স্বামী বিবেকানন্দের রাষ্ট্রচিন্তার প্রকৃতি আলোচনা করো
স্বামী বিবেকানন্দের রাষ্ট্রচিন্তা
ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে, স্বামীজির আবির্ভাব। তিনি নিদ্রিত ভারতবাসীকে জেগে ওঠার আহবান জানান, যদিও তিনি প্রথাগত রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ছিলেন না। স্বামীজি নিজ চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং বক্তৃতার মাধ্যমে আদর্শ রাষ্ট্র প্রসঙ্গে নিজ বক্তব্য প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামীরা এগুলিকেই বিবেকানন্দ-এর রাষ্ট্রচিন্তা বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল-
- সমাজসংস্কার: সমাজসংস্কারের ধারণার মধ্য দিয়ে স্বামীজির রাষ্ট্রতত্ত্বের সন্ধান মেলে। তাঁর পূর্ববর্তী সমাজসংস্কারকগণ তথা রাজা রামমোহন রায় ও তাঁর অনুগামীদের প্রভাবে বঙ্গভূমি-সহ সারা ভারতবর্ষে নবজাগরণের প্রভাব দেখা দিয়েছিল। এই প্রেক্ষিতে স্বামীজিও স্থবির ভারতীয় সমাজের আমূল পরিবর্তনের ও সংস্কারের কথা ভাবতেন। এর ফলস্বরূপ, তিনি সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্বন্ধে তাঁর সুদৃঢ় মত ব্যক্ত করেছিলেন, যার ভিত্তি ছিল তাঁর রাষ্ট্রদর্শন।
- জাতীয় মুক্তি আন্দোলন: বিবেকানন্দ নিজে কোনোদিন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে সরাসরি যোগদান করেননি। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেছিলেন পরাধীন ভারতবাসীর স্বাধীনতা লাভ করা অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু বিবেকানন্দ- এর সমসাময়িক ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় কুসংস্কার, ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য, ধনী-দরিদ্রের মধ্যেকার পার্থক্য, জাতপাত ব্যবস্থা ভারতীয় সমাজকে পশ্চাত্পদ করে তুলেছিল। এজন্য তিনি ভারতবাসীকে জাগরিত করার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘ওঠো জাগো ভারতবাসী’। তিনি অনুভব করেছিলেন, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগরিত হয়নি। তাই, তিনি ভারতবাসীকে সমস্ত জড়তা, ক্লীবতা, দুর্বলতা ত্যাগ করে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
- জাতীয়তাবাদ: স্বামীজি ছিলেন একজন স্বদেশপ্রেমী, জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব। সনাতন ভারতের ঐতিহ্য, সভ্যতা, দর্শনকে তিনি তাঁর বক্তৃতার মাধ্যমে স্বদেশের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন। শুধু তাই নয়, পশ্চিমি সভ্যতার সম্মুখে সাবেকি ভারতীয় সভ্যতার স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন তিনি। জাতীয়তাবাদের প্রচলিত ধারণায় যেখানে স্বদেশপ্রেম ও তীব্র স্বাজাত্যবোধ সর্বাগ্রে স্থান পেয়েছিল, সেখানে স্বামীজির রাষ্ট্র ভাবনায় ভারতীয় সমাজের পুনর্গঠন ও আধুনিকীকরণ গুরুত্ব পেয়েছিল।
- যুক্তিবাদ: ভারতীয় দর্শনপাঠ ও পাশ্চাত্যের প্রভাব তাঁকে যুক্তিনিষ্ঠ করে তুলেছিল। তিনি ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেমন অযৌক্তিক ব্রাহ্মণ্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। তেমনই রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অযৌক্তিক ধারণা গ্রহণে রাজি ছিলেন না, তিনি ব্রাহ্মণ ও পুরোহিত শ্রেণির ধর্ম সম্পর্কিত ধারণাকে যুক্তির দ্বারা খণ্ডন করে ভ্রান্ত প্রমাণিত করেন। তিনি তাঁর এই যুক্তিনিষ্ঠ মনোভাবকেই রাজনীতিতে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁর রাষ্ট্রনীতিকে যুক্তিগ্রাহ্য রাষ্ট্রতত্ত্ব বলা যায়।
- ন্যায়নিষ্ঠ: স্বামীজি মূলত তাঁর বক্তব্যে সামাজিক ন্যায়ের ধারণাকেই তুলে ধরেছিলেন, যা তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে স্থান পেয়েছে। তিনি ভারতীয় সমাজের সমস্যাগুলিকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তার সমাধানসূত্র নির্দেশ করার চেষ্টা করেন। তিনি জাতব্যবস্থা, অস্পৃশ্যতার অশুভ দিকগুলি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করার ফলে এগুলির কঠোর সমালোচনা করেন।
- স্বাধীনতা, সাম্য ও অধিকার: স্বামীজি দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক দুটি দেশ আমেরিকা ও ব্রিটেনে অবস্থান করেছিলেন। ফলে পশ্চিমি স্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায় ও অধিকার সম্পর্কিত ধারণাগুলি সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত ছিলেন। ফলে ভারতীয়রা যে ব্রিটিশ শাসনাধীনে ন্যায় ও স্বাধীনতা ভোগ থেকে বঞ্চিত -একথা স্বামীজি উপলব্ধি করেছিলেন। তাই ভারতবাসীর স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ব্যক্তি-মনের যাবতীয় দ্বন্দ্বকে দূরে সরিয়ে তাদের জাতীয়তাবাদে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন।
পরিশেষে বলা যায়, বিবেকানন্দের সমগ্র রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল পরাধীন ভারতের সাধারণ মানুষের মুক্তি। তিনি ভীরুতা ও কুসংস্কারমুক্ত একটা নতুন সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, পাশাপাশি যাবতীয় জাতি, ধর্ম, ভাষা ও বর্ণের বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে ভারতকে আত্মপ্রকাশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তবে তিনি জাতীয়তাবাদের কথা বললেও তাঁর রাষ্ট্র ভাবনায় আন্তর্জাতিকতাবাদ স্থান পেয়েছিল।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর