মৌলানা আবুল কালাম আজাদ অঙ্কিত রাজনৈতিক স্বাধীনতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দাও
রাজনৈতিক স্বাধীনতা
মৌলানার স্বাধীনতা সংক্রান্ত ধারণার প্রধান আলোচ্য বিষয়ই হল রাজনৈতিক স্বাধীনতার ধারণা। খুব অল্প বয়সে মৌলানা আজাদ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে ভারতকে স্বাধীন করার প্রচেষ্টায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন এবং জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেছিলেন। ভারতকে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন করার পশ্চাতে তাঁর মূল অবদান হল-
- জাতীয় কংগ্রেসে ভূমিকা পালন: মৌলানা আনুমানিক ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে খিলাফৎ আন্দোলনের সূত্রে কংগ্রেস দলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে কংগ্রেস দলের সর্বকনিষ্ট সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি কংগ্রেসের মঞ্চকে ব্যবহার করেই স্বরাজবাদী ও খিলাফৎ নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এমনকি কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্বপালন করেছিলেন।
- জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন আন্দোলনে যোগদান:
- ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘খলিফা’র মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যে খিলাফৎ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাতে আজাদ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এই সময় গান্ধিজি তাঁর অসহযোগ আন্দোলনকে ব্যাপক রূপদান করার উদ্দেশ্যে খিলাফৎ আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেন।
- ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি ডান্ডি অভিযানের মাধ্যমে লবণ সত্যাগ্রহের সূচনা করলে, মৌলানা আজাদ সেই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং তাঁর আহবানে বেশ কিছু মুসলিম সংগঠন আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেয়। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে কারারুদ্ধ করে,
- ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ৮ আগস্ট বোম্বাইতে সারা ভারত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি-র ঐতিহাসিক অধিবেশনে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে তিনি দেশের জনগণকে সর্বাত্মক সংগ্রামে প্রস্তুত হওয়ার আহবান জানান।
- দেশভাগের বিরোধিতা: মুসলিম লিগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে লাহোর অধিবেশনে দ্বিজাতি তত্ত্ব (Two Nation Theory)- – এর মাধ্যমে অখন্ড ভারতবর্ষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে আজাদ কঠোরভাবে জিন্নাহ-র দ্বিজাতি তত্ত্ব ও দেশভাগের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত বিভাজন উভয়পক্ষের মানুষদের জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে।
- স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের আহবান: মৌলানা আজাদ তুর্কি বিপ্লবীদের সংস্পর্শে এসে বুঝতে পেরেছিলেন, ভারতীয় মুসলমানদের উচিত দেশব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদের নিযুক্ত করা। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি মুসলমান সম্প্রদায়কে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করার আহবান জানান।
- হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির সেতুবন্ধন: পরাধীন ভারতে স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে মৌলানা আজাদ হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির সেতুবন্ধনের গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ভারতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে হিন্দু-মুসলিমদের এক জাতি হয়ে লড়াই করতে হবে। তবেই ভারত স্বাধীন হবে।
- রাজনৈতিক স্বাধীনতায় নিবেদিত প্রাণ: ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইকে আজাদ পবিত্র লড়াই বলে মনে করতেন। এন্ডমন্ড বার্ক-এর মতো তিনি বিশ্বাস করতেন যে, স্বাধীনতা এক স্বাভাবিক বিষয়, ঈশ্বর প্রদত্ত উপহার। কোনো দেশ যত মহানুভবই হোক-না-কেন তার অধিকার নেই অন্যকে পরাধীন করে রাখার। দাসত্ব হল ঈশ্বরের ইচ্ছাবিরুদ্ধ এক বস্তু। ফলে বিদেশি শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার লড়াই হল তাঁর কাছে নৈতিক কর্তব্য।
- গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা: মৌলানা আজাদ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা কেবল বিদেশি শাসনের অবসান ঘটায় না, বরং এটি ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষার পথটিকে সুনিশ্চিত করে।
- কারাবাস এবং আত্মত্যাগ: স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের কারণে আজাদ বহুবার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে বন্দি হন। কিন্তু তাতেও তাঁকে ব্রিটিশ সরকার দমিয়ে রাখতে পারেনি। কারাগার থেকেই তিনি তাঁর লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করতে থাকেন। স্বাধীন ভারত গঠনের জন্যই দেশের প্রতি তিনি তাঁর তারুণ্য যৌবন কালকে উৎসর্গ করেছিলেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় জাতীয় মুক্তির বৃহত্তর উদ্দেশ্যে, তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়ে ভারতের স্বাধীনতাকে ব্রিটিশদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। তাঁর অসাধারণ বাগ্মীতা এবং ভারতীয় জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে তুলে ধরার ক্ষমতার জন্য ভারতের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিনি সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হন, যেখানে তিনি ভারতের স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর