বিশ্ব উষ্ণায়ন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
"এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার"-
এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে তোলার অঙ্গীকার ধ্বনিত হয়েছে কবিকণ্ঠে। যে শিশুর মধ্যে লুকিয়ে আছে জাতির ভবিষ্যৎ সেই শিশুর বাসভূমি এই পৃথিবী যেন ক্রমশ অগ্নিপিন্ডে পরিণত হচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাতে হাত মিলিয়ে মানুষ পরিবেশের বিশুদ্ধতাকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে। বেশ কিছুকাল ধরেই আমাদের বাসযোগ্য পরিবেশ ভয়ঙ্কর এক যান্ত্রিক আগ্রাসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, পরিবেশের সর্বত্রই মাত্রাতিরিক্ত দূষণ, আর এই দূষণের অন্যতম ফল বিশ্ব উন্নায়ন। একবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষ পৌঁছে আমাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে। বিশ্ব উন্নায়ন কি একদিন সমস্ত পৃথিবীকে গ্রাস করে পৌঁছে দেবে ধ্বংসের মুখে।
বিশ্ব উষ্ণায়ন বলতে কী বোঝায়
সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত থেকে জানা যায় যে, পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিশ্ব উষ্ণায়ন নামে পরিচিত। সভ্যতার সূর্যস্নাত প্রাতে পৃথিবীর তাপমাত্রা ছিল অতিমাত্রায় উত্তপ্ত। পরবর্তী সময়ে বিবর্তনের ধারা বেয়ে পৃথিবী ক্রমশ শীতল হল-দেখা দিল প্রাণের স্পন্দন। কিন্তু বিজ্ঞাননির্ভর সভ্যতা প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দকে ব্যাঘাত করল। মানুষ মরু থেকে মেরুতে অভিযান চালিয়েছে, বিজ্ঞানের শতধারা পল্লবিত হয়েছে আর বাসযোগ্য পৃথিবী ক্রমশ হারিয়েছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। আর এসবের মিশ্র ফল বিশ্ব উষ্ণায়ন।
বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণসমূহ
আবহবিজ্ঞানীদের মতে, পরিবেশ দুষণের কারণেই আজ বিশ্ব উষ্ণায়ন আমাদের চরম উদ্বেগের বিষয়। গ্রিন হাউস প্রভাব বাড়িয়ে দিচ্ছে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা। গ্রিন হাউস গ্যাসগুলি হল কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন, ওজোন গ্যাস, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন প্রভৃতি। অশুভ এই সমস্ত গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ ক্রমাগত ব্যাপকভাবে পরিবেশকে দূষিত করে। তুষারপ্রদেশে যে অভিযাত্রী দল অভিযান চালায় তাদের মশালের আগুন সেখানকার শীতলতা নষ্ট করে এবং কোনো-কোনো ক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবহারসামগ্রী প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে বিনষ্ট করে। এভাবেই বিশ্ব উষ্ণায়ন ক্রমশ পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
ফলাফল
গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলাফল খুবই মারাত্মক হতে পারে। একদিন হয়তো বা পৃথিবীর জীবকুল পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। খুব দ্রুতলয়ে গ্রিনল্যান্ড বা মেরুসাগরের বরফও গলতে শুরু করবে। সমুদ্রের জলের উচ্চতা ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী বহু নগর ও জনপদ পুরোপুরি জলমগ্ন হবে। পরিবেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হলে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হবে ইকোসিস্টেম বা বাস্তুরীতি। কোথাও বা প্রবল খরা আবার কোথাও বা বন্যা দেখা দিতে পারে। বড়ো মাপের ভূমিকম্প হয়তো বা কোনো সুবৃহৎ অঞ্চলকে ধ্বংস করে দিতে পারে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ফলে প্রকৃতির স্বাভাবিক শক্তি ধ্বংস হওয়ার কারণে বিভিন্ন ধরনের জটিল ও মারণান্তিক অসুখের মাত্রাতিরিক্ত প্রকোপ দেখা দিতে পারে।
প্রতিকারের উপায়
বিশ্ব উষ্ণায়ন যেভাবে আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে তাতে আমরা যদি সচেতন না হই, তবে শেষের সেদিন আর বেশি দূরে নেই। সরকারি উদ্যোগে, সরকার অধিগৃহীত সংস্থাগুলির প্রয়াসে, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এবং জনগণের নিজস্ব সচেতনতায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে-
- ক। প্রচুর পরিমাণে পাতাওয়ালা গাছ লাগাতে হবে।
- খ। প্রচলিত শক্তিগুলি যথা-কয়লা, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতির ব্যবহার কমাতে হবে এবং অপ্রচলিত শক্তিগুলি। যথা-সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি প্রভৃতির ব্যবহার অতিমাত্রায় বাড়ানোর প্রয়োজন।
- গ। বনসৃজন প্রকল্পর যথাযথ প্রয়োগ ও বিস্তার ঘটাতে হবে, কোনো কারণেই নির্বিচারে গাছপালা ধ্বংস করা যাবে না।
- ঘ। যেসমস্ত গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর অন্যতম কারণ সেগুলির উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
- ৪। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ গ্রিনহাউস প্রভাব সম্পর্কে অজ্ঞ-সেই অজ্ঞতা দূর করতে হবে।
- চ। সমুদ্র ও নদী উপকূলবর্তী অঞ্চলের কলকারখানার ধোঁয়া বা আবর্জনা যাতে ব্যাপক জলদূষণ না ঘটাতে পারে, সেজন্য আইনত সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
উপসংহার
পৃথিবীর নানাপ্রান্তে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্যাপিত হয় মহাসমারোহে কিন্তু আমরা সচেতনভাবেই পরিবেশকে দূষিত করে তুলি। সুস্থ জীবন ও পৃথিবীর জন্য প্রয়োজন যে গভীর সচেতনতা তা আমাদের সকলের কতটা আছে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে প্রতিটি রাষ্ট্রকে। প্রকৃত অর্থেই ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা যে বিষে বিষে আজ জর্জরিত-এ আকাশ, এ বাতাস সেই দারুণ বিষক্ষয় থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে প্রকৃতিকে করে তুলতে হবে দূষণহীন। তবেই বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং থাবা বসাতে পারবে না বসুন্ধরার কোমল মাটিতে।
আরও পড়ুন –
১। পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
২। পরিবেশ রক্ষায় অরণ্য – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
৩। পরিবেশ বনাম উন্নয়ন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা