দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা
দেশ পরাধীন। ভারতের ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের কালোরাত। ব্রিটিশের শাসন ও শোষণে দেশের মানুষ উদভ্রান্ত। পরাক্রমশালী ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে চাই উপযুক্ত নেতৃত্ব। দেশ মায়ের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে সে সময় যাঁরা এগিয়ে এসে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন নিজের জীবন বাজী রেখে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের জন্ম ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে অক্টোবর (১২৮৮ সালের ৯ই কার্তিক) পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথির চন্ডীভেটি গ্রামে এক জমিদার পরিবারে। পিতার নাম বিশ্বম্ভর শাসমল ও মাতার নাম আনন্দময়ী দেবী। তাঁর পরিবারে ছিল ব্রাহ্মধর্মের প্রভাব। তাঁর বাড়িতে মেদিনীপুর জেলার প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয় এবং ব্রাহ্মধর্মের প্রভাব থাকায় জাতিভেদ প্রথায় তাঁর পরিবারের বিশ্বাস ছিল না। বীরেন্দ্রনাথ জন্মেই দেখেছেন ব্রিটিশ শোষিত, লুণ্ঠিত ভারতবর্ষকে।
শিক্ষাজীবন
বীরেন্দ্রনাথ ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে কাঁথির উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রাস পরীক্ষায় পাশ করে এফ. এ. পড়ার জন্য কলকাতার মেট্রোপলিটন কলেজে (বিদ্যাসাগর কলেজে) ভর্তি হন। পরে ভর্তি হন রিপন কলেজে (সুরেন্দ্রনাথ কলেজে) ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে। এই কলেজের অধ্যাপক রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সাহচর্যে এলে তাঁর মধ্যে দেশপ্রেমের উদ্রেক হয়। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আইনের লড়াইয়ে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য বিলেত গিয়ে ব্যারিষ্টারী পড়ে দেশে ফিরে এলেন।
স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বডলার্ট লর্ড কার্জন বাংলাকে দুভাগ করে দুটি প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা করলে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে তিনি মেদিনীপুরে তীব্র প্রতিরোধ ও আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি মহাত্মাগান্ধী প্রবর্তিত অহিংস নীতিতে বিশ্বাস করতেন। ইংরেজ সরকার দু’বার মেদিনীপুর জেলা বিভাজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু বীরেন্দ্রনাথের তীব্র প্রতিবাদে জেলাবিভাজনের বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার বাধ্য হয় জেলা বিভাজন বন্ধ করতে। তিনি জেলা বিভাজনের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখিয়ে যে পুস্তক রচনা করেন তা ‘মিডনাপুর পার্টিশন’ নামে খ্যাত।
১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার গ্রাম্য স্বায়ত্ত শাসন আইন বা ইউনিয়ন বোর্ড প্রচলনের জন্য আইন করলে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে এমন প্রতিবাদ শুরু করলেন যে সরকার হার মানতে বাধ্য হল, ২৩৫টি ইউনিয়ন বোর্ড উঠিয়ে নিল। এই আইন চালু হলে গ্রামের সাধারণ মানুষকে চৌকিদারী ট্যাক্স সাতগুণ পর্যন্ত বেশি দিতে হত। ক্ষুদিরাম বসু বন্দেমাতরম পত্রিকা বিলি করলে তিনি ধরা পড়েন। বীরেন্দ্রনাথ ক্ষুদিরামের পক্ষ সমর্থন করে কোর্টে প্রমাণ করেন যে তিনি নির্দোষ। প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস হত্যা মামলায় জড়িয়ে গেলে বা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার মামলায় অন্যতম আসামী মাস্টারদা সূর্য সেন, গণেশ ঘোষ, অম্বিকা ব্যানার্জী প্রভৃতির সমর্থনে কোর্টে আইনের লড়াই করে গভীর আইন-জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন।
তিনি অহিংস পন্থী হয়েও স্বাধীনতা আন্দোলনে কোন সহিংস পন্থীর বিরুদ্ধে কেস হলে বিনাপারিশ্রমিকে তাঁর হয়ে লড়াই করতেন। তিনি প্রথম ভারতীয় যিনি স্বাধীনতা আন্দোলন করবেন বলে আইন ব্যবসা ত্যাগ করেন। তখন তাঁর মাসিক আয় ছিল প্রায় দশ হাজার টাকা। তিনি মেদিনীপুর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়ে কাজের মাধ্যমে উন্নয়নের জোয়ার আনেন। তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনী সভার সভাপতি ও অনেকবার কাউন্সিলার নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক সমিতির সম্পাদক, ফরোয়ার্ড পত্রিকার ডিরেক্টর, একাধিকবার আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন দক্ষতা ও সততার মাধ্যমে।
বীরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বিশেষ করে মেদিনীপুর জেলায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এত শক্তিশালী ছিল যে ব্রিটিশ শক্তি শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং তিনি যাতে মেদিনীপুরে না যেতে পারেন তাই তাঁর বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা আইন প্রয়োগ করে। তিনি বিশ্বাস করতেন না ‘জাত’ নামক কুসংস্কারে। কৃষ্ণনগরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সম্মেলনের সভাপতি হিসাবে তিনি যে বক্তব্য রাখেন তা ‘কৃষ্ণনগর কনফারেন্স’ নামে রাষ্ট্রনীতির বিখ্যাত দলিল হিসাবে খ্যাতি লাভ করে। ইংল্যান্ডের যুবরাজের ভারতে আসার প্রতিবাদে রাষ্ট্রীয় সমিতির সম্পাদক হিসেবে বেশ কয়েকবার দেশবাসীকে হরতাল করার অনুরোধ করলে সংবাদপত্রে বীরেন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে এবং ছ’মাস কারাদন্ডে দণ্ডিত করে।
উপসংহার
সন্ন্যাস রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে নভেম্বর। তিনি লিখেছেন বিখ্যাত বই ‘স্রোতের তৃণ’। তিনি অন্যায় করাকে পাপ কাজ মনে করতেন এবং ইংরেজ সরকার ৬৪ হাজার টাকা বার্ষিক বেতনে মন্ত্রীর পদ দিতে চাইলেও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এই যুক্তি দেখিয়ে যে শোষক ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করা মানে তার কাছে মাথা নত করা।
তিনি মৃত্যুর আগে উইল করে গেছলেন যে, ‘জীবিতাবস্থায় যে শির আমি কাহারও নিকট অবনমিত করি নাই, মৃত্যুর পরেও যেন আমার সেই শির অবনমিত না করা হয়, আমাকে যেন উন্নত শিরে দাহ করা হয়।’ কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে মৃত্যুর পরে তাঁর মরদেহ উন্নত শিরে দাহ করা হয়। বীরেন্দ্রনাথ ছিলেন অহিংস পন্থী। তিনি কখনও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি এমন কি ব্রিটিশ শক্তির কাছেও। দেশবাসী তাঁকে ‘দেশপ্রাণ’ আখ্যা দিয়ে সম্মান জানায়।
আরও পড়ুন – মহাত্মা গান্ধী প্রবন্ধ রচনা