গান্ধিবাদের মূলনীতি অহিংসার অর্থ আলোচনা করো
অহিংসার অর্থ
গান্ধিজির মতাদর্শের মূলনীতি হল অহিংসা। তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলন, ইয়ং ইন্ডিয়া, হরিজন-সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, বক্তৃতায় অহিংসার ধারণা ব্যক্ত হয়েছে। সংস্কৃত শব্দ অহিংসাকে গান্ধিজি সাবেকি অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। যার ইংরেজি অর্থ Non-injury or non-killing। পরবর্তীকালে গান্ধিজি Non-Violence-কে প্রয়োগ করেন, যার অর্থ-বিরোধীর প্রতি আঘাত বা তাঁর মৃত্যুর কারণ হতে পারে, এই ধরণের শারীরিক বলপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকা। সাধারণভাবে অহিংসা বলতে অন্যকে হিংসা না করা বা অন্যের ক্ষতি না করাকে বোঝায়। কিন্তু গান্ধিজি অহিংসাকে সংকীর্ণ অর্থে গ্রহণ না করে ব্যপক ও ইতিবাচক অর্থে গ্রহণ করেছিলেন। ব্যাপক ও ইতিবাচক অর্থে অহিংসা বলতে বোঝায় নিঃস্বার্থপরতা। প্রতিপক্ষকে ভালোবেসে তার হৃদয় জয় করা। সর্বোপরি অহিংসা হল অপরের কল্যাণসাধন করা। গান্ধিজি বলেছিলেন, অহিংসা বলতে আমি জগতের সবচেয়ে সক্রিয় শক্তিকে বুঝি। অহিংসা হল সর্বোত্তম আদর্শ, বিশ্বের মহান বিজয় নীতিগুলির মধ্যে একটি হল অহিংসা। বিশ্বের কোনো শক্তি অহিংসাকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। অহিংসা মৃত্যুহীন।
গান্ধিজি অহিংসাকে ব্যক্তিগত স্তর থেকে জাতিগত স্তরে উন্নীত করে এর অর্থকে আরও বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গান্ধিজির কাছে একমাত্র অহিংসার পথে সত্যের উপলব্ধি সম্ভব। কাপুরুষ বা ভীরু ব্যক্তি কখনোই অহিংস নীতির যুগযাত্রি হতে পারে না। একমাত্র সাহসী, সত্যবান চরিত্রের ব্যক্তিদের দ্বারাই অহিংসার নীতিকে উপলব্ধি করা সম্ভব। ভয়ার্ত না হয়ে মাথা উঁচু করে অন্যায়ের প্রতিরোধ করাই অহিংস আদর্শের প্রধান নীতি। গৌতম বুদ্ধের থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে গান্ধিজি বলেন, জীবনযাপন করা এবং অন্যদের নিজস্ব জীবনযাপনে সাহায্য করা, যা হবে বিশ্বজনীন সমন্বয়ের রাজপথ।
উদ্ভবগত দিক: গান্ধিজির ‘অহিংসা’ তত্ত্বটির উদ্ভবগত দিকটিকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ভারতের সনাতন ধর্মগ্রন্থ উপনিষদ এবং গীতার মতোই পুরাতন ধারণা হল অহিংসা। বুদ্ধ ও মহাবীরের প্রায় ২৫০ বছর আগে Parvanatha নামক ব্যক্তি সর্বপ্রথম চুরি না করা ও অহিংস নীতি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
ধর্মীয় প্রভাব: জৈনবাদে অহিংসা নীতিকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মতে, অহিংসা হল সর্বোচ্চ ধর্ম, সর্বোচ্চ কর্তব্য-অহিংসা হল পরমধর্ম। ইহুদিদের অন্যতম ধর্মগুরু মোজেজ (Mosaic) বলেন- ‘হত্যা করা উচিত নয়’। এ ছাড়া হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম অনুরূপভাবে অহিংসা তত্ত্বকে প্রকাশ করেছে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রামের পর্বে গান্ধিজি দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ঘোষণা করেন যে, অহিংসা হল বলবানের অস্ত্র এবং হাতে অস্ত্র থাকলেও তিনি অহিংসাকেই অনুসরণ করবেন।
সারাজীবন জুড়ে অহিংসাকে অবলম্বন করে গান্ধিজি তাঁর কাজ করেছিলেন এবং গান্ধিজির চিন্তার বিশেষত্ব হল এই যে, তিনি অহিংসাকে ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ না রেখে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এই নীতিকে প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন – সরকারের বিভিন্ন রূপ বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর