প্রাকৃতিক দুর্যোগে ছাত্রসমাজের ভূমিকা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা
"মানুষ বড়ো কাঁদছে তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও মানুষই ফাঁদ পাতছে তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও।"
-নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত মানুষ যখন অসহায়ভাবে টিকে থাকে তখন তাদের পাশে থাকাটাই মনুষ্যত্ব, দুঃখ-যন্ত্রণার বালুচরে অসহায় একাকীজনের দিকে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়াই জীবনের ধর্ম। প্রকৃতি যখন রুদ্ররূপে ধ্বংসের লীলায় মত্ত হয়ে ওঠে তখন জীবন হয় বিপন্ন। বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ের ধস-প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার ও রুদ্ররূপের কত-না পরিচয় পেয়েছে পৃথিবীর মানুষ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতিতেই মানবিক ভাবনার একান্ত প্রয়োজন, যা জীবনপথের দিশাস্বরূপ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের নানারূপ
আমাদের দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য বহু ধরনের দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়; যেমন-বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস (সুনামি), আয়লা ইত্যাদি। প্রবল বৃষ্টির ফলে নদী তার নিজের স্বাভাবিক গতিপথে জল ধরে রাখতে না পারলে সেই নদীর জল দুকূল ছাপিয়ে প্লাবিত হয়-সৃষ্টি হয় বন্যা। নদীমাতৃক দেশে ভৌগোলিক কারণে বন্যা প্রায় প্রতি বছরেই দেখা যায়। আবার, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম পরিমাণ বৃষ্টি হলে বা বহুদিন ধরে বৃষ্টি না-হলে যে অস্বাভাবিক শুষ্ক অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাকেই খরা বলা হয়। ক্রান্তীয় এবং নাতিশীতোয় অঞ্চলে সমুদ্রের ওপরের বাতাস প্রচণ্ড উত্তাপে দ্রুতগতিতে ওপরের দিকে উঠে যায়, ফলে সেখানে একটি নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। তখন সেই নিম্নচাপ কেন্দ্রের চারপাশের বায়ু সেই জায়গা পূরণ করার জন্য ছুটে আসে-একেই ঘূর্ণিঝড় বলা হয়। আবার, পৃথিবীর ভূত্বকের হঠাৎ কেঁপে ওঠাকে ভূমিকম্প বলে অভিহিত করা হয়। হড়কা পাথরের স্তূপ অথবা ধ্বংসাবশেষ যা নিজেদের ভারে ঢাল বেয়ে নেমে আসে, তাকেই আমরা ধস বলে অভিহিত করি। নদীমাতৃক অঞ্চলসমূহ বন্যাপ্রবণ এলাকা, পশ্চিমবঙ্গের রাঢ়বঙ্গ খরাপ্রবণ এলাকা, পাহাড়ি অঞ্চলগুলি ধসপ্রবণ এলাকা, ভারতের পূর্ব উপকূল জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ এলাকারূপে চিহ্নিত।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের নানা কারণ
বিশ্ববিধাতার অমৃতময় সৃষ্টি প্রকৃতিকে আমরা বিভিন্নভাবে বিপর্যস্ত করে চলেছি শতকের পর শতক। বিজ্ঞানের যুগে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির স্বাভাবিক অবস্থাকে আমরা নিজেদের প্রয়োজনে ও স্বার্থে ব্যবহার করে চলেছি। ফলে প্রকৃতি হারিয়েছে তার মৌলিক অবস্থা, নানাভাবে প্রকৃতিও রুদ্ররোষে তার বিপন্নতাকে প্রকাশ করছে।
ক। অতিরিক্ত গাছ কেটে ফেলার জন্য বাতাসে জলীয় বাষ্প জোগানের পরিমাণ অত্যধিক কমে যায়। এর ফলে বৃষ্টিপাত কম হয়, তখনই খরা দেখা দেয়। এ ছাড়া, নগরোন্নয়ন এবং কলকারখানার নানা দূষণের জন্য স্থানীয়ভাবে উদ্বুতা বাড়তে থাকে, এই অতিরিক্ত উন্নতা খরা সৃষ্টি করে।
খ। পাহাড়ি অঞ্চলে দুর্বল পাহাড়ি ঢালে নিয়ম না মেনে রাস্তাঘাট তৈরি এবং বাড়িঘর বানানোর কারণে পাহাড়ি ধসের সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া, অরণ্য ধ্বংসের ফলে ধসের সৃষ্টি হয়।
গ। নদীর গতিপথ পরিবর্তন, সময়মতো নদীসংস্কার না-করা, যত্রতত্র বাঁধনির্মাণ বন্যা পরিস্থিতিকে ত্বরান্বিত করে।
ঘ। মাটির নীচে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে ভূত্বকে কম্পন অনুভূত হয়। পাহাড়ে ধস নামলেও ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৫। ঋতু পরিবর্তন ও বিশ্ব উন্নায়নের ফলস্বরূপ পৃথিবীর বুকে বারেবারে আছড়ে পড়ে কখনো সুনামি, কখনো আয়লা, কখনোবা পিলিন।
বিপর্যয়ে ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত আইন
২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে ‘জাতীয় বিপর্যয়-ব্যবস্থাপনা’ সংক্রান্ত আইন চালু হয়। এর পরিভাষাগত নাম “Disaster Management Act, 2005″। এই আইনের বলে বিপর্যয়-ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত বিভিন্ন সরকারি সংস্থা গঠন করা হয়, যেগুলি বিপর্যয়-ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সমস্ত কার্যকলাপের দায়িত্বে থাকবে। জাতীয় স্তরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গঠিত হয় ‘জাতীয় বিপর্যয় ব্যবস্থাপন নির্ণায়ক’ (Na- tional Disaster Management Authority), বিপর্যয়সংক্রান্ত গবেষণা ও শিক্ষার জন্য গঠিত হয় ‘জাতীয় বিপর্যয়-ব্যবস্থাপন’ (National Institute of Disaster Management) সংস্থা। রাজ্যস্তরে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গঠিত হয় “রাজ্য বিপর্যয়-ব্যবস্থাপন নির্ণায়ক” (State Disaster Management Authority)। জেলাস্তরে ‘জেলা বিপর্যয়-ব্যবস্থাপন নির্ণায়ক” (District Disaster Management Authority) গঠিত হয়।
বিপর্যয় মোকাবিলায় ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা
প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা থাকতে পারে। সরকারি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীরাও বিভিন্ন ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। যেমন-
ক। বিপন্ন মানুষের কাছে তারা সাহায্য পৌঁছে দিতে পারে।
খ। উদ্ধারকারী দলকে সহায়তা দান করতে পারে।ক
গ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর এলাকা যাতে দূষিত না হয় সেদিকে জনগণকে তারা সচেতন করতে পারে।
ঘ। দরকারি কাগজপত্র ও মূল্যবান সামগ্রী যাতে নষ্ট না-হয় সে বিষয়ে তারা দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে।
ঙ। বিপর্যয়-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বৈদ্যুতিক প্রবাহ অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটায়। সে বিষয়ে তারা সাবধানতা ও সতর্কতা গ্রহণে সাহায্য করতে পারে।
চ। বিপন্ন মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা এবং পুনর্বাসনের জন্য সরকারি স্তরে যোগাযোগ করতে পারে।
ছ। নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস যাতে না হয় সেজন্য তারা জনগণকে সচেতন করতে পারে। বনসৃজন প্রকল্প রূপায়ণ করতে পারে।
উপসংহার
যদিও প্রকৃতির খেয়ালখুশির কাছে আমরা অনেকটাই অসহায় তবুও প্রকৃতির ধ্বংসসাধন ক্রমশ আমাদের ঠেলে দিচ্ছে চরম বিপন্নতার দিকে। বিশিষ্ট কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন-
“আজ যাকে বলো বনভূমি তাকে জনভূমি বলো কাল।”
-আধুনিক সভ্যতার পাদপীঠে দাঁড়িয়ে আমরা বনভূমিকে জনভূমিতে পরিণত করে চলেছি বলেই প্রাকৃতিক দুর্যোগও আমাদের পিছনে ধাওয়া করেছে ঘাতকের বেশে। অতি দ্রুত সচেতনতা না বাড়াতে পারলে আমাদের দাঁড়াতেই হবে ধ্বংসের মুখোমুখি। নবীন শিক্ষার্থীদের দায়িত্বই যে সবচেয়ে বেশি।
আরও পড়ুন –
১। পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
২। পরিবেশ রক্ষায় অরণ্য – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
৩। পরিবেশ বনাম উন্নয়ন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
৪। বিশ্ব উষ্ণায়ন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
৫। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
৬। মানবজীবনে পরিবেশের প্রভাব – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
৭। বিজ্ঞানচেতনার প্রসারের প্রয়োজনীয়তা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
৮। বিজ্ঞানচেতনা ও কুসংস্কার – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
৯। কম্পিউটার ও আধুনিক জীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
১০। খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
১১। দেশভ্রমণ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
১২। রক্তদান জীবনদান – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
১৩। বিজ্ঞাপন ও দৈনন্দিন জীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা