যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা
ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে সংস্কারপন্থী ও সংস্কার বিরোধীদের মধ্যে মানসিক সংঘাত বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ, শিক্ষিত সমাজ পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে অস্বীকার করতে পারছিলেন না। তবে শিক্ষিত সমাজের মোহ ভঙ্গ হতে বেশী সময় লাগল না। তাঁরা বুঝতে পারলেন যে বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে সমর্থন করা মানে এই নয় যে তাঁদের তাবেদার হওয়া। অনেক সময় সংস্কার বিরোধীদের ওপর সংস্কার পন্থীরা তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারল না। যার ফলে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিচারের বাণী মাথা কূটতে বাধ্য হয়েছে যে সে কথাও ভুল নয়। শীঘ্র কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাতির অন্ধ মানসিকতার প্রাচীর ভেঙে পড়ল পাশ্চাত্য আঘাতে। বাঙালির চিন্তায় মনিষায় এলো অভূতপূর্ব পরিবর্তন। ঘটে গেল রেনেসাঁস বা নবজাগরণ।
কিন্তু জ্ঞানের শুষ্ক-বালুকারাশিতে বাঙালির হৃদয় তৃপ্তি পেল না। তার তৃষিত হৃদয় এমন এক মহামানবের আর্বিভাবের প্রতীক্ষা করছিল, যিনি ভাবের বন্যায় বাঙালীর মনোভূমিকে সরস-শ্যামল করে তুলবেন, যিনি বহু মতেরও বহু পথের সমন্বয় সাধন করে ধর্মের গন্ডীকে প্রসারিত করে দেবেন মানবতার অসীম ক্ষেত্রে। তিনি হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ বা গদাধর।
বাল্যকাল
তাঁর জন্ম হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে ১৮৩৬ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি। পিতার নাম ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় ও মায়ের নাম চন্দ্রমনি দেবী। বাল্যকালে তাঁর ডাক নাম ছিল গদাধর। তিনি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন পাঁচ বছর বয়সে। স্কুলের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থেকে পড়াশোনায় তাঁর মন বসত না। তিনি গান গাইতে ও অভিনয় করতে ভালোবাসতেন। তীক্ষ্ণ ধী-শক্তি ও অসাধারণ অনুভব-ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। শৈশবের কেতাবী তাঁর মনকে পাঠশালায় অটকে রাখতে পারল না, অনন্ত বিশ্বপ্রকৃতি হলো তাঁর শিক্ষানিকেতন। মূর্তি-গড়া, কথকতা প্রভৃতির প্রতি তাঁর ছিল অস্বাভাবিক ঝোঁক, ভাবতন্ময়তা ছিল তাঁর আবাল্য-প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত, রামায়ন মহাভারত, পুরাণ এবং ধর্মগ্রন্থের প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ। শৈশব থেকে তাঁর মধ্যে দেখা গেছল দৈবী ভাব।
সাধু-সঙ্গ
কামারপুরের মধ্য দিয়ে ছিল পুরী যাওয়ার হাঁটা পথ। পুরী যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে সন্ন্যাসীরা কামারপুকুরে বিশ্রামের জন্য অবস্থান করতেন। বাল্যকালে সেইসব সন্ন্যাসীদের সান্নিধ্য লাভ করেন গদাধর এবং তাঁর মনের সুপ্ত ধর্ম-ভাবনা অঙ্গুরিত হতে থাকে যা পরবর্তীকালে মহীরুহে পরিণত হয়।
কলকাতায় আগমন
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ শে মে স্নান যাত্রার দিন গদাধর তাঁর দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সাথে কলকাতার জানবাজারের রানি রাসমণির দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন প্রথম আসেন। তাঁর দাদা মারা গেলে গদাধরের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় ভবতারিণীর পুজোর। যিনি বিশ্বের অসহায়-আতুরের জন্য মুক্তির বানী বহন করে নিয়ে এসেছেন তাঁকে পাঠশালার শিক্ষানিকেতন বেঁধে রাখতে পারে না। তাই হল, কলকাতার দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিনীর মন্দির হল তাঁর সাধন-ধাম।
ভবতারিণীর মন্দিরের পূজারী
পূজো-অর্চনা, স্তব পাঠ প্রভৃতিতে গদাধরের মধ্যে দেখা দিল ভাব-তন্ময়তা। গদাধরের মন তথাকথিত পূজো-অর্চনার প্রতি আকৃষ্ট হল না। যে পূজোয় অন্তরের সহজ স্বতস্ফূর্ত ব্যাকুলতা নেই, যে শাস্ত্রীয় বিধিতে অন্তরের স্পর্শ নেই তাকে তিনি সমর্থন করলেন না। তিনি মনে বললেন, মন্ত্রহীন ও শাস্ত্রীয় ক্রিয়াহীন হয়েও সহজ-সরলভাবে অন্তর দিয়ে ডাকলে ঈশ্বরের দর্শন পাওয়া যাবে। তিনি ভবতারিনীর বেশকারীর পদে নিযুক্ত হলেন। তিনি ভাবতন্ময় হয়ে দেখলেন পাষাণ মূর্তির মধ্যে ভবতারিণীর জাগ্রত রূপ। তিনি মৃন্ময়ী নয়-চিন্ময়ী। তিনি গভীর রাতে পঞ্চবটী বনের নির্জনতায় হতেন ধ্যানমগ্ন। তিনি শাস্ত্রীয় পুজো-রীতি ত্যাগ করে ভক্তি ব্যাকুল কন্ঠে স্তবপাঠ করতেন, নৈবেদ্য অন্ন তুলে ধরতেন বিগ্রহের মুখের কাছে। মাতৃধ্যানে হতেন তন্ময়। তিনি সর্বভূতে প্রত্যক্ষ করতেন বিশ্বনিয়ন্ত্রী জগতজননীর অপূর্বরূপ।
বিবাহ
জয়রামবাটীর সারদামণির সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। কিন্তু তিনি তাঁকে মাতৃজ্ঞানে দেখতে লাগলেন। তিনি আবার ফিরে এলেন দক্ষিণেশ্বরে। তাঁর পূণ্য-স্পর্শে দক্ষিণেশ্বর পরিণত হল তীর্থক্ষেত্রে। একসময় এক ভৈরবী-সন্ন্যাসিনী তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে ভক্তি-সাধন মার্গের তাঁকে দিলেন পথ-নির্দেশ। এরপরে এলেন সাধক তোতাপুরী, বৈদান্তিক সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে প্রায় চল্লিশ বছর সময় লেগেছিল-গদাধরের লাগল এক দিন। সকলে তাঁর মধ্যে প্রত্যক্ষ করলেন অবতারের সার্বিক রূপ ও লক্ষণ এবং ঘোষণা করলেন-নরদেহরূপী অবতার তিনি। গদাধর হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর শিষ্য
শ্রীরামকৃষ্ণের অষ্টসিদ্ধিলাভ ও অবতার-লক্ষণের কথা প্রচারিত হলে অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি এলেন দক্ষিণেশ্বরে তাঁর সান্নিধ্যলাভের জন্য। তিনি বললেন-‘যত মত তত পথ’। সমস্ত নদী যেমন শেষপর্যন্ত সাগরে মিশে যায় তেমনি ধর্মের সব পথই পৌঁছায় ঈশ্বরের পদতলে। পথহারা মানুষ পেল খুঁজে আলোকের পথ, মুক্তির ঠিকানা। তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হল সিমলার দত্ত পরিবারের নরেন্দ্রনাথের সাথে। তাঁর পরশমনির স্পর্শে নরেন্দ্রনাথ হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দ সারা বিশ্বে বহন করে নিয়ে গেলেন শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী এবং মূর্ত করে তুললেন শিব-জ্ঞানে জীব সেবার গুরুর নির্দেশকে। শ্রীরামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণ ঘটে ১৮৮৬ সালের ১৬ই আগষ্ট।
উপসংহার
শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তি-সাধনার, ভাব-সাধনার, জীবন-সাধনার এক মূর্ত প্রতীক। খ্রীস্টধর্মের প্রবল বন্যায় যখন সনাতন হিন্দুধর্ম তলিয়ে যাচ্ছিল গভীর অন্ধকারে তখন শ্রীরামকৃষ্ণ দেখালেন সেবার পথ, মুক্তির পথ। শুরু হল নবজাগরণের।
আরও পড়ুন – রাজা রামমোহন রায় প্রবন্ধ রচনা