বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম প্রবন্ধ রচনা 700+ শব্দে

বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম প্রবন্ধ রচনা

বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা

যে কবির কাব্যে গানে ধ্বনিত হয়েছিল ম্যত্যুঞ্জয়ী চির যৌবনের জয়ধ্বনি, যাঁর কাব্যবীণায় ঝঙ্কৃত হয়েছিল অগ্নিবীণার সুর-ঝঙ্কার, যিনি ধীর স্থির বাংলা কাব্যে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন দুর্বার কালবৈশাখীর ঝড়, তিনি বিদ্রোহী-কবি কাজী নজরুল ইসলাম। পরাধীন ভারতের জড়তাগ্রস্ত সমাজের বুকে, প্রাণহীন প্রান্তরে তাঁর কাব্যে তিনি সঞ্চারিত করেছিলেন নব-যৌবনের শেনিত-ধারা। তাঁর কবিতাগুলি নব-ভারতের সঞ্জীবনী মন্ত্র, তাঁর সংগীত সর্বহারার কান্নার বাণী। তাঁর সংগীত ও কবিতায় সেদিন ‘নবযৌবন- জলতরঙ্গে’র বিপুল আবেগে নেচে উঠেছিল ‘হিমালয়-চাপা প্রাচীর; তিনি ছিলেন পরাধীন ভারতের নবজাগরণের অন্যতম ধ্বজা।’

জন্ম

কবি নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ফকির আহমেদ, মাতা জাহেলা খাতুন। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই ও এক বোন। মনে হয় অস্বচ্ছল দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলেন বলে বাবা-মা আদর করে ছোটোবেলা তাঁর নাম রেখেছিলেন দুখু মিঞা। শৈশবে তিনি হারালেন পিতাকে। সীমাহীন দারিদ্র্য ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের করাল গ্রাস পারল না তাঁকে বিচলিত করতে। অল্প বয়সে কৈশোরের স্বপ্নময় মুহূর্তগুলোকে কঠোর বাস্তবের হাড়িকাঠে বিসর্জন দিলেন না। ধর্মপ্রাণ পিতার আদর্শ ও পারিবারিক পরিবেশ তাঁকে দিয়েছিল দুঃখ জয়ের অমিত শক্তি।

শিক্ষা

নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের বিশিষ্ট মৌলবী কাজী ফজল আহমেদের পাঠশালায়, তাঁর যেমন ছিল অসাধারণ মেধা তেমনি জ্ঞান-আহরণের ক্ষুধা। জীবিকার প্রাণবন্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেও থামেনি তাঁর জানাও শেখার দুর্বার ইচ্ছার উন্মাদনা। তিনি সর্ব্বগ্রাসী ক্ষুধায় কাতর হয়েও পাঠ করলেন কোরান, রামায়ন-মহাভারত, ভাগবত-পুরাণ, যাত্রাগান-কথকতা। বাংলা ও ফরাসী সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। সেখান থেকে পেয়েছিলেন দুঃখ-জয়ের অমোঘ প্রেরণা।

রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল বিদ্যালয় ছেড়ে বর্ধমানের মাথরুণ উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। সেখানের প্রধান শিক্ষক ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। নজরুল পেলেন তাঁর সান্নিধ্য। কিন্তু তাঁকে সচেষ্ট হতে হল উপার্জনের জন্য। এক সহৃদয় মুসলমান দারোগার প্রচেষ্টায় তিনি ভর্তি হলেন ময়মনসিংহ জেলার দরিয়াপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। জীবিকার সন্ধান তাড়া করতে থাকল। বাধ্য হয়ে যোগ দিলেন লেটোর দলে, গান বাঁধলেন, সুরও দিলেন। তাঁর জীবনপ্রবাহ যেন বয়ে চলা নদীর স্রোত। তিনি চেপে আছেন দিভ্রান্ত তরণীতে, ভিড়ছেন এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে। ফিরে এলেন সিয়াসোলে, ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণীতে। তাঁর পরিচয় হল শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সাথে এখানে। বেজে উঠল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দুন্দুভি। তিনি যোগ দিলেন বেঙ্গলী রেজিমেন্টে। সৈনিক হয়ে চলে গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রে, অভিষিক্ত হলেন হাবিলদারের পদে।

বাংলা কাব্যে প্রতিষ্ঠা লাভ

যুদ্ধ শেষ হলো। প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর পৃথিবী। যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের যুবশক্তি তখন বিদ্রোহধর্মী। বিদ্রোহী হাবিলদার কবি নজরুল দুর্বার পদ-বিক্ষেপে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠা-ভূমিতে আবির্ভূত হলেন। তাঁর ‘বিদ্রোহী কবিতাটিই, প্রকৃত-পক্ষে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে তাঁর প্রবেশের প্রথম ছাড়পত্র স্বরূপ। উদাত্তকণ্ঠে তিনি ঘোষণা করলেন-

“বল বীর

বল, উন্নত মম শির

শির নেহারি, আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রির।

বল বিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি।

চন্দ্রসূর্য গ্রহতারা ছাড়ি’

উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-ধরিত্রীর।”

‘বিদ্রোহী’ কবিতাই তাঁকে বাংলার কবিতার আসরে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে সবচেয়ে বেশী। কবি নজরুল হলেন এরপরে বাংলার বিদ্রোহী কবি।

নজরুলের কবিতার উৎস

প্রথম মহাযুদ্ধের অবসান হলো। ছাঁটাইয়ের খাতায় নাম উঠলো নজরুলের। মনে মহাযুদ্ধের স্মৃতি ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দাবাগ্নি জ্বেলে দুর্বার আবেগে ফিরে এলেন বাংলাদেশের মাটিতে বাংলার হাবিদার-কবি। তিনি অবতীর্ণ হলেন বিদ্রোহের বহ্নিচ্ছটা নিয়ে বাংলার কবিতার আসরে। তাঁর ছিল কোরান-পুরান-গীতা- মহাভারতের গভীর জ্ঞান এবং আরবী-ফরাসী-সংস্কৃত-বাংলার শব্দ ভাণ্ডারের দুর্লভ চাবিকাঠি ছিল তাঁর হাতে। আর ছিল উদাত্ত কণ্ঠ এবং রাগ-রাগিনীর জ্ঞানের সঙ্গে বাংলার কীর্তন-বাউল-ঝুমুর-সারি-ভাটিয়ালির প্রতি টান ও ফরাসী গজলের প্রাণ-মাতানো সুর বাহার।

বিদ্রোহী যৌবনের কবি

নজরুল চির-যৌবনের কবি। প্রাণ প্রাচুর্যই নিশ্চিত প্রাণ-লক্ষণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আশাভঙ্গ হেতু সেই যৌবন বিদ্রোহ-ধর্মী। সর্ব শোষক- শৃঙ্খলা সবলে ভাঙবার দুর্জয় সাধনায় তিনি হলেন ব্রতী। নজরুলের কবিতায় ও কাব্যে শোনা গেল সেই বিদ্রোহী যৌবনের নির্বাধ পদধ্বনি। বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি দেখলেন দেশব্যাপী পরাধীনতার নীরন্ধ্র অন্ধকারে, ধনিক শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদীদের নির্লজ্জ শোষণে সমগ্র সমাজে রচিত হয়েছে এক বিশাল শ্মশান-ভূমি, বজ্র-গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন,

আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস ”

আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।”

কর্মময় জীবন

সাহিত্য ও সঙ্গীতের সেবায় নজরুল নিজেকে উৎসর্গ করলেন, তিনি যুক্ত হলেন ‘মোহম্মদী’, ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার সঙ্গে। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথম প্রকাশ ‘মোসলেম ভারতে’। তিনি লিখলেন কাব্যগ্রন্থ-অগ্নিবীণা (১৯২২), দোলনচাঁপা (১৯১৯), বিষের বাঁশী (১৯২৪), ভাঙার গান (১৯২৪), প্রলয়শিখা (১৯২৪), ছায়ানট (১৯২৫), পূর্বের হাওয়া (১৯২৫), সাম্যবাদী (১৯২৫), চিত্তনামা (১৯২৫), সর্বহারা (১৯২৬), ফণিমনসা (১৯২৭), সিন্ধু-হিন্দোল (১৯২৭), ঝিঙেফুল (১৯২৮), সাতভাই চম্পা (১৯২৮), জিঞ্জীর (১৯২৮), চক্রবাক্ (১৯২৯), সন্ধ্যা (১৯২৯), নতুন চাঁদ (১৯৪৫), মরুভাস্কর (১৯৫০), শেষ সওপাত (১৯৫৮), গুলবাগিচা, ফুলফিকার, কাব্য আস্পারা, বুলবুল, ঝড়।

শিশু কবিতা সংকলন

পুকুলের বিয়ে, ঘুম-জাগানো পাখী, ঘুমপাড়ানী মাসিপিসী।

উপন্যাস

কুহেলিকা, মৃত্যুক্ষুধা, জীবনের-জয়যাত্রা।

সংগীত গ্রন্থ

চোখের চাতক, চন্দ্রবিন্দু, সুরসাকী, বনগীতি, গানের মালা, গীতি-শতদল, নজরুল গীতিকা, রাঙাজবা, সন্ধ্যা-মালতী। একাঙ্ক নাট্য সংকলন : ঝিলমিলি প্রভৃতি।

‘ধূমকেতু’ ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন দৈনিক ‘নবযুগ’ সাপ্তাহিক ‘লাঙল’, মাসিক ‘নওয়োজ’।

উপসংহার

কবি ১৯৪২ সালে আক্রান্ত হলেন এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে। তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে পদ্মভূষণ, ডি-লিট প্রভৃতি পুরস্কার দিয়ে। তখন বিস্মৃতি তাঁকে গ্রাস করেছে। তিনি বাকহারা। শেখ মুজিবর তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন, দিলেন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগষ্ট মহান কবির জীবন-প্রদীপ নিভে গেল। তিনি শায়িত হলেন চিরনিদ্রায়।

আরও পড়ুন – মহাত্মা গান্ধী প্রবন্ধ রচনা

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment