তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের বিষয়বস্তু
সত্যিকারের যোগাযোগ হলে হঠাৎ দিনযাপনের গ্লানিতে হাঁফিয়ে ওঠার ফাঁকে, অবসরমতো কারও সুযুক্তিতে যদি মাছ ধরার সহজ সুযোগের পরামর্শ পান, তবে আপনারাও তেলেনাপোতা আবিষ্কার করতে পারেন। কিংবা আপনার যদি মাছ ধরার সামান্য অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলেও আপনি পারেন।
এ আবিষ্কারের একান্ত বাসনা হলে আপনাকে একদিন ভিড়ে ঠাসাঠাসি এক বাসে গিয়ে উঠতে হবে এবং অভিযানশেষে একসময় আপনাকে হঠাৎই পথে নেমে পড়তে হবে। সেই পথের একপাশে জলা, তার উপর জীর্ণ সেতু। বাস আপনাকে নামিয়ে চলে গেলে দেখবেন জঙ্গলের অন্ধকার স্থানটিকে দখল করে বসে আছে। জনমানব নেই, পাখিও উধাও, আবহাওয়া ভ্যাপসা। জলাটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কাদাজলের নালার মতো রাস্তা বনজঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে। আপনার হয়তো জন দুই সঙ্গী আছে। আপনারা যখন পথসন্ধানী; দেখবেন প্রকৃতির আলো যেন নিভে আসছে, অন্যদিকে আবার মশার উপদ্রব। ফিরে যাবেন কি না যখন ভাবছেন তখন জঙ্গলের মধ্য থেকে বিচিত্র শব্দ জেগে উঠবে, দেখবেন আবছা আঁধার ভেদ করে ধীরগতিতে বামনাকৃতি এক গোরুর গাড়ি বেরিয়ে আসছে। আপনারা সেই সংক্ষিপ্ত স্থানের গাড়ির ছইয়ের ভিতর অতি কষ্টে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করবেন। গাড়িটি আপনাদের নিয়ে ফিরতি পথে জঙ্গলের রাস্তায় চলতে শুরু করবে ধীর-মন্থর গতিতে। আপনারা ভাববেন পরিচিত পৃথিবীকে দূরে রেখে যেন অন্য কোথাও এসে পৌঁছেছেন; সময় যেখানে স্তব্ধ, স্রোতহীন। হঠাৎ একসময় আপনাদের আচ্ছন্নতা ভঙ্গ করে গাড়োয়ান ক্যানেস্তারার তীক্ষ্ণ আওয়াজ করবে। এর কারণ ব্যাখ্যায় সে জানাবে-‘এজ্ঞে, ওই শালার বাঘ খেদাতে।’ এ বাঘ যে বন্য চিতা, তা জানার পর আপনাদের মনে হবে, মহানগরী থেকে এত স্বল্প দূরত্বে বাঘের অস্তিত্ব সম্ভব কি না! আকাশে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়িষু চাঁদ। গাড়ি একটা ছায়াচ্ছন্ন বড়ো মাঠ পেরোতে থাকবে, গাড়ির গতিতে মৌন সব প্রহরীর মতো প্রাচীন অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ পিছনে সরে যেতে থাকবে। মনে হবে কোনো অজানা স্মৃতিলোকে এসে পড়েছেন বোধহয়। রাত্রির অপরিমেয়তায় আপনি ভাববেন, এ রাত বুঝি অফুরন্ত। গাড়ি থামলে আপনারা নামবেন আড়ষ্টতা ভেঙে। পুকুরের পচা পানার একটা কটুগন্ধ নাকে এসে লাগবে। অনতিদূরে আবছা যে ভগ্ন অট্টালিকা দাঁড়িয়ে আছে তাকে মনে হবে ছায়াচ্ছন্ন দুর্গপ্রাকার।
এই ধ্বংসাবশেষের এককোণে আপনাদের স্থান হবে। গাড়োয়ানই একটা মৃদু আলোর লণ্ঠন ও কলশিভরা জল রেখে যাবে সেখানে। উক্ত কক্ষে আপনারাই যে বহুদিন পর প্রথম প্রবেশ করলেন তা সহজেই বুঝতে পারবেন ঝুল, ধুলো, জঞ্জাল ও ভ্যাপসা চাপা গন্ধে। সামান্য পায়ের চাপে পলেস্তারা খসে যাবে, চামচিকেরা রুদ্ধকক্ষের দখল নিয়ে বিবাদ শুরু করবে।
আপনার দুই বন্ধুর একজন পানরসিক, একজন নিদ্রাবিলাসী। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই একজনের নাকডাকার শব্দ শোনা যাবে ও দেখা যাবে অন্যজন পানপাত্রে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছে। ক্রমে রাত বাড়লে মশাদের মিছিল শুরু হবে আপনাদের রক্তে ম্যালেরিয়ার চাষ করার জন্য। দুই অচেতন বন্ধুকে রেখে তাই আপনি ভগ্নপ্রায় সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠার চেষ্টা করবেন। এ আকর্ষণ যেন দুর্বার। ছাদের ফাটলে ফাটলে অরণ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেকটাই। তবুও মোহময় ও সুষুপ্তিমগ্ন মায়াপুরীর কোথাও রূপকথা যে বাসা বেঁধে আছে, তা আপনি টের পাবেন। ভগ্নস্তূপের ওপারে একটি জানালার ক্ষীণ আলোর রেখায় আপনি দেখবেন বাতায়নবর্তিনী এক ছায়ামূর্তিকে। দেখেও মনে হবে এ যেন দেখার ভ্রম। বুদ্বুদের মতো সেই দৃষ্টিবিভ্রমও একসময় রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে। আপনিও নীচে নেমে নিদ্রাকাতরতায় ডুবে যাবেন।
পরদিন নিজ উদ্দেশ্যসাধনের জন্য আপনাকে বসতে হবে পুকুরঘাটে। প্রকৃতির ওড়নায় ফুটে উঠবে নিসর্গের নিজস্বতা। আপনি দেখবেন মাছরাঙা ঝুপ করে জলে ঝাঁপিয়ে হঠাৎ শিকারি হয়ে উঠছে। একটা সাপ পরম নিশ্চিন্তে গুঁড়ি-পানার আস্তরণ সরিয়ে সাঁতরে ওপারে গিয়ে উঠছে। দুটি ফড়িং আপনার ছিপের ফাতনায় বসার জন্য প্রতিযোগী। ঘুঘুর ডাক আপনাকে আনমনা করে দেবে। হঠাৎ আপনি জলের শব্দে চমকে উঠে দেখবেন; জল ঢেউয়ে দুলছে, ফাতনাও দুলছে। একটি মেয়ে পানা সরিয়ে ঘড়ায় জল তুলছে। যার চোখে কৌতূহল কিন্তু গতিবিধি আড়ষ্টতাহীন, সে সোজা চোখে আপনাকে দেখছে। আপনি বুঝবেন এর বয়সের কোনো হদিস নেই, কৈশোর অতিক্রান্ত অপরিচিতার যৌবন প্রবেশে যেন স্থগিতাদেশ পড়ে গিয়েছে। মেয়েটি হঠাৎই আপনাকে বলবে-“বসে আছেন কেন? টান দিন।” এই অযাচিত আলাপনে আপনি যে বিব্রত হবেন না তার কারণ মেয়েটির কণ্ঠের শান্ত-মধুর গাম্ভীর্য। আপনি ছিপে টান মারবেন, দেখবেন বড়শি টোপহীন। ব্যাপার দেখে মেয়েটি মৃদু অথচ দীপ্ত হাসি উপহার দিয়ে চলে যাবে।
আপনার আর মাছ ধরায় উৎসাহ থাকবে না। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সামান্য ঘটনাটাকে অবান্তর মনে করেও আপনি ওরকম একটি মেয়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে হঠাৎ সংশয়ী হয়ে উঠবেন। ঘরে ফিরে গিয়ে শুনবেন, আপনার মৎস্যশিকার অভিযানের ব্যর্থতার ইতিকথা, ওই মেয়েটি ইতিমধ্যে প্রচার করেছে সঙ্গীদের মধ্যে। আপনি এ ব্যাপারে কৌতূহলী হলে আপনার পানাসক্ত বন্ধু জানাবে-“এইমাত্র যামিনী নিজের চোখে দেখে এল যে!” আপনার কৌতূহলে ক্রমে যামিনীর পরিচয় উদ্ঘাটিত হবে। আপনি জানবেন-সে আপনার পানাসক্ত বন্ধুর জ্ঞাতিস্থানীয়া। শুনবেন আপনাদের সেদিনকার দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা যামিনীদের গৃহেই হয়েছে। আপনি গত রাতের বাতায়নবর্তিনী ছায়াচারিণীকে চাক্ষুষ করে পীড়িত হবেন। আপনার রাতের স্বপ্নকল্পনা যেন দিনের রূঢ়তায় কেমন কুৎসিত মনে হবে।
আহার করতে গিয়ে আপনি দেখবেন আয়োজন যৎসামান্য, পরিবেশন করছে যামিনী। তার মুখের পূর্বদৃষ্ট করুণ গাম্ভীর্য আরও প্রকটভাবে আপনার চোখে পড়বে। মনে হবে এই পাণ্ডববর্জিত ধ্বংসাবশেষের মৌন বেদনাই যামিনীর মুখে দৃষ্ট, যা একদিন বুঝি এই ধ্বংসযজ্ঞেই সমাহিত হয়ে যাবে। কর্মরত যামিনীকে কাজের মধ্যেও আপনার চঞ্চল ও উদ্বিগ্ন মনে হবে। উপর ঘর থেকে একটা ক্ষীণ কণ্ঠ শুনেই বারবার যামিনী ব্যস্তসমস্তভাবে বাইরে যাবে-আসবে। একবার সে মরিয়া হয়ে যেন আপনার পানাসক্ত বন্ধুকে ডাকবে-“একটু এখানে শুনে যাও মণিদা।” তিনি কাছে গেলে শুনবেন যামিনী নিম্নস্বরে তাকে কী যেন বলছে। তার একটু অংশ-“মা তো কিছুতেই শুনছেন না। তোমাদের আসার খবর পাওয়া অবধি কী যে অস্থির হয়ে উঠেছেন কি বলব!” মণি বিরক্ত হবে। মণি-যামিনীর আলাপন থেকে আপনি জানতে পারবেন-যামিনীর মা অতিবৃদ্ধা, অন্ধ। তিনি মনে করেছেন তাঁর দূরসম্পর্কের বোনপো নিরঞ্জন এসেছে- অথচ তাঁকে দেখা দিচ্ছে না। তাই তিনি ব্যাকুল। ছেলেবেলায় তিনি যামিনীর সঙ্গে নিরঞ্জনের বিয়ে ঠিক করেন। বছর চারেক আগেও সে তাকে কথা দিয়েছিল, বিদেশের চাকরি থেকে ফিরে তার মেয়েকে বিয়ে করবে। বৃদ্ধা তারই দিন গুনছে।
আসল ঘটনা এই-নিরঞ্জন কোনোদিনই বিদেশ যায়নি। নাছোড়বান্দা বৃদ্ধাকে সে প্রতারণা করেছিল। অথচ এই নির্মম সত্যটা কেউ তাঁকে বলতে পারছে না, কারণ তিনি তা সহ্য করতে পারবেন না। অগত্যা কর্মভোগ সারতেই যেন মণি উপরে যাওয়ার সিঁড়িতে পা রাখে। আপনিও উঠে দাঁড়ান, বলেন- “চলো আমিও যাব।” মণি অবাক হয়। উপরের ঘরে গিয়ে আপনি দেখেন ভাঙা তত্ত্বাপোশে ছেঁড়া কাঁথা বিজড়িত এক কঙ্কালমূর্তি, পাশে দণ্ডায়মান পাথরবৎ যামিনী। কঙ্কালমূর্তি আপনাদের পদশব্দে চঞ্চল হয়ে প্রশ্ন করবে- “কে, নিরঞ্জন এলি?” তাঁর বক্তব্য শেষ হওয়ার পর মণি কিছু বলার আগেই আপনি হঠাৎ বলবেন-“না মাসিমা, আর পালাব না।” আপনার কথায় মণি এবং যামিনী স্তম্ভিত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবে। মাঝখানের অনেকটা সময় নির্বাক বিস্ময়ে কেটে যাওয়ার পর বৃদ্ধা ক্ষীণ কণ্ঠে বলবেন- “আমি জানতাম, তুই না এসে পারবি না বাবা। তাই তো এমন করে এই প্রেতপুরী পাহারা দিয়ে দিন গুনছি।” যামিনী যে অন্তরে বিগলিত হচ্ছে আপনি তা বুঝতে পারবেন। বৃদ্ধা আবারও যামিনীকে গ্রহণ করার প্রস্তাব দিলে অশ্রুসজল কণ্ঠে আপনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন।
এবার আপনাদের ফেরার পালা। বিদায়বেলায় যামিনী আপনার ফেলে যাওয়া ছিপের কথা স্মরণ করালে আপনি পুনরায় তেলেনাপোতায় ফিরে আসার কথা জানাবেন। যামিনীর সকৃতজ্ঞ হাসি হৃদয়ে মেখে আপনি চলে আসবেন। গাড়ির সংকীর্ণতার মধ্যেও আপনার হৃদয়ে বারবার ধ্বনিত হবে-“ফিরে আসব।” ফিরে আসার কালে আপনার হৃদয়ে তেলেনাপোতার যে স্মৃতি থাকবে অত্যুজ্জ্বল, ক্রমে তা ফিকে হতে শুরু করবে। হঠাৎ যেদিন
ফিরে যাওয়ার বাসনা আপনার মধ্যে তীব্রতর, সেদিন দেখবেন ম্যালেরিয়ার নিঃশব্দ আক্রমণে আপনি শয্যাশায়ী। ডাক্তার বলবেন- ‘ম্যালেরিয়াটি কোথা থেকে বাগালেন?’ আপনি জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে যাবেন।
তারপর একদিন আবিষ্কার করবেন রোগভোগের ক্লান্তি ও দেহমনের ক্ষয়ে তেলেনাপোতার স্মৃতিও ঝাপসা অবাস্তব হয়ে গিয়েছে। যামিনীকে মনে হবে কুয়াশার কল্পনা মাত্র। আর “একবার ক্ষণিকের জন্যে আবিষ্কৃত হয়ে তেলেনাপোতা আবার চিরন্তন রাত্রির অতলতায় নিমগ্ন হয়ে যাবে।”
আরও পড়ুন – আগুন নাটকের বড়ো প্রশ্ন উত্তর