মহাত্মা গান্ধী প্রবন্ধ রচনা 900+ শব্দে

মহাত্মা গান্ধী প্রবন্ধ রচনা – আজকের পর্বে মহাত্মা গান্ধী প্রবন্ধ রচনা আলোচনা করা হল।

মহাত্মা গান্ধী প্রবন্ধ রচনা

মহাত্মা গান্ধী প্রবন্ধ রচনা
মহাত্মা গান্ধী প্রবন্ধ রচনা

মহাত্মা গান্ধী ও ভারতবর্ষ

যুগে যুগে এমন সব মহামানব জন্মগ্রহণ করেন যাঁদের কর্মসাধনা, ভাবসাধনার মধ্য দিয়ে জাতির আশা-আকাঙ্খা, স্বপ্ন সার্থকতা লাভ করে, তাঁদের মহৎ জীবন-দীপবর্তিকা সকল মানুষের ঋদ্ধি ও সিদ্ধির পথটি আলোয় ভরিয়ে দেয়। এসকল ক্ষণজন্মা পুরুষ বিশাল বনস্পতির মতো। তাঁরা জাতিকে নির্ভয় আশ্রয় দান করেন, স্নিগ্ধ ছায়া দান করেন, জাতীয় জীবনে প্রবাহিত করেন মহত্তর জীবনের স্রোতধারা। মহাত্মা গান্ধী ছিলেন এমন এক ক্ষণজন্মা পুরুষ যাঁর শুভ আবির্ভাবে পরাধীন ভারতের রূপান্তর ঘটল স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে। ভারতের রাষ্ট্রিক সাধনাকে তিনি সফল করে তুলেন, সমগ্র দেশের প্রাণসত্তাকে উজ্জীবিত করেছেন। তাঁর সুদীপ্ত চরিত্রমহিমা, প্রগাঢ় দেশপ্রেম ও বিপুল আত্মপ্রত্যয়ের প্রেরণা- বলে ভারতবাসী মৃত্যুকে তুচ্ছ করে বিদেশী ব্রিটিশ-শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে এগিয়ে এল।

জন্ম ও বাল্যকাল

মহাত্মা গান্ধী ১৮৬৯ সালে গুজরাটের অন্তর্গত পোরবন্দরে এক বনিক বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা করমচাঁদ গান্ধী কাঁথিয়াবাড় রাজ্যের দেওয়ান ছিলেন। পোরবন্দরে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করে গান্ধীজী রাজকোট বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শৈশব ও কৈশোরে তিনি ছিলেন খুব লাজুক ও ভীতু প্রকৃতির। জৈন পরিবারে তাঁর জন্ম হওয়ায় মাছ-মাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ ছিল। রাজকোটে অধ্যয়নকালে কয়েকজন অসৎ প্রকৃতির বন্ধুর সংস্পর্শে তিনি ধূমপান ও চুরিবিদ্যায় উৎসাহী হলেও সহজাত অন্তরের প্রেরণায় এই কুঅভ্যাস ত্যাগ করতে সমর্থ হন। কিশোর বয়সে তাঁর সত্যের প্রতি অনুরাগ দেখা যায় এবং তেরো বছর বয়সে তিনি বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন কস্তুরীবাই-এর সাথে।

ব্যারিষ্টারী পড়ার জন্য বিলাত যাত্রা

প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে গান্ধীজী বিলাতযাত্রা করেন ব্যারিষ্টারী পড়ার জন্য এবং ১৮৯১ সালে ভারতে ফিরে আসেন ব্যারিষ্টারী পাশ করে। তিনি বোম্বাই হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং এই সময় তিনি স্বনামধন্য দাদাভাই নৌরজী ও গোপালকৃষ্ণ গোখলের সংস্পর্শে আসেন। তাঁদের নিকট গান্ধীজী জাতীয়তামন্ত্রে প্রথম দীক্ষিত হন। ১৮৯৩ সালে তিনি একটি মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় যান এবং সেখানে অবস্থানকালে সত্য ধর্ম ও অহিংসাধর্মে ব্রতী হন।

নাটালে অহিংস সংগ্রাম

তখন আফ্রিকার নাটাল প্রদেশে বহু ভারতীয় বাস করত। শ্বেতাঙ্গবাসীরা কৃষ্ণাঙ্গ ভারতবাসীর ওপর অসহনীয় অত্যাচার করত। ভারতবিরোধী নাটাল সরকার আইনসভায় এমন একটি বিল আনেন যা ভারতীয়দের স্বার্থ-বিরোধী ছিল। প্রবাসী ভারতীয়গন গান্ধীজীর শরনাপন্ন হলে তিনি প্রবাসী ভারতবাসীর আত্মমর্যাদা ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষায় ব্রতী হলেন এবং অহিংস পন্থায় প্রতিরোধ গড়ে তুললেন সরকারের বিরুদ্ধে। জয় হল সত্যের পাশবিক শক্তির হল পরাজয়।

ভারতে প্রত্যাবর্তন

দীর্ঘ একুশ বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থান করে গান্ধীজী ১৯১৪ সালে ভারতে ফিরে এসে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। আমেদাবাদের সবরমতী নদীর তীরে সত্যাগ্রহ আশ্রম স্থাপন করে জনসেবা ও গঠনমূলক কাজ শুরু করেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে যুদ্ধ শেষে ভারতকে স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার দেবে। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হল। ব্রিটিশ সরকারকে তিনি এই সময় সহায়তা করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করল না এবং দুরভিসন্ধিপূর্ণ রাউলাট আইন প্রণয়ন করল। সারা ভারত তখন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হল।

অসহযোগ আন্দোলন

১৯২০ সালে কলকাতায় সংগ্রেস অধিবেশনে গান্ধীজী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সত্যাগ্রহ ও অসহযোগ আন্দোলন ভারতবর্ষে রাজনীতির ক্ষেত্রে এক নবদিগন্তের দারোদঘাটন করল। তিনি এগিয়ে এলেন ভারতবাসীর জড়ত্ব দূর করে আত্মসম্মান ও আত্মপ্রত্যয়কে জাগিয়ে তুলতে এবং আত্মপ্রকাশকে বীর্যদীপ্ত পথে পরিচালিত করতে। ১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তিনি অনশন আরম্ভ করলেন। যখনই জাতি তার সংকীর্ণ স্বার্থ ও দুষ্কৃতির দ্বারা দেশে দুর্বলতার বিষ ছড়ানোর চেষ্টা করেছে তখনই তিনি নীলকণ্ঠ হয়ে নিজে সেই বিষ গ্রহণ করে জাতিকে শোচনীয় অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ার অকল্যাণকে প্রতিরোধ করার জন্য তিনি ১৯৩২ সালে যারবেদা জেলে অনশনে মৃত্যুবরণ ঘোষণা করেন। এরফলে ঐতিহাসিক ‘পণ্যচুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়।

ডাণ্ডি অভিযান

১৯৩০ সালের ফেব্রুয়ারী মাস ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি স্মরণীয় অধ্যায় হিসাবে সূচিত হল। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ ঘোষণা করল এবং আইন অমান্যের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই অবিস্মরণীয় আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন গান্ধীজী। লবনাআইন অমান্যের সংকল্প নিয়ে তিনি ডাণ্ডি অভিযান শুরু করেন। ব্রিটিশের কঠোর দমননীতি ভারতবাসীকে দেশাত্মবোধে গভীরভাবে উদ্দীপ্ত করল। অধ্যাত্মশক্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করল ব্রিটিশের পাশবিক শক্তি। স্বাক্ষরিত হল ‘গান্ধী আরউইন চুক্তি’: গান্ধীজী স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করবার জন্য অস্পৃশ্যতাবর্জন, হিন্দু মুসলমানের মিলনসাধন ও কুটিরশিল্প স্থাপনকে অগ্রাধিকার দিলেন। অস্পৃশ্য অনুন্নতশ্রেণিকে স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শুরু করলেন হরিজন আন্দোলন। দ্বিধাবিভক্ত হতে দিলেন না হিন্দু-মুসলমানকে।

ভারত ছাড় আন্দোলন

গান্ধীজীর নেতৃত্বে ও প্রেরণায় ভারতের রাজনৈতিক পটভূমি দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাবানল ভারতের রাজনৈতিক আকাশকে রক্তবর্ণে রঞ্জিত করে তুললল। ব্রিটিশ রাজশক্তি স্বাধীনতার দাবী অস্বীকার করে ভারতকে জোর করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করল। গান্ধীজীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ রাজশক্তিকে এদেশ থেকে চলে যাওয়ার জন্য ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু হল ১৯৪২ সালের ৮ই আগষ্ট। এইদিন কংগ্রেসের। বোম্বাই অধিবেশনে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহীত হয়। গান্ধীজী ও কংগ্রেসের সদস্যবৃন্দকে কারাগারে বন্দী করা হল। সারা ভারতে জ্বলে উঠল বিদ্রোহের আগুন। কারাগার থেকে গান্ধীজী জাতিকে শোনালেন অভয়বাণী, ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’। ব্রিটিশ রাজশক্তি বাধ্য হল ভারতকে স্বাধীনতা দিতে, কিন্তু তাদের কূটকৌশলে দেশ হল দ্বিধাবিভক্ত।

সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা ও গান্ধীজীর জীবনাবসান

সাম্প্রদায়িক দুর্যোগে উত্তপ্ত হল ভারতের মাটি, স্বাধীনতা লাভের পরেও নবজাত দুটি রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মিলন সম্ভব হল না। তিনি ১৯৪৬ সালে নোয়াখালি থেকে কলকাতা দিল্লী সর্বত্র ছুটে গেলেন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি বললেন, ‘আমি যে স্বাধীন ভারতে বাস করি সেখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সকল ভারতবাসী প্রকৃত বন্ধুর মত বাস করবে। এই স্বপ্ন সফল করতে মৃত্যুবরণ করাও শ্রেয় মনে করি। গৃহযুদ্ধে ছিন্নভিন্ন ভারতবর্ষ দেখার জন্য আমি বেঁচে থাকতে চাই না, তার আগে ভগবান যেন আমাকে মৃত্যু দেন।’ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন তো হল না, বরঞ্চ হিংসার দাবানল সর্বগ্রাসী রূপে ছড়িয়ে পড়ল। ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারী গান্ধীজী দিল্লীতে প্রার্থনা সভায় প্রবেশ করছিলেন, এমন সময় এক হিন্দু যুবকের রিভলভারের গুলিতে অহিংসার প্রতীক মানবপ্রেমী মহাত্মা গান্ধীর জীবন প্রদীপ চিরতরে নিভে গেল।

উপসংহার

মহাত্মাজীর মরদেহের বিনাশ ঘটলেও তাঁর জীবন-বীণা মরণ-বিজয়ী। তিনি রাজনীতির মধ্যে যুক্ত করেছিলেন মানবসত্যকে, মানবধর্মকে। তিনি বিশ্ববাসীকে প্রমান করে দেখিয়ে দিলেন যে অহিংসাকে আশ্রয় করেও স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব। তাঁর অহিংস সংগ্রাম ধর্মযুদ্ধের নামান্তর মাত্র। গান্ধজী প্রদর্শিত অহিংস পন্থা রাজনীতির যে সেরা পন্থা তা আজ সারা বিশ্ব মনে করে। তাই তো তিনি ভারতের জাতির জনক নামে সমস্ত ভারতবাসীর অন্তরে পরম শ্রদ্ধার সাথে অমর হয়ে আছেন।

আরও পড়ুন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবন্ধ রচনা

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment