গণতন্ত্রের প্রকৃতি আলোচনা করো
গণতন্ত্রের প্রকৃতি
বর্তমান যুগে গণতন্ত্র শব্দটি দ্বারা এক বিশেষ সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা, এমনকি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝায়। গিডিংসের ভাষায় বলা যায়-গণতন্ত্র হল সরকারের অথবা রাষ্ট্রের আকার কিংবা সমাজের রূপ কিংবা এই তিনটি বিষয়ের সমাহার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় যেসকল শব্দ ও ব্যঞ্জনার মাধ্যমে গণতন্ত্রের ধারণাটিকে বোঝানো হয়, তাদের বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রের ধারণাটির প্রকৃতি অনুধাবন করা যায়, যা নিম্নে আলোচনা করা হল-
(i) গণতান্ত্রিক সমাজ: সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে গণতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ সাম্যের ভিত্তিতে যে সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তাকে গণতান্ত্রিক সমাজ বলা হয়। গণতান্ত্রিক সমাজে সকল ব্যক্তি সমমর্যাদাসম্পন্ন। সকল নাগরিক সমাজে সমানাধিকার ও সমান সুযোগ ভোগ করে থাকে। এই ধরনের গণতন্ত্রে জন্মগত বা শ্রেণিগত কিংবা ধনগত বৈষম্যকে অস্বীকার করা হয়। এখানে বলপ্রয়োগের কোনো সুযোগ থাকে না।
(ii) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলতে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বোঝায়, যা রাজনৈতিক সাম্য নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক সম-রাজনৈতিক সুযোগ ও মর্যাদা ভোগ করে থাকেন। হারশ, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ তাত্ত্বিকেরা এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণই চূড়ান্ত ক্ষমতা ও সমগ্র কর্তৃত্বের অধিকারী, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল অর্থ হল ‘সার্বভৌমত্বে সকলের প্রবেশাধিকার’।
(iii) গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও গণতন্ত্র সংকীর্ণ অর্থে অভিন্ন। জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত এবং প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলে। প্রাচীন গ্রিসে এই ধরনের প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। বর্তমান যুগে জনসংখ্যাবৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন বৃহদায়তন রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের জায়গায় পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।
(iv) গণতান্ত্রিক সরকার: গণতান্ত্রিক সরকার বলতে এমন এক শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়, যে শাসনব্যবস্থায় জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে অর্থাৎ এইরূপ সরকারের শাসন জনগণের দ্বারা পরিচালিত হয়।
(v) অর্থনৈতিক গণতন্ত্র : গণতান্ত্রিক আদর্শের সম্প্রসারণের মাধ্যমে সমাজ থেকে যাবতীয় অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্য দূর করে, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। সমাজতন্ত্রবাদীরা অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের আদর্শের সপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেন, প্রকৃত গণতন্ত্র একমাত্র সমাজতন্ত্রেই লক্ষ করা যায়। কারণ এখানে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র বিরাজমান। ল্যাস্কি ‘A Grammar of Politics’ গ্রন্থে বলেছেন, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন।
(vi) গণতান্ত্রিক জীবনাদর্শ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে গণতন্ত্র কেবলমাত্র একটি সামাজিক ব্যবস্থা নয় কিংবা অর্থনৈতিক আদর্শও নয়, গণতন্ত্র হল একটি জীবনাদর্শ বা জীবনযাপন পদ্ধতি। এই জীবনচর্চা বলতে মূলত গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, গণতান্ত্রিক চেতনা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং গণতান্ত্রিক আচরণকে বোঝায়। গণতান্ত্রিক জীবনাদর্শ বলতে বোঝায়, আলাপ-আলোচনার উপর নির্ভরশীলতা এবং যে-কোনো রকম বৈষম্যের অবসান, অন্যায়ের প্রতিবাদ, অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন প্রভৃতি।
আরও পড়ুন – জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর