নুন কবিতার নামকরণের সার্থকতা
নুন কবিতার নামকরণের সার্থকতা
সাহিত্যের নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা নামকরণের মধ্য দিয়ে পাঠক যেমন সাহিত্যের বিষয় অনুধাবন করতে পারে, তেমনই রচয়িতার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। তাই সাহিত্যের নামকরণের ক্ষেত্রে মূলত তিনটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়- (১) ঘটনা বা কাহিনিগত নামকরণ (২) চরিত্র বা পাত্রীর নামানুসারে নামকরণ এবং (৩) ব্যঞ্জনা বা প্রতীক বা রূপকধর্মী নামকরণ। এখন আলোচনা করে দেখা যাক, আমাদের পাঠ্য কবি জয় গোস্বামীর ‘ভুতুমভগবান’ কাব্যের অন্তর্গত ‘নুন’ কবিতাটির নামকরণ কোন্ পদ্ধতি অবলম্বনে করা হয়েছে এবং সেই নামকরণই বা কতটা সার্থক হয়েছে।
কবি জয় গোস্বামী তাঁর ‘নুন’ কবিতায় দক্ষ শিল্পীর মতো সমাজের নিম্নবিত্ত খেটেখাওয়া হতদরিদ্র মানুষের শখ-আহ্লাদ এবং জীবনযন্ত্রণার কাহিনি চিত্রিত করেছেন। নিম্নবিত্ত হতদরিদ্র মানুষগুলো সাধারণ ভাতকাপড়ে অর্থাৎ মানুষের বাঁচার ন্যূনতম উপাদান খাদ্যবস্তু পেলেই খুশি হয়ে যায়-তাদের চাহিদা খুবই সামান্য। তাই তারা অধিক কিছু লাভের আশায় অহেতুক দুঃখ করে দিন কাটায় না। বিপদে বা অসুখ থেকে বাঁচার তাগিদে কখনো-কখনো ধারদেনাও করতে হয়-এভাবে কঠোর জীবনসংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। নিজেদের জীবনের অন্তহীন অভাব, দুঃখ-যন্ত্রণা ভুলে থাকতে গাঁজার নেশায় বুঁদ হয়ে যায়। জীবনে সাময়িক আনন্দ, সুখ লাভের জন্য পারিবারিক সম্ভ্রমবোধকে তারা নষ্ট করে ফেলে। অভাবের তাড়নায় এদের প্রতিদিন হাঁড়ি চড়ে না আবার যেদিন কিছু অর্থ উপার্জন করে সেইদিন অভাব, দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে বেহিসাবি ভাবে জিনিস কেনে, এবং নিজেদের সুখ, স্বপ্ন সৌন্দর্য অনুভূতিগুলোকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করে। তাই কবিতায় কথক জানিয়েছেন- ‘বাড়িতে ফেরার পথে কিনে আনি গোলাপচারা।’ এই ‘গোলাপচারা’-র উপমা ব্যবহার করে কবি এই মানুষগুলো সখ বা সৌন্দর্য অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু স্থানাভাবে ঐ গোলাপচারা পোঁতা বা তাতে ফুল হওয়ার অনিশ্চয়তা দেখা দেয়-অর্থাৎ তাদের স্বপ্ন বা সৌন্দর্য অনুভূতিগুলো বাস্তবায়িত হয় না। এসব বাস্তব জীবনযন্ত্রণা সাময়িক ভুলে থাকতে তারা গাঁজার নেশায় আসক্ত হয়। দুঃখ, কষ্ট অভাবকে সঙ্গী করে হেসে খেলে দিন অতিবাহিত করতে করতে একসময় ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। সারাদিন রক্ত, ঘাম ঝড়ানো পরিশ্রম করে মধ্য রাতে বাড়ি ফিরে খাদ্য এবং খাদ্যের ন্যূনতম উপকরণটুকু না পেয়ে সম্ভ্রমবোধ ভুলে মাত্রাছাড়া পারিবারিক কোন্দল শুরু করে। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ প্রবাদ এদের জীবনে চরম সত্য হয়ে ফুটে ওঠে। তাই এরা সুশীল সমাজ তথা রাষ্ট্রের কাছে একমুঠো ভাত অর্থাৎ খাদ্য এবং নুন অর্থাৎ খাদ্যের ন্যূনতম উপকরণের সোচ্চার দাবি জানায়। কবিতায় কবি ‘নুন’ শব্দটিকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। নুন হল খাদ্যের সামান্য কিন্তু অপরিহার্য উপকরণ। বেঁচে থাকার জন্য সামান্য যেটুকু প্রয়োজন নিম্নবিত্ত, হতদরিদ্র মানুষেরা সমাজ তথা রাষ্ট্রের কাছে তার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। সমগ্র কবিতা জুড়ে একথাই কবি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তাই সমগ্র আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় ‘নুন’ কবিতার নামকরণ ব্যঞ্জনাধর্মীতে রীতিতে করা হয়েছে এবং সেটা যথাযথ ও সার্থক হয়েছে।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর