁরা বিস্মিত হয়েছিলেন নিবেদিতার গভীর মননশক্তি, কর্মতৎপরতা ও দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা দেখে। ভারতবাসী তাঁকে দেখেছেন প্রেমময়ী শিক্ষিকারূপে, কল্যাণী নারীরূপে, করুণাময়ী জননীরূপে, সেবাপরায়ণা ভগিনীরূপে, আবার অগ্নিকন্যা বিপ্লবীরূপে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘লোকমাতা’ নামে অভিহিত করার প্রসঙ্গে বলেছেন,’ ভগিনী নিবেদিতা একান্ত ভালোবাসিয়া সম্পূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে আপনাকে ভারতবর্ষে দান করিয়াছেন, তিনি কিছুমাত্র হাতে রাখেন নাই।’ নিজের তপস্যায়, আত্মনিবেদনে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে তিনি ভারতবাসীর কাছে সিস্টার বা ভগিনী, লোকমাতা নামে পরিচিত।
তখনকার দিনে ছাত্রসমাজের উদ্দেশ্যে নিবেদিতা যা বলেছিলেন, ‘তোমাদের লক্ষ্য হোক মাতৃভূমির কল্যাণ। মনে রেখো অখন্ড ভারতই তোমার দেশ এবং এই দেশের বর্তমান প্রয়োজন কর্ম।………… আর যখন সংগ্রামের আহ্বান আসবে, তখন যেন তোমরা নিদ্রায় মগ্ন থেকো না।’ সত্যরূপিনী, চিৎরূপিনী নিবেদিতা বাংলায় জ্বেলেছিলেন বিপ্লবের আগুন। স্বামী বিবেকানন্দের কাছে দীক্ষা গ্রহণের পর তাঁর নাম হয় নিবেদিতা। যে বছর স্বামী বিবেকানন্দ তাঁকে দীক্ষা দিলেন সেই বছর প্লেগ মড়করূপে দেখা দেয়। নিবেদিতা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু স্বেচ্ছাসেবী যুবকদের সাথে অসুস্থ অসহায় মানুষের সেবায় এগিয়ে এলেন। এই বছর কলকাতার বোসপাড়া লেনে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন যা পরবর্তীকালে নিবেদিতা গার্লস হাইস্কুল নামে খ্যাত হয়। তিনি ঋষি অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু প্রভৃতি মনীষীদের সান্নিদ্ধলাভ করেন। তিনি ছিলেন ভারতের সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞানের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক।
উপসংহার
ভগিনী নিবেদতা ছিলেন ভারতের ‘বলিষ্ঠ ভাবনা।’ তিনি ভারতীয় নারীদের নতুন করে মূল্যায়ন করেছিলেন। দেশকে ভালোবেসে দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে নারীজাতির কাছে ছিলেন আর্দশ জীবনের দিশারী। সারা ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে থাকায় তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। তিনি বিশ্রাম লাভের জন্য বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রী অবলা বসুর আমন্ত্রণে দার্জিলিং শহরে রায় ভিলায় যান। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই অক্টোবর সেখানে তাঁর দেহাবসান হয়। তিনি বলেছেন, ‘যেসব আচার-বিচারে মানুষে ভেদ ঘটে ধর্ম তার মধ্যে নেই। সেই ধর্মই ধর্ম, যাতে জাতির প্রাণশক্তি জেগে ওঠে।’ তাঁর আদর্শ দেশবাসীর প্রাণে যুগিয়েছে প্রেরণা, জাতির সংহতি, অগ্রগতি, সৌভ্রাত্ববোধ। ভগিনী নিবেদিতা তাই আজও মানুষের মনে অমর হয়ে আছেন এবং চিরকাল থাকবেন অক্ষয় হয়ে তাঁর কর্ম, জীবনাদর্শ ও দেশপ্রেমের নির্দশন হিসাবে।
আরও পড়ুন – রাজা রামমোহন রায় প্রবন্ধ রচনা