গান্ধিজির অছিবাদের মূল বক্তব্য কী? তাঁর অছিবাদের মূল উদ্দেশ্যগুলি আলোচনা করো
গান্ধিজির রাজনৈতিক চিন্তায় অছিবাদ (Trusteeship) এর ধারণা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর রাষ্ট্রহীন সমাজের ধারণার একটি প্রধান উপাদান হল অছিবাদ সম্পর্কিত ধারণা। তিনি তাঁর বিভিন্ন লেখনী এবং বক্তৃতায় অছিবাদের ধারণাটি বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন, এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল-“Constructive Programme: Its meaning and place”, যেখানে তিনি অর্থনৈতিক সততা, ত্যাগ এবং অহিংস সামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে অছিবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। গান্ধিজির ত্যাগের ভাবনা থেকেই এসেছে অছিবাদ সম্পর্কিত ধারণা। তিনি তাঁর কল্পনায় একটি আদর্শবাদী সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
অছিবাদের মূল বক্তব্য
গান্ধিজির অছি সম্পর্কিত তত্ত্বের মূল বক্তব্য হল সমাজের ধনী ব্যক্তিরা তাদের ন্যূনতম চাহিদা মিটিয়ে সম্পদের বাকি তথা অতিরিক্ত অংশটুকু সর্বসাধারণের জন্য দান করবে বা সমাজের সমগ্র স্বার্থে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত রাখবে। অছি বা Trustee হিসেবে তারাই এই অতিরিক্ত সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে। এক্ষেত্রে মালিকশ্রেণি সততার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। এর ফলে সমস্ত রকম শ্রেণিদ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং সমাজে নৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক: গান্ধিজির মতে অছি রক্ষণ হল বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজকে সমতাভিত্তিক সাম্যবাদী সমাজে বদল করার একটি উপায়। এই ব্যবস্থা পুঁজিবাদকে সমর্থন করে না। বরং মালিকশ্রেণিকে আত্মসংশোধনের সুযোগ দেয়। গান্ধিজির স্বপ্নে ‘অছি’ ছিল গ্রামস্বরাজ বা সর্বোদয় সমাজব্যবস্থা স্থাপনের একটি বিশেষ উপায়। যেখানে মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার সংস্কারসাধন ও জনসাধারণের মানসিকতার উন্নতিবিধান করা।
মানসিক উন্নয়নে গুরুত্ব আরোপ: তিনি পরিবেশের শোষণ বা ক্ষতি না করে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মঙ্গলের কথা বলেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি মানসিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন। গান্ধিজি শান্তিপূর্ণ উপায়ে যুক্তিতর্ক ধর্মকথা, নীতিকথার দ্বারা মালিকশ্রেণির হৃদয় পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন যার মাধ্যমে সমাজে বৈষম্য, ভেদাভেদ, অসম বণ্টনের মতো সমস্যাগুলি সমাধান করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা করেন।
ত্যাগের আদেশ: তিনি বলেন মালিকশ্রেণি যদি নিজের মুনাফা বৃদ্ধির জন্য সম্পদের অপব্যবহার করে বা সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখে, তখনই সমাজের অন্য শ্রেণিগুলির মধ্যে আর কোনো সমন্বয় থাকে না অর্থাৎ বিরোধ তৈরি হয়। তাই তিনি ত্যাগের আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।
অছিবাদের মূল উদ্দেশ্যসমূহ
অছি ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যসমূহ হল নিম্নরূপ—
[1] অছিবাদ বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে সাম্যের পথে পরিবর্তন করতে চায়। এখানে সমাজের মালিকশ্রেণিকে নিজেদের সংশোধনের একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
[2] ব্যক্তিগত মালিকানার কোনো অধিকার এই তত্ত্বে স্বীকারযোগ্য নয়। ব্যক্তিস্বার্থের বদলে সমষ্টির কল্যাণের স্বার্থে ধনীরা নিজেদের নিয়োজিত করবে।
[3] আইনসভার পক্ষ থেকে মালিকানা ও সম্পত্তি ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা জারি করতে হবে।
[4] রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অছিব্যবস্থায় কোনো ব্যক্তি তার নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য সম্পত্তি কুক্ষিগত রাখতে বা ব্যবহার করতে পারবে না এবং সমাজের স্বার্থকে অবজ্ঞা করতে পারবে না।
[5] ব্যক্তির সর্বোচ্চ আয়ের সীমা নির্ধারণ করতে হবে এবং সুস্থ জীবনযাপনের মতো উপযোগী সর্বনিম্ন মজুরি ধার্য করতে হবে।
[6] সামাজিক চাহিদার উপর উৎপাদনের (গুণগত ও পরিমাণগত) চরিত্র নির্ভরশীল, কোনো লোভ বা ইচ্ছার উপর নয়।
[7] অর্থনৈতিক কার্যকলাপ এমনভাবে পরিচালনা করতে হবে যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উভয়েই উপকৃত হয়।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর