লালন শাহ্ ফকিরের গান কবিতার বিষয়বস্তু ও নামকরণের তাৎপর্য
লালন শাহ্ ফকিরের গান কবিতার কবি পরিচিতি
জন্ম ও বংশ পরিচয়: বাউল সাধনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাধক এবং বাউলগানের কালজয়ী স্রষ্টা ছিলেন লালন ফকির। তাঁর জন্মস্থান, জন্মকাল, ধর্মমত এবং জাতি পরিচয় নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য আছে। প্রচলিত মতানুসারে, ১৭৭৪ সালে পূর্বতন নদিয়া জেলার ছাপড়া, বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কামারখালির কাছে ‘গোরাই’ নদীর তীরবর্তী ভাঁড়ারা গ্রামে এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে লালন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল মাধব কর, জননী পদ্মাবতী। অপর মতানুযায়ী, যশোহর জেলার ঝিনাইদহের হরিশপুর গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। পাশাপাশি অনেকে ধারণা করেন, যশোর জেলার ফুলবাড়ি গ্রামের মুসলমান পরিবারের সন্তান ছিলেন লালন।
বাল্য ও যৌবনকাল: অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান লালন শৈশবেই পিতৃহারা হন। নিদারুণ দারিদ্র্য ও অসহনীয় আর্থিক কষ্টের মধ্যে বড়ো হতে হয় তাঁকে। পারিবারিক ভয়ংকর প্রতিকূল পরিস্থিতি ও আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্যের কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে পারেননি। তিনি ছিলেন নিরক্ষর। অল্পবয়সে বিবাহের পর প্রতিবেশী এবং জ্ঞাতিকুটুম্বদের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় লালন বিধবা জননী এবং স্ত্রীকে নিয়ে ভাঁড়ারা গ্রামের অভ্যন্তরেই দাসপাড়ায় বসবাস করতে থাকেন।
জনশ্রুতি আছে, বিবাহের পর তীর্থযাত্রায় গিয়ে লালন প্রত্যাবর্তনকালে মারণ বসন্তরোগে আক্রান্ত হন। দুরন্ত ব্যাধির প্রকোপে অসাড় লালনকে সহযাত্রীরা মৃত ভেবে শাস্ত্রমতে মুখাগ্নি করে গঙ্গাবক্ষে ভাসিয়ে দেয় এবং ঘরে ফিরে আসে।
এদিকে মুমূর্ষু লালনের অচৈতন্য দেহ ভাসতে ভাসতে এক নদীঘাটে এসে উপস্থিত হয়। যেখানে এক তন্তুবায় মুসলিম রমণী লালনকে নিজগৃহে নিয়ে আসেন এবং অতি যত্নে সেবা-শুশ্রুষা করে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তোলেন। এভাবে মুসলমান দম্পতির আপ্রাণ চেষ্টায় নবজীবন লাভ করেন লালন।
আরোগ্যলাভের পর লালন নিজ স্ত্রী এবং জননীর কাছে ফিরে গেলে, মুসলমান পরিবারের সান্নিধ্যে থাকার অপরাধে তাঁকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ফকির ধর্মগ্রহণ ও বাউলসাধনা: গ্রাম থেকে প্রত্যাখ্যাত লালন এরপর শাস্ত্রাচার, জাত-ধর্ম, সমাজসংস্কার সম্পর্কে স্বভাবতই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। এইসময় সিরাজ সাঁই নামে এক বাউল দরবেশের সঙ্গে লালনের সাক্ষাৎ হয়। সিরাজ সাঁই-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত লালন তাঁর সাধনকর্মে দীক্ষিত হয়ে ফকিরি ধর্মগ্রহণ করেন। এই ঘটনার কয়েক মাস পরে লালন কুষ্ঠিয়া জেলার নিকটবর্তী ছেঁউড়িয়া গ্রামে এসে বাউলসাধনার আখড়া গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের জমিদারি এলাকার নিষ্কর জঙ্গলের মধ্যেকার জমিতে নির্মিত আশ্রমেই আমৃত্যু সাধনভজনে নিরত থেকেছেন।
রচনাবৈশিষ্ট্য: লালন ছিলেন একজন মরমি স্বভাবকবি। গ্রামবাংলার মেঠো পথ দিয়ে যেতে যেতে তিনি একতারা হাতে নিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় মুখে মুখে গান বেঁধেছেন। প্রত্যেক ধর্মের প্রতিই তিনি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। তাই জাতপাত, সম্প্রদায় বিদ্বেষ এবং প্রথা-সংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন। বিশ্বনাগরিক লালন তাই হয়ে উঠেছেন শান্তি, সাম্য, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, কল্যাণ ও মানবতার মূর্ত প্রতীক।
বাউলরা ছিলেন সহজিয়া সাধক বা দেহাত্মবাদী। লালন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, বিশ্ববিধাতার অধিষ্ঠান কোনো ঊর্ধ্বলোকে নয়, মনের মন্দিরে। পার্থিব টান শূন্য হয়ে অন্তরের আলো দিয়েই তাঁর দর্শন মেলে। • জীবাত্মা মিলিত হয় পরমাত্মায়।
দেহের সীমার মধ্যেই লালন তাই অনন্ত অসীম মনের মানুষের সন্ধান করেছেন।
লালনমানসে তত্ত্বচিন্তার সঙ্গে দর্শনচিন্তার এক অপূর্ব যুগলবন্দি ঘটেছে। তিনি বলেছেন, কামগন্ধহীন শুদ্ধ প্রেমের পথ ধরেই সাধক প্রেমিককে ঐশী প্রেমের জগতে পৌঁছে যেতে হয়। লালন এসব গূঢ় তত্ত্বকথাকে সহজসরল ভঙ্গিতে গানের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
লোকসংগীতের এই বিশিষ্ট ধারা অর্থাৎ বাউলগানের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধক লালন ফকির বাউল পর্যায়ের প্রায় সকল শ্রেণি তথা দেহতত্ত্ব, মুর্শিদা, গুরুবাদী, বৈয়ব, দরবেশি ও মারফতি গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। উপমা-রূপক, পরিচিত চিত্রকল্প, প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচন এবং আটপৌরে জীবনে ব্যবহৃত শব্দচয়ন তাঁর গানগুলিকে কাব্যমাধুর্যমণ্ডিত করেছে। লালন সংগীতের সুরমাধুর্যরীতি, উপস্থাপনের পদ্ধতি এবং হৃদয়স্পর্শী আবেদন যেমন লালনগীতিকে স্বতন্ত্র মাত্রা দিয়েছে, তেমনই শ্রোতাকে বিমোহিত করেছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গানের অনুসরণে পরে বহু গান রচনা করেছিলেন।
অন্তিমকাল ও দেহাবসান: লালনের প্রায় দশ হাজার শিষ্য ছিল। বৃদ্ধ বয়সেও অশ্বারোহণে দক্ষ লালন ঘোড়ায় চড়ে শিষ্যদের বাড়ি যেতেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে ফকির শীতল শাহ্, ফকির ভোলাই শাহ্, ফকির মনিরুদ্দিন শাহ্, ফকির পাঁচু শাহ প্রমুখ ছিলেন তাঁর অত্যন্ত কাছের। অবশ্য জীবনের উপান্তে এসে উপার্জনহীন লালনকে তাঁর সুযোগ্য শিষ্যরা সযত্নে দেখাশোনা করতেন। জানা যায়, “পীড়িত অবস্থাতেও পরমেশ্বরের নামে পূর্ববৎ সাধন করিতেন, মধ্যে মধ্যে গানে উন্মত্ত হইতেন। ধর্মের আলাপ পাইলে নববলে বলীয়ান হইয়া রোগের যাতনা ভুলিয়া যাইতেন।… মরণের পূর্ব রাত্রিতেও প্রায় সমস্ত সময় গান করিয়া রাত্রি আটটার সময় শিষ্যগণকে বলেন, ‘আমি চলিলাম’। ইহার কিয়ৎকাল পরে শ্বাসরুদ্ধ হয়।” (হিতকরী পাক্ষিক পত্রিকা / ৩১ অক্টোবর, ১৮৯০)। তথ্যসূত্র: লালন সমগ্র/আবুল আহসান চৌধুরী।
১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর লালনের জীবনাবসান হয়। মৃত্যুর পর সাধকের উপদেশ অনুসারে কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের নিয়ম মেনে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়নি। কেবল ‘হরিনাম কীর্তন হইয়াছিল।’ আর ‘আখড়ার মধ্যে একটি ঘরে তাঁহার সমাধি হইয়াছে।’ বলে জানা যায়।
লালন শাহ্ ফকিরের গান কবিতার উৎস
পাঠ্য ‘লালন শাহ ফকিরের গান’ শীর্ষক গীতিকাটি ও মতিলাল দাশ ও স্ত্রী পীযূষকান্তি মহাপাত্র সম্পাদিত, ‘লালন গীতিকা’ মনের ৩৯১ সংখ্যক পদ। গ্রন্দের প্রকাশক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এই পদটি রবীন্দ্রনাথ সংগ্রহ করেছিলেন। বিশ্বভারতীর সংগ্রহে রক্ষিত লালনের দুটি গানের খাতাতেও এই গানটি রয়েছে।
লালন শাহ্ ফকিরের গান কবিতার প্রেক্ষাপট
বৈয়ব কবি চন্ডীদাস বলেছিলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য।’ অথচ মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেই মানুষ হওয়া যায় না। বাংলার বাউল সাধকদের বিশ্বাস মানবসেবাই মানুষ হয়ে ওঠার শ্রেষ্ঠ পথ। লালন সাঁই ছিলেন মানবতাবাদের মূর্ত প্রতীক। তিনি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে শান্তি ও বিশ্বাসের পথে চলতে শিখিয়েছিলেন। ধর্মীয় ও জাতিগত কারণে বাংলার জনসমাজ তখন ছিল বিভাজিত। সমাজের কদর্য বিভাজন দেখে লালনের অন্তরাত্মা কেঁদে ওঠে। তিনি ভাবতে থাকেন, মানুষের জন্য সমাজ, অথচ সাধারণ মানুষ সেখানে গুরুত্বহীন, ঘৃণার পাত্র। জাতি-ধর্মের জাঁতাকলে পিষে যাচ্ছে মানুষ। ভগবান আর আল্লাহকে খোঁজা হচ্ছে আচারসর্বস্বতার নিরিখে। সমাজের শোষণ, বঞ্চনা, অস্পৃশ্যতা, কুসংস্কার আর ধর্মের নামে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা ও হানাহানির বিরুদ্ধে লালন মনে মনে বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। ঈশ্বর সম্পর্কিত তৎকালীন ধারণা, মানুষকে মুক্তি দেওয়ার পরিবর্তে ক্রমশ অন্ধপ্রথার নাগপাশে আবদ্ধ করে দিচ্ছে। মানবিকতা প্রতিমুহূর্তেই লঙ্ঘিত হচ্ছে। কিন্তু একাকী লালন মানবতার পক্ষে লড়াইটা লড়বেন কী করে? শুরু করলেন সাধনা। মানুষকে নিয়ে মানুষের মুক্তির সাধনা। দ্বন্দ্ব- সংঘাতময় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ক্ষয়িষু মনুষ্যত্ব ও বিশ্বাসের অভাব যে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করেছে, সেই বিভেদের মূলে কুঠারাঘাত করল লালনের এক-একটি গান-
"সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে।। ভজ মানুষের চরণ দুটি নিত্য বস্তু পাবি খাঁটি।।”
গুরু সিরাজ সাঁই-এর পাদপদ্মে আশ্রয় লাভ করে লালন অনুভব করেছিলেন, মানুষের মধ্যেই রয়েছে শ্রেষ্ঠ মানুষ অর্থাৎ সৃষ্টির মধ্যেই রয়েছেন স্রষ্টা। অসাম্প্রদায়িক মানবতার নিশান ওড়ালেন তিনি।
লালনের গানে মনস্তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, মানবতত্ত্ব ছাড়াও নানা ধরনের যুক্তি, ব্যাখ্যা ও সূক্ষ্ম উপমা ফুটে উঠছে। লালন ধর্মীয় গণ্ডি থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন। দেহের ভিতরে আত্মার বাস। সেই আত্মার মাঝেই অবস্থান করেন লালনের মনের মানুষ, পরমপুরুষ ঈশ্বর। যেহেতু বাউলসাধনা গুরুমুখী, গুরু-শিষ্যের মিলনেই মনের মানুষের দেখা মেলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ লালন সাঁইয়ের গানেও যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে মানবিকতা, মনুষ্যত্বের অবক্ষয়ই সমাজসংকটের মূল কারণ।
তাই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও লালন সাঁই এবং তাঁর গান ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক।
লালন শাহ্ ফকিরের গান কবিতার বিষয়সংক্ষেপ
“মানুষ ভজে মানুষ ধর, মন, যাবি তুই ভব পার।”– পাঞ্জু শাহ
লালন ফকিরের বাউলগীতির অন্তরের কথা ছিল মানবপ্রেম। মানুষেরই মধ্যে। তাঁর ঈশ্বরসাধনার তথাকথিত ঈশ্বরকে তিনি খুঁজেছেন মূলে ছিল মানবসেবা। তাই সোনার মানুষ বা মানবশ্রেষ্ঠ হওয়ার একমাত্র পথ হল মানুষরূপী ঈশ্বরকে সন্ধান করা- এ কথা তাঁর গানগুলিতে ফিরে ফিরে এসেছে।
দেহবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত গুরুমুখী বাউলসাধনার বাস্তবিক আধার মানুষ। লালন ফকির বিশ্বাস করতেন- মানুষের গড, খোদা, আল্লাহ্, ভগবান সকলেই নিরাকার অবস্থায় আমাদের আপন ঘরে অর্থাৎ আত্মায় মিশে রয়েছেন। তাঁকে অন্যত্র খুঁজতে যাওয়া বৃথা। মানবপ্রেমের জাগরণে জন্মায় মনুষ্যত্ববোধ, তখন হয়ে ওঠা যায় সোনার মানুষ বা আলোকিত জন। তাই মানুষই উপাস্য হওয়া উচিত। মানুষের সঙ্গ ছাড়া সাধনা সম্পূর্ণ হয় না, সমাজও মূল্যবোধ হারায়। আর তার ফলে সমাজে মানবতাবোধের অবক্ষয় ঘটে, সমাজ হয়ে পড়ে ক্ষয়িষ্ণু। মনুষ্যত্ব হারালে মানুষকে মনুষ্যেতর হয়ে কাল কাটাতে হয়, যা কাম্য নয়।
বাউল সাধকের সাধনার বীজমন্ত্র হল-যা আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তা আছে দেহভাণ্ডে। এই দেহভান্ডের মধ্যেই তাঁদের অন্বেষণ পরমপুরুষের। বাউল বলছে, মানবদেহে রয়েছে সাতটি চক্র। সেই সাতটি চক্রের অন্যতম ‘আজ্ঞাচক্র’-টি রয়েছে মানুষের দুটি ভূ-র মাঝে- এটি দুই দলবিশিষ্ট। এই আজ্ঞাচক্রেই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়। এই আজ্ঞাচক্রেই জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটে। গুরুবাদী এই বাউলসাধনায় গুরুর নির্দেশেই আজ্ঞাচক্রে মনের মানুষের উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুভব করা যায়।
সত্যসন্ধানী, মরমি কবি, বাউল সাধক লালন সাঁইয়ের আজীবনের স্বপ্ন ছিল, মানুষের পৃথিবী হবে মানবধর্মের চারণক্ষেত্র। তাই মানুষের মধ্যে তিনি সন্ধান করেছেন অরূপরতন। ‘আত্মানাং বিদ্ধি’- আপন ঘরের আয়নাতেই মুখ দেখা যায় আরশিনগরের পড়শির। তাই সাধক বলছেন ‘মানুষে মানুষ গাথা।’ এখানে এক মানুষ বদ্ধজীব। অন্যজন পরমাত্মা। রক্তমাংসের মানুষই নিজের অন্তরে ধারণ করেছেন মনের মানুষকে। আলেক লতা বা স্বর্ণলতা যেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে মহিরুহকে, জীবাত্মা- পরমাত্মাও তেমনই একই দেহে অভিন্ন হয়ে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু সেই পরমাত্মার সাধনায় আমরা ভ্রান্ত পথকে বেছে নিই। তুচ্ছ আচার-অনুষ্ঠানে সময় ফুরিয়ে ফেলি। চেতনার আলো এসে মনকে বিশুদ্ধ না করলে পরমপুরুষ অবধি পৌঁছোয় না-তখন অদ্ভুত এক শূন্যতা গ্রাস করে আমাদের। মানুষকে ভালোবাসতে পারলেই এই কঠোর সাধনায় সিদ্ধিলাভ সম্ভব। মানুষ ভজনাতেই আলেখ পুরুষ বা অলক্ষের সেই নিরাকার মনের মানুষ সাকাররূপে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আর তাঁর সাক্ষাৎ পেলেই মানুষের মুক্তিলাভ হয়। মানুষ হয়ে ওঠে খাঁটি মানুষ বা সোনার মানুষ।
লালন শাহ্ ফকিরের গান কবিতার নামকরণ
ভূমিকা: নাম, নাম মাত্র নয়- সৃষ্টিশীল সাহিত্যের নামকরণের ক্ষেত্রে কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নামকরণ হল কোনো রচিত বিষয়ের প্রবেশদ্বার, প্রাথমিক পরিচয় কিংবা তার মর্মে আলোকপাতের মাধ্যমস্বরূপ। তাই নামকরণের ক্ষেত্রে বিষয়, কাহিনি বা ঘটনা, চরিত্র, ব্যঞ্জনা, আঙ্গিক, ভাব- প্রতিটি বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ।
পাঠ্য ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ শিরোনামাঙ্কিত কবিতাটি ‘লালন গীতিকা’ থেকে সংকলিত। গ্রন্থটির সব গীতিকাগুলিই শিরোনামহীন। শুধু সংখ্যামানে চিহ্নিত করা আছে। পাঠ্য গীতিকাটি ওই গ্রন্থের ৩৯১ সংখ্যক গীতিকা। লক্ষণীয়, গ্রন্থটির নামকরণের নীচে প্রথম বন্ধনী সহযোগে লেখা আছে ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’। এই ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ শিরোনামেই পাঠ্য কবিতাটির নামকরণ করা হয়েছে।
বিষয়বস্তু: মানুষকে উপাস্য করলে, ভালোবাসলে যথার্থ মনুষ্যত্ব অর্জিত হয় এবং নিজের মধ্যে আলোকিত প্রজ্ঞাবান মানুষ জেগে ওঠে। আর মানুষ হয়ে যদি মানুষকে ভজনা না করে উপেক্ষা করা হয় তাহলে মানুষ তার মূল অর্থাৎ মনুষ্যত্ব হারিয়ে মনুষ্যেতর জীবে পরিণত হয়। এই সুন্দর পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে গড়ে তুলতে হলে আমাদের মানুষকেই উপাসনা করতে হবে, ভালোবাসতে হবে-তাহলেই আমরা হয়ে উঠতে পারব প্রার্থিত আলোকিত মানুষ। সাঁইয়ের মতে, মানবদেহই বাউলসাধনার মূল ক্ষেত্র। আমাদের দেহে সাতটি চক্র আছে-যার মধ্যে ষষ্ঠ চক্রটি রয়েছে দুই ভূ-র মাঝখানে দ্বিদল পদ্মরূপে, যাকে বলা হয় আজ্ঞাচক্র। আজ্ঞাচক্রেই জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়। কিন্তু সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে গেলে মানুষ-গুরুর করুণা প্রয়োজন। তাঁর করুণা পেলেই আমরা মনুষ্যত্ব অর্জনের মাধ্যমে আলোকিত মানুষে রূপান্তরিত হতে পারব। জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে উদার প্রসারিত দৃষ্টিতে উপলব্ধি করতে পারব- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
মানবসভ্যতার ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, সেখানে সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে অসাধারণত্ব অর্জনের কাহিনি। কত ত্যাগ, প্রেম আর কঠোর সাধনার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে সেইসব আলোকিত আখ্যান-যা মানুষকে জগৎসংসারে উজ্জ্বল করে তুলেছে। আলোকলতা যেমন বৃক্ষশীর্ষকে জড়িয়ে থাকে ঠিক তেমনই মানুষের অন্তরেই অভিন্ন সত্তারূপে থাকেন পরমাত্মা। তাঁর সান্নিধ্যলাভেই সাধারণ মানুষ-সোনার মানুষ তথা মানবশ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে।
কিন্তু দেখা যায়, সমাজের অধিকাংশ মানুষ সাধনার ভ্রান্ত পথে চালিত হয়। ফলে মানুষ গৌণ হয়ে যায়। মুখ্য হয়ে পড়ে আচার-অনুষ্ঠান। তাই বাউলসাধনার অন্যতম আরেকটি দিক ‘আত্মানাং বিদ্ধি’ (নিজেকে জানো) উপেক্ষিতই থেকে যায়। আসলে নিজেকে জানতে গেলে মানুষকে জানতে হবে, জানতে হবে মানুষের অন্তরাত্মাকে। তাই গুরুবাদী বাউলতত্ত্বে বলা হয়েছে, বহিরঙ্গে মাথা মুড়িয়ে সন্ন্যাস নিলেই মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। কেবল আচারসর্বস্ব সাধনায় জাতে ওঠা যায় না। মানুষের মধ্যেই যে মানুষ-গুরু রয়েছেন তাঁর কৃপাধন্য হয়ে তাঁর নির্দেশিত পথেই পরমাত্মার অন্বেষণে অগ্রসর হতে হবে। তাতেই ঘটবে প্রার্থিত মুক্তি, সংকীর্ণ জাতিসত্তার বেড়াজাল থেকে যথার্থ মুক্তি। এই মুক্তির আলোকে মানুষ তখন হয়ে উঠবে অমৃতের পুত্র।
ভণিতা অংশেও দেখা যায়, সাধক লালন মানুষের প্রতি তাঁর অটল বিশ্বাসকে উপস্থাপন করেছেন। সকল ইন্দ্রিয়ের সেরা মন। মানুষকে ছাড়লে এই মন বাঁধা পড়ে না। সব বাঁধন ছিন্ন হয়ে যায়। শুরু হয় পরাজয়ের পালা। তখন মনুষ্যজীবনে নেমে আসে চরম হাহাকার। পাশাপাশি যদি মানুষকে ভজনা করা যায় তাহলে মনুষ্যত্ব অর্জনের মাধ্যমে আমরা পরিত্রাণ পাব ক্ষুদ্রতা থেকে, বন্দি জীবন থেকে ও জাগতিক পিছুটান থেকে। আমরা হয়ে উঠব সোনার মানুষ বা খাঁটি মানুষ।
নামকরণ কতটা সার্থক: পাঠ্য গীতিকাটি ফকির লালনের ভাবাদর্শকে আলোকিত করেছে। প্রতীয়মান করে তুলেছে তাঁর দর্শনকে এবং গীতিকাটির বিষয়বস্তু উপস্থাপনে সাংগীতিক মাধুর্য এমন উচ্চতা পেয়েছে যে, এতে লালনের অন্তরাত্মাকে আবিষ্কার করা যায়। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় নামকরণ যথার্থ ও সার্থক।
লালন শাহ্ ফকিরের গান কবিতার তাৎপর্যমূলক বিশ্লেষণ
ভূমিকা: ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ পাঠ্য গীতিকাটি বাউল সাধক লালন ফকিরের ভাব-দর্শনসমৃদ্ধ একটি সংগীত। গানটি দেহতত্ত্বমূলক ও গুরুবাদী ভাবাদর্শকে উপস্থাপন করলেও এর মূলে রয়েছে মানুষ। তিনি সাধনার সারবস্তু জেনেছেন মানুষকে, মানবদেহকে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব তিনি মানব দেহভাণ্ডের মধ্যেই পর্যবেক্ষণ করেছেন।
আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য: ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ তথা ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ শীর্ষক গীতিকাটির মোট পঙ্ক্তি সংখ্যা চোদ্দো। পঙ্ক্তিগুলির মধ্যে মাত্রাসমতা নেই বললেই চলে। তবে দার্শনিক ভাবনার গভীরতায় ও সুরের মাধুর্যে কথাগুলি খুবই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া সাধনতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাউল সাধক লালন যে প্রতীকী শব্দবন্ধের আয়োজন করেছেন, তা অভূতপূর্ব ও অনন্য।
পাঠ্য ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ গীতিকাটি একটি গীতিকবিতাও বটে। গীতিপ্রবণ ভাষায় লালন সাঁই এই গানে জীবনসত্যের অন্বেষণ করেছেন। মানবদেহই যে পরমাত্মার আবাসস্থল, মানবের দেহভাণ্ডেই যে গুরু নির্দেশিত পথে সন্ধান মিলবে মনের মানুষের-আত্মমগ্নতার ভাবাবেগ, মানবপ্রেমের সুরে সাঁই গানটির পরতে পরতে সেই কথাই বলেছেন।
বাউলসাধনা দেহবাদী সাধনা। সাধক রূপকার্থে আলোচ্য পাঠ্যাংশে সেই তত্ত্বই প্রকাশ করেছেন। মানবদেহ যে ষটচক্রে বিভাজিত, সেই চক্রসমূহের অন্যতম আজ্ঞাচক্রে অর্থাৎ মানবদেহের ভূযুগলের মাঝেই যে পরমাত্মার অধিষ্ঠান, তা রূপকার্থে বুঝিয়েছেন গীতিকার। তিনি বলেছেন- “দ্বি-দলের মৃণালে সোনার মানুষ উজ্জ্বলে” আজ্ঞাচক্রের উপরে মস্তকের কেন্দ্রে থাকে সপ্তম চক্র সহস্রার। প্রেমগুণে, ভাবগুণে এই সহস্রার থেকেই আজ্ঞাচক্রে এসে অবস্থান করেন মনের মানুষ। গুরুমুখী বাউল দর্শন বলছে, গুরুর কৃপাতেই মানবসন্তান তার মনকে কঠোর সাধনায় আজ্ঞাচক্রে নিয়ে যেতে পারলেই মনের মানুষের অর্থাৎ পরমাত্মা ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করে।
আলোচ্য গানে দেহতত্ত্ব: যা আছে বিশ্বব্রহ্মান্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে। বাউল সাধকের সাধনার ক্ষেত্রই হল মানবদেহ। তাই তারা এই দেহভাণ্ডের মধ্যেই খুঁজে ফিরেছেন পরমপুরুষ পরমাত্মা মনের মানুষকে। বাউলতত্ত্বে এই দেহ ষচক্রে বিভাজিত। মনকে যদি দেহের নিম্নে মূলাধার চক্র থেকে ভ্রূযুগলের মাঝে আজ্ঞাচক্রে নিয়ে যাওয়া যায়, তবেই সান্নিধ্য মেলে ‘দ্বি-দলের মৃণালে’ অবস্থিত ‘সোনার মানুষ’-এর। তাঁর সান্নিধ্যলাভেই মানবের মুক্তিলাভ।
মানবতার বাণী: সত্যসন্ধানী, ঋষি পুরুষ, মানবতাবাদী, মরমি সাধক লালন সাঁই স্বপ্ন দেখেছেন জাতি-ধর্ম-বর্ণহীন এক মানবিক সমাজব্যবস্থার- যেখানে সকল মানুষই সমমর্যাদায় মানবতা আর মূল্যবোধের ধ্বজা উড়িয়ে এগিয়ে যাবে আলোক অভিসারে। আসলে প্রতিটি মানুষেরই দুটি সত্তা রয়েছে। একটি বাইরের, অন্যটি ভিতরের। বহিরঙ্গের মানুষটিকে আমরা চর্মচক্ষুতে প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু অন্তরঙ্গের আলোকিত মানুষটিকে দেখতে পারি না। তাঁকে উপলব্ধি করতে হয় জ্ঞানচক্ষুতে, প্রজ্ঞার আলোকে। জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করতে না পারলে আমাদের অন্তরঙ্গের মানুষটিকে অনুভূতির সীমানায় ধরতে পারব না।
তাই বাউল বলেছেন- ‘আত্মানাং বিদ্ধি’ অর্থাৎ নিজেকে জানো। আসলে নিজেকে জানতে গেলে মানুষকে জানতে হবে, জানতে হবে মানুষের অন্তরাত্মাকে। মানুষ থেকে বিচ্যুত হয়ে কেবল বাহ্যিক আড়ম্বরে মজলে তৈরি হবে বৈষম্য- তখন মনুষ্যত্বই বিনষ্ট হবে। আর মনুষ্যত্ব লোপ পেলে ঈশ্বরও ছেড়ে যাবেন। মনে আসবে শূন্যতাবোধ। তাই সাধক বারংবার মানবপ্রেমের আলোকে অন্তরাত্মাকে আলোকিত করার কথা বলেছেন। সেই আলোকেই প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে জেগে উঠবেন অলীক মানুষ। তাঁর উপাসনাতেই মিলবে মুক্তিপথের দিশা।
সুফি ভাবনার প্রকাশ: সুফি ভাবনা হল ধর্মভাবনার মানবায়ন বা মানবপ্রীতির ধর্মপ্রক্ষেপ। ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা’- হ্যাঁ, সুফি ভাবনাতে আরাধ্য যিনি, তিনি প্রেমিক এবং যিনি ভক্ত তিনি প্রেমিকারূপে কল্পিত। আরাধ্যকে আবার কখনও নারীরূপেও আরাধনা করা হয়। বাউল ধর্মের সঙ্গে এর সাদৃশ্য হল- পরমারাধ্যের সান্নিধ্যলাভ, পরমারাধ্যকে অন্তরতম করে দেখা এবং অবশ্যই মানবাত্মায় পরমাত্মার অন্বেষণ। উভয় ধর্মের মানবতাবাদের প্রতি একান্ত টান থেকেই দুইকে এক করে দেখার চেষ্টা করা • হয়। সুফি ভাবনা লালন সাঁইকেও প্রভাবিত করেছে। তাই আলোচ্য গানেও ঈশ্বরচিন্তার আড়ালে বারংবার ফকির, মানুষ ভজনাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন।
আরও পড়ুন – ছুটি গল্পের প্রশ্ন ও উত্তর