গান্ধিজির সত্যাগ্রহ সম্পর্কিত ধারণাটির সমালোচনাগুলি আলোচনা করো

গান্ধিজির সত্যাগ্রহ সম্পর্কিত ধারণাটির সমালোচনাগুলি আলোচনা করো

গান্ধিজির সত্যাগ্রহ সম্পর্কিত ধারণাটির সমালোচনাগুলি আলোচনা করো
গান্ধিজির সত্যাগ্রহ সম্পর্কিত ধারণাটির সমালোচনাগুলি আলোচনা করো

সত্যাগ্রহ সম্পর্কিত ধারণাটির সমালোচনাসমূহ

গান্ধিবাদীরা সত্যাগ্রহকে তত্ত্বগত ও প্রয়োগগত সকল দিক থেকে সফল বলে মনে করলেও গান্ধির সত্যাগ্রহ নীতিটি নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। সত্যাগ্রহের বিরুদ্ধে সমালোচনাগুলি হল-

[1] অবাস্তব নীতি: বাস্তবে সত্যাগ্রহের দ্বারা, নিরক্ষরতা দূরীকরণের মতো সংস্কারমূলক কাজ করা সম্ভব হলেও ব্যাপক গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে এটির প্রয়োগ সম্ভব নয়।

[2] সীমিত কার্যকারিতা: কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে বা এমন পরিস্থিতিতে, যেখানে নিপীড়ক নৈতিক আবেদন দ্বারা প্রভাবিত হন না সেইরূপ অবস্থায় সত্যাগ্রহ অকার্যকর।

[3] ব্যক্তিগত বলিদান: সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণকারীদের প্রায়ই ব্যক্তিগত বলিদানের শিকার হতে হয়। যার মধ্যে কারাদণ্ড, দমনপীড়ন অন্তর্ভুক্ত। তাই সমালোচকদের মতে এটি অংশগ্রহণকারীদের কাছে অপ্রয়োজনীয় কষ্ট এবং ত্যাগের কারণ হতে পারে।

[4] প্রতিপক্ষের যৌক্তিকতা অগ্রাহ্য: সত্যাগ্রহীরা বিশ্বাস করেন যে, সত্য ও নৈতিক আবেদন দ্বারা প্রতিপক্ষের মত পরিবর্তন করানো যায়। যা প্রাসঙ্গিক নয় কারণ, প্রতিপক্ষ যদি অযৌক্তিক বা ধর্মান্ধ হয় তবে তার সাথে এই পদ্ধতিতে মোকাবিলা করা সম্ভব হয় না।

[5] নৈতিক আবেদন নির্ভর: সত্যাগ্রহ পদ্ধতিতে অনুমান করা হয় যে, নিপীড়কদের নৈতিক আবেদন দ্বারা ও সত্য কথার মাধ্যমে প্রভাবিত করা সম্ভব। কিন্তু নিপীড়করা নৈতিক বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন হলে সত্যাগ্রহ পদ্ধতিটির বাস্তব পদ্ধতিটির প্রয়োগ সম্ভব নয়।

[6] হিংসাত্মক আন্দোলন: সমালোচকদের মতে গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত সত্যাগ্রহ আন্দোলনটি অহিংস নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তীকালে সেটি হিংসামূলক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছিল।

[7] আধ্যাত্মিক: গান্ধিজির সত্যাগ্রহ তত্ত্বটি অতিমাত্রায় আধ্যাত্মিক প্রকৃতির হওয়ায় সত্যাগ্রহের অভিব্যক্তি সকলের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি।

[৪] বলপ্রয়োগের হাতিয়ার: সি এস বোসের অভিমত অনুযায়ী, সত্যাগ্রহের বিভিন্ন উপায় ও পদ্ধতি বাস্তবে বলপ্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। গান্ধিজি সত্যাগ্রহে অহিংস পদ্ধতির পথ অবলম্বন করার কথা বললেও, প্রকৃতপক্ষে এই পদ্ধতিতে প্রতিপক্ষের উপর প্রবল মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয়, যা সমালোচকদের কাছে এক ধরনের বলপ্রয়োগ হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

[9] গণআন্দোলনে সত্যাগ্রহ অচল : সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করার জন্য গান্ধিজি যেমস্ত গুণের কথা বলেছেন তা অর্জন করা একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আকস্মিক কোনো গণআন্দোলনে ওইরূপ গুণসম্পন্ন ব্যক্তির অভাবে সত্যাগ্রহ অচল হয়ে পড়বে।

[10] সম্মোহনী নেতৃত্ব: সত্যাগ্রহের সাফল্য অধিকাংশেই নির্ভর করে গান্ধিজির মতো সম্মোহনী নেতৃত্বের উপর। এই ধরনের নেতৃত্ব ছাড়া শৃঙ্খলা ও ঐক্যের অভাবে আন্দোলনটি ব্যর্থ হতে বাধ্য।

[11] সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট: ধর্মঘট, পিকেটিং, অনশনের ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়, যার প্রভাবে অনেকসময় দারিদ্র্য ও দুর্বলদের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

[12] ধারণাগত অস্পষ্টতা: দার্শনিক এবং তাত্ত্বিকরা সত্যাগ্রহের ধারণাগত ভিত্তির সমালোচনা করেছেন। তাদের মতানুসারে, জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরমসত্যের ধারণাটি ধারাবাহিকভাবে পালন করা সম্ভব নয়।

[13] ইতিহাসের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা: সত্যাগ্রহীদের মত অনুযায়ী, সত্যাগ্রহের মাধ্যমেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ প্রশস্ত হয়েছে। যেটি সমালোচকরা সত্য বলে মেনে নেননি। কারণ তাদের মতানুযায়ী, গান্ধিজির অহিংস আন্দোলন শুধু নয়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন, সশস্ত্র বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ, সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজের ভূমিকাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

পরিশেষে বলা যায় যে, নানাবিধ সমালোচনা সত্ত্বেও গান্ধিজির সত্যাগ্রহ তত্ত্বের সদর্থক ধারণাকে কোনোমতেই অস্বীকার করা যায় না। কারণ, তিনি সাফল্যের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য ও বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অহিংস-অসহযোগ (১৯২০-১৯২২ খ্রি.) অথবা আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০-১৯৩৪ খ্রি.)-গুলিকে তিনি কার্যত সংগঠিত গণআন্দোলনে পরিণত করেছিলেন। জীবনের সর্বদিক আলোকিত করে সত্যাগ্রহ তত্ত্বকে যুগোপযোগী করে তুলেছেন তিনি।

আরও পড়ুন – সরকারের বিভিন্ন রূপ বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment