ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবগুলি সংক্ষেপে লেখো
ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবসমূহ: ষোড়শ শতকে ইউরোপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ফলাফলগুলি হল নিম্নরূপ-
(1) সামাজিক অস্থিরতা: আলোচ্য পর্বে ইনকুইজিশন আদালতের বিধানে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যার বিষয়টি সমাজে এক গভীর আতঙ্ক ও ঘৃণার পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ ছাড়া জার্মানির ধর্মযুদ্ধ এবং ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ সমগ্র ইউরোপেই এক জটিল সামাজিক পরিস্থিতির জন্ম দেয়, যার ফলস্বরূপ, ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টপন্থীরা পরস্পরের শত্রুতে পরিণত হয়।
(2) প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠানের সংস্কার: মধ্যযুগের ইউরোপে চার্চ ও যাজকই মানুষের জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ করতেন। জন্ম, মৃত্যু বা বিবাহের অনুষ্ঠানও তাঁরাই পরিচালনা করতেন। কিন্তু রিফরমেশনের ফলে এই গণ আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসবের পরিবর্তন ঘটে। ইন্দ্রজাল, ষাঁড়ের লড়াই, সন্তদিবস পালন, মদ্যপান ইত্যাদি গণসংস্কৃতির চিরাচরিত দিকগুলিকে ধর্মসংস্কারের যুগের রাষ্ট্র বা ধর্মসংস্কারক কেউ সমর্থন করেননি। প্রোটেস্ট্যান্ট অধ্যুষিত রাজ্যগুলিতে মে গেম, কক ফাইটিং ইত্যাদি নিষিদ্ধ হয়।
(3) স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার প্রসার: ধর্মসংস্কার আন্দোলন গতানুগতিক পোপ ও রোমান চার্চকেন্দ্রিক ধর্মীয় চিন্তার বদল ঘটিয়ে স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার পথ প্রশস্ত করেছিল। ধর্মসংস্কার আন্দোলন ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং চার্চ পরিচালনার ক্ষেত্রে অযাজকদের ভূমিকা এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরে। ফ্রান্সিস বেকন, লক, হবস প্রমুখ বিশিষ্ট দার্শনিকদের যুক্তিবাদী চিন্তাধারা এসময় মানুষকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল।
(4) শিক্ষাবিস্তার: ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূত্র ধরে শিক্ষার বিস্তার ঘটে। প্রোটেস্ট্যান্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে মানবতাবাদী শিক্ষাদান করা হত। প্রোটেস্ট্যান্টরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বজনীন শিক্ষার কথা বলেছিলেন। মার্টিন লুথার ও মেলাংকথন (Philip Melanchthon)-এর উদ্যোগে জার্মানির উইটেনবার্গে চিকিৎসাবিদ্যা শেখানো হত। জেনেভা অ্যাকাডেমি (Geneva Academy) গঠন করে ক্যালভিন শিক্ষক শিখনের উদ্যোগ নেন। জেসুইট সম্প্রদায়ের মাধ্যমে ইউরোপ ও বহির্বিশ্বে শিক্ষার বিকাশ ঘটে। ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন ইউরোপে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রসারে সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
(5) ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ: রিফরমেশনের সময়কালে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় পবিত্র বাইবেল অনূদিত হতে থাকে। পিটার বার্ক (Peter Burke)-এর মতে মাতৃভাষায় বাইবেলের অনুবাদ ইউরোপের ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। জন ওয়াইক্লিফ, লুথার, ইরাসমাস প্রমুখ বাইবেলের অনুবাদ কার্যে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এসবের ফলে আঞ্চলিক ভাষার উন্নতি ঘটে এবং ধর্ম সম্পর্কে মানুষের স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠে।আলোচ্য পর্বে রচিত হয় ধর্মের ইতিহাস, যেমন- ক্যাথলিকদের অ্যানালস এক্লিজিয়াসটিসি (Annales Ecclesiastici), প্রোটেস্ট্যান্টদের ম্যাগডেবার্গ সেঞ্চুরিস (Magdeburg Centuries) ইত্যাদি।
(6) শিল্পকলার উপর প্রভাব: ইউরোপীয় রিফরমেশন শিল্প ও সংগীতকে উৎসাহদান করে। ধর্মপ্রচারকগণ ছিলেন শিল্প ও সংগীতের অনুরাগী। যদিও সুইটজারল্যান্ডে শিল্প-সংগীত-ভাস্কর্য বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেনি। আলোচ্য পর্বে কার্নিভাল বন্ধ হয়ে যায় এবং উন্মেষ ঘটে বারোক শৈলীর। রোম ছিল এই জাতীয় শিল্পচর্চার পৃষ্ঠপোষক।
মূল্যায়ন
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, ইউরোপের – ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যযুগে উদ্ভূত যাবতীয় আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। ইতিহাসবিদ মীনাক্ষি ফুকন লিখেছেন, “The Reformation did not inaugurate the modern age but rather terminated the middle Ages.”
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর