আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
"উনিশ শো' বাহান্নর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি বুকে নিয়ে আজো সগৌরবে মহীয়সী।"
-কবি সামসুর রহমান
ভূমিকা
২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের ইতিহাসে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন। মাতৃভাষাপ্রেমিক সমস্ত মানুষের কাছে এ-দিন হল সংগ্রামের শপথের ও স্বীকৃতির এক উজ্জ্বল প্রতীক। বর্তমানে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সম্মানিত। মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপনের দিন। মাতৃভাষাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেবার জন্য অনুপ্রেরণা প্রেরণের দিন। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে নিবেদিত প্রাণ বরকত, রফিক, সালাম, জব্বার প্রমুখের উদ্দেশে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের দিন।
২১ ফেব্রুয়ারির ইতিবৃত্ত
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকারের নাগপাশ থেকে ভারতবর্ষ আশ্চর্যজনকভাবে দ্বিখন্ডিত হয়েছিল। জন্ম হয়েছিল নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের। তার ২টি অংশ-পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তান। অবিভক্ত বঙ্গভূমির ৬২% ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব-পাকিস্তান আর পাঞ্জাবের পশ্চিম অংশ সিন্ধু, বালুচিস্তান প্রভৃতি নিয়ে গঠিত পশ্চিম-পাকিস্তান। আয়তনের দিক থেকে পশ্চিম-পাকিস্তান বড়ো হলেও পূর্ব-পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি ছিল ও পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮% মানুষ ছিল বাংলাভাষী। সেজন্য দেশবিভাগের পূর্বে মহম্মদ শহীদউল্লাহর মতো পণ্ডিত ব্যক্তি বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য দাবি জানান। বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের পক্ষ থেকে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করা হয় যে, পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। কিন্তু, কার্যত তা হয়নি। পশ্চিম-পাকিস্তানের উর্দুভাষী রাষ্ট্রপ্রধানদের ইচ্ছানুসারে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানের ছাত্র, শিক্ষক প্রথম থেকেই সোচ্চার হন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। কিন্তু, ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি খান জানিয়ে দেন যে, বাংলা নয়, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণার প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন ভয়ানক রূপ ধারণ করে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে। পূর্ব-পাকিস্তানের নানান স্থানে বিক্ষোভ ও ধর্মঘট সফল হল। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সমগ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি প্রতিবাদসভার আয়োজন করা হয়। এদিকে ঠিক আগের দিন বিকাল থেকে সভাসমাবেশের বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশ জারি করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি সেই নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল বের করে। পুলিশ লাঠি চালায়, কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে, কিন্তু ছাত্রদল পিছু না হটায় পুলিশবাহিনী নির্মমভাবে গুলি চালায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বরকৎ, সালাম, জব্বার, রফিকুল প্রমুখ ছাত্রগণ।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য
২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার যে মহান উদ্যোগ UNESCO-র পক্ষ থেকে গৃহীত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বিশ্বের প্রতিটি দেশে, প্রতিটি মানুষের কাছে আপন মাতৃভাষা পরম সমাদরযোগ্য। মাতৃভাষাই হল আত্মপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম। মাতৃভাষার অপমান সহ্য করা আত্মঅবমাননার নামান্তর। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব সকল দেশের ও মানুষের।
উপসংহার
বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার উৎসাহ লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে মনে রাখা উচিত, এই উৎসাহ যেন কেবলমাত্র তিথি পালনের প্রথায় পর্যবসিত না হয়। কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপনই এই দিনটিকে স্মরণ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তাই দিনটিকে তখনই আমরা প্রকৃত অর্থে সম্মান জানাতে পারব, যখন আমরা নিজের মাতৃভাষার শ্রীবৃদ্ধি সাধনে তৎপর হয়ে উঠব। খুবই পরিতাপের বিষয়, কোনো-কোনো স্থানে মাতৃভাষা এখনও উপেক্ষিতা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হল সেই উপলক্ষ্য কাটিয়ে ওঠার দিন। এই দিনটিকে আমরা মাতৃভাষার গৌরব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্মরণ করব-
"আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি আমি কী ভুলতে পারি?" আরও পড়ুন - রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর