ইংল্যান্ডের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণগুলি কী কী ছিল
ষোড়শ শতকে ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কার আন্দোলন কিছুটা স্বতন্ত্র ধারায় সংঘটিত হয়েছিল। সম্রাট অষ্টম হেনরির উদ্যোগে এই ধর্মসংস্কার একটা পরিণত রূপ পায়। মানবতাবাদী সংস্কারকের পরিবর্তে সম্রাটের নেতৃত্বে এবং পার্লামেন্টের উদ্যোগে ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কার সম্পাদিত হয়েছিল বলে ঐতিহাসিক জি এলটন (G Elton) একে ‘An Act of the State’ বলে অভিহিত করেছেন।
ইংল্যান্ডের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণসমূহ
(1) ক্যাথলিক চার্চ ও পোপবিরোধী মানসিকতা: পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক থেকে ক্যাথলিক চার্চ ও পোপবিরোধী মানসিকতা ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। জার্মানিতে লুথারের নেতৃত্বে পোপতন্ত্রের অসার আধ্যাত্মিক দাবি, মার্জনাপত্র বিক্রি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয় তার ঢেউ এসে লাগে ইংল্যান্ডেও।
(2) চার্চের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিবাদ: আলোচ্য পর্বে ইংল্যান্ডের চার্চগুলি যেমন অনেক বিশেষ অধিকার ভোগ করত, তেমনই চার্চের যাজকেরাও সেদেশের রাজার সঙ্গে সঙ্গে পোপের প্রতিও দেখাত দ্বৈত আনুগত্য। কাজেই পোপের কর্তৃত্ব মুক্ত হওয়ার মানসিকতা থেকেই রাজশক্তি ধর্মসংস্কারের পথ বেছে নেয়।
(3) চার্চগুলির প্রভূত সম্পত্তি ও অধঃপতন: পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক নাগাদ ইংল্যান্ডের মোট কৃষিজমির ৩৩% ছিল চার্চের দখলে। এর পাশাপাশি ইংল্যান্ডের চার্চ জনগণের থেকে বিভিন্ন কর, যেমন- Probate fees, Mortuary fees আদায় করত। ফলে দেশের জনগণ একদিকে যেমন চার্চগুলির প্রতি শ্রদ্ধা হারাচ্ছিলেন পাশাপাশি তারা মনে করতেন যে, চার্চ কর্তৃক পুঞ্জীভূত বিপুল ভূসম্পত্তি পেলে তারা এর সদ্ব্যবহার করতে পারবেন।
(4) রাজা অস্টম হেনরির বিবাহবিচ্ছেদ জনিত সমস্যা: ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি প্রথম দিকে ধর্মসংস্কারের বিরোধী ছিলেন। এমনকি ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে লুথারের সমালোচনা করে একটি পুস্তিকাও রচনা করেছিলেন তিনি। প্রধানত এর পুরস্কারস্বরূপ পোপ দশম লিও (Pope Leo X) তাঁকে ‘Defensor fidei’ বা ধর্মরক্ষক উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদকে কেন্দ্র করে পোপের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। অষ্টম হেনরির সঙ্গে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আর্থার-এর বিধবা পত্নী ক্যাথরিন (Catherine of Aragon)-এর বিবাহ হয়েছিল। কিন্তু ক্যাথরিন ও হেনরির কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। ফলে অষ্টম হেনরি পুত্রসন্তান লাভের আশায় তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিনকে বিচ্ছেদ (Divorce) দিয়ে জনৈকা অ্যান বোলিনকে (Anne Boleyn) বিয়ে করতে ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু রাজার বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহের জন্য সেকালে রোমান পোপের অনুমোদন গ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল। আর ঘটনাক্রমে অষ্টম হেনরির স্ত্রী ক্যাথরিন ছিলেন স্পেনের শাসক তথা পবিত্র রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লস-এর পিসিমা। এ ছাড়া ব্যক্তিগত জীবনে সম্রাট পঞ্চম চার্লস ছিলেন একজন গোঁড়া ক্যাথলিক এবং তৎকালীন পোপ সপ্তম ক্লিমেন্ট (Pope Clement VII) তাঁর খুব অনুগতও ছিলেন। এই কারণে এবং সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পোপ বিবাহবিচ্ছেদের অনুমোদন দিতে বিলম্ব করতে থাকেন। এমতাবস্থায় ক্ষুব্ধ অষ্টম হেনরি রোমান চার্চের অধীনতা থেকে ইংল্যান্ডের চার্চকে বিচ্ছিন্ন করে, অ্যাংলিকান চার্চের পোপের কাছ থেকে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমোদন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ধর্মসংস্কারে উদ্যোগী হন। এজন্য এটিকে The king’s Great Matter বলা হয়।
(5) বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা: ইংল্যান্ডের ধর্মসংস্কারের পশ্চাৎপটে বুদ্ধিজীবীদের প্রগতিশীল চিন্তাধারা অনেকাংশে দায়ী ছিল। জন কোলেট (John Collett), টমাস লিনাক্রে (Thomas Linacre) একদিকে যেমন চার্চ সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তেমনই লিটল জার্মানি (Little Germany) নামে পরিচিত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুথারপন্থী প্রোটেস্ট্যান্ট গোষ্ঠী হোয়াইট হর্স ট্যাভার্নে (White Horse Tavern) মিলিত হয়ে মূর্তিপুজো ও পাপ স্বীকারের বিরোধিতা করেন। উইলিয়ম টিন্ডেল ইংরেজিতে বাইবেল অনুবাদ করে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনকে জনমানসে ছড়িয়ে দেন।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর