ভাব সম্মিলন কবিতার বিষয়বস্তু ও নামকরণের তাৎপর্য
ভাব সম্মিলন কবিতার কবি পরিচিতি
প্রাক্কথন: মধ্যযুগের অন্যতম পদকর্তা তথা কবি বিদ্যাপতি বৈয়ব পদাবলী সাহিত্যাকাশে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। প্রাক্-চৈতন্যযুগের এই কবি অবাঙালি হয়েও বাংলা সাহিত্যে চিরকালীন আসন লাভ করেছেন। শ্রীচৈতন্যদেব থেকে রবীন্দ্রনাথ- সকলেই তাঁকে আত্মার আত্মীয় রূপে বরণ করে নিয়েছেন।
জন্ম, বংশপরিচয় ও কর্মজীবন: চৈতন্য-পূর্বযুগের এই কবি অর্থাৎ বিদ্যাপতি ১৩৭০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে মিথিলার মধুবনী পরগনার অন্তর্গত বিসফী গ্রামের এক ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম গণপতি ঠাকুর। বিদ্যাপতির পূর্বপুরুষদের অনেকেই মিথিলার রাজসভার উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। বিদ্যাপতিও সেইসময় বেশ কয়েকজন রাজার রাজত্বকালে মিথিলার রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন। কিন্তু রাজসভায় বসে তিনি শুধু রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক পদ এবং শিব সংগীতই রচনা করেননি; তিনি একাধারে পদকর্তা, সভাসদ, রাজকর্মচারী, সেনাপতি এবং সংস্কৃত ও মৈথিলি ভাষায় নানা গ্রন্থের গ্রন্থকার ছিলেন। বিদ্যাপতি তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে যেসব নরপতির কথা উল্লেখ করেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন-কীর্তিসিংহ, রাজা দেবসিংহ, রাজা শিবসিংহ, রাজা পদ্মসিংহ, রাজা নরসিংহ দেব, রাণী বিশ্বাস দেবী, রাণী ধীবরমতী, রাজা ভৈরবসিংহ প্রমুখ। এর ফলে মিথিলার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনের বিচিত্র তরঙ্গভঙ্গ তাঁর দীর্ঘ পরমায়ুকে নানাভাবে আন্দোলিত করেছে।
সৃষ্টিকর্ম : বিদ্যাপতি তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন, যেগুলি থেকে তাঁর ভাষাজ্ঞান এবং পান্ডিত্যের অসাধারণ পরিচয় পাওয়া যায়। তৎকালে বিদ্যাপতির বিভিন্ন বিষয়ে এত গ্রন্থরচনা পাঠকের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল- ‘বিভাগসার’ ‘দানবাক্যাবলী’, ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’, ‘গঙ্গাবাক্যাবলী’, ‘বাড়িভক্তি তরঙ্গিনী’, ‘শৈবসর্বস্বহার’, ‘কীর্তিলতা’, ‘কীর্তিপতাকা’, ‘ভূপরিক্রমা’, ‘পুরুষপরীক্ষা’, ‘লিখনাবলী’, ‘গোরক্ষবিজয়’, ‘মণিমঞ্জরী’ প্রভৃতি।
কাব্যপ্রতিভা: মহাপ্রভু চৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদ আস্বাদন করতেন- বিদ্যাপতির কবিপ্রতিভার এটি একটি অখণ্ডনীয় প্রমাণ: সংস্কৃত ভাষায় হলেও বাঙালি কবি জয়দেবই সর্বপ্রথম বৈয়ব পদ রচনা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর পদ কান্ত-কোমল হওয়া সত্ত্বেও মনে হয় উত্তরকালে বিদ্যাপতিই অধিকতর অনুকরণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। জয়দেব ও বিদ্যাপতি উভয়েই দেহবিলাস ও সম্ভোগ বর্ণনার কবি। সম্ভবত উভয়েই রাজসভার কবি ছিলেন বলেই তাঁদের রচনায় আধ্যাত্মিকতা আরোপ করতে হয়, তা আসলে দেহাশক্তিই বটে। তবে এটাও সত্য যে সৌন্দর্য প্রীতির জন্যই তাঁর দেহ বর্ণনার ওপর এত গুরুত্বদান করেছিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই রূপাসক্তি ভোগসক্তিকে অতিক্রম করে গেছে। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের চেয়ে বিদ্যাপতি-জয়দেবের রচনা মার্জিত, অগ্রাম্য ও শ্লীলতাপূর্ণ। বস্তুত সম্ভোগ বর্ণনাও তাঁদের রচনায় এক কল্পজগতের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যাপতি ও জয়দেব এই পর্যন্তই সদৃশ, এর পরেই মনে হয় বিদ্যাপতি জয়দেবকে অতিক্রম করে গেছেন। জয়দেব রাধাকৃষ্ণের লীলার অংশমাত্র, তাঁদের যৌবনবিলাসের কয়েকটি দিনের চিত্রমাত্র অঙ্কন করেছেন; আর বিদ্যাপতির রচনায় রাধাকৃষ্ণের লীলাবৈচিত্র্য পরিপূর্ণভাবে রূপলাভ করেছে। প্রেমের উন্মেষ থেকে প্রেমের চরম পরিণতি পর্যন্ত স্তরে স্তরে বিভিন্ন অবস্থা বর্ণনাতেও বিদ্যাপতি অনুপম কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। তিনি প্রেমকে কেবল একটি জৈবিক বৃত্তিমান বলে মনে করেননি, তাই তাঁর অঙ্কিত প্রেমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লজ্জা, ভয়, ঈর্ষা, ছলনা, উদ্বেগ, হর্ষাদি প্রভৃতি বিভিন্ন মানসিক বৃত্তি। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতির রাধা প্রসঙ্গে বলেছেন- “বিদ্যাপতির রাধা অল্পে অল্পে মুকুলিত বিকশিত হইয়া উঠিতেছে। সৌন্দর্য ঢল ঢল করিতেছে। শ্যামের সহিত দেখা হয় এবং চারিদিকে যৌবনের কম্পন্ন হিল্লোলিত হইয়া উঠে। খানিকটা হাসি, খানিকটা ছলনা, খানিক আড়চক্ষে দৃষ্টি।… আপনাকে আধখানা প্রকাশ এবং আধখানা গোপন, কেবল উদ্দাম বাতাসের একটা আন্দোলনে অমনি খানিকটা উন্মেষিত হইয়া পড়ে।” বিদ্যাপতি প্রধানত সম্ভোগরসের কবি, তাঁর কাব্যে প্রেমের যে জীবন্ত রূপ ধরা পড়েছে, তা ব্যক্তিসত্তার ঊর্ধ্বে সার্বজনীন অনুভূতিলোকে উন্নীত হওয়ার দাবি রাখে বলেই বিদ্যাপতির প্রেম একান্তভাবেই বৈয়বোচিত না-হওয়া সত্ত্বেও বৈয়বজনের অন্তরের বস্তু। বিদ্যাপতি রাধিকার বিচিত্র অনুভূতির কথা প্রকাশ করলেও বিরহবেদনা এবং মিলনোল্লাস বর্ণনাতেই তিনি আপনাকে অতিক্রম করে গেছেন। গীতিকাব্যের প্রাণরূপে পরিচিত ভাবাবেশ এখানেই সর্বাধিক গভীর। বিদ্যাপতির কাব্যে এই ভাবসমাবেশের জন্যই মহাপ্রভু অকৃপণভাবে তা থেকে রস-উপলব্ধির সুযোগ পেয়েছিলেন।
প্রয়াণ: এহেন মধ্যযুগের বৈয়ব পদাবলী সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের (বিদ্যাপতির) প্রয়াণ ঘটে ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের পরে কিন্তু ১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দের আগে কোনো এক সময়ে।
ভাব সম্মিলন কবিতার প্রসঙ্গকথা
বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতির অন্তর্ভুক্তির কারণ : বিদ্যাপতি বাঙালি ছিলেন না, বাংলা ভাষায় একটি পদও রচনা করেননি; তবুও তিনি বাংলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। কারণ,
প্রথমত, বিদ্যাপতির সময়কালে মিথিলা ও বাংলা দেশের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও ভাষাতাত্ত্বিক আদানপ্রদান ছিল। বাংলার ছেলেরা মিথিলায় অধ্যয়ন করে দেশে ফেরার সময় বিদ্যাপতির পদ সাথে করে নিয়ে আসত। ভাষাগত সাদৃশ্যের জন্য বাঙালিরা সহজেই মৈথিলি ভাষা বুঝত আর এই কারণেই মিথিলার কবি বিদ্যাপতি বাংলা দেশে পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা পান।
দ্বিতীয়ত, স্বয়ং চৈতন্যদেব বিদ্যাপতির রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদগুলি শুনতে ভালোবাসতেন বলেই তাঁর ভক্তগোষ্ঠীর মধ্যেও বিদ্যাপতির পদাবলীর প্রভূত প্রভাব পড়েছিল।
তৃতীয়ত, বাংলা ভাষায় রচিত পদসমূহে বিদ্যাপতির যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল। বাংলার বৈষ্ণব কবিরা বিশেষ করে গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির অনুসরণে ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেই স্মরণীয় হন। তিনি দ্বিতীয় বিদ্যাপতি নামেও খ্যাত। চতুর্থত, বাঙালির ঐকান্তিক আগ্রহেই বিদ্যাপতির শ্রেষ্ঠ পদগুলি রক্ষিত হয়েছে। বৈষ্ণব পদকর্তা এবং কীর্তনীয়াদের কৃপায় তাঁর এমন বহুপদ আমরা – পাই যেগুলি মিথিলাতেও পাওয়া যায়নি।
পঞ্চমত, বাংলা বৈষ্ণব ভাবাপন্ন দেশ। আর রাধাকৃষ্ণের কাহিনি এদেশে অনুরাগ ও ভক্তির সঙ্গেই পঠিত হয়। তাই বিদ্যাপতির পদাবলী রসিক বাঙালির কোমল অন্তরে সহজেই স্থান করে নিয়েছে। বলা যায় এখানেই বিদ্যাপতি ও তাঁর পদগুলির নবজন্ম ঘটেছে। বলতে ইচ্ছে করে মিথিলা তাঁর জন্মভূমি হলেও তাঁর চিরন্তন বাসভূমি যেন বাঙালির হৃদয়মন্দিরে।
পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতির প্রভাব: প্রাক্-চৈতন্যযুগের কবি বিদ্যাপতি মিথিলার অধিবাসী হলেও বাঙালির জীবন ও সাধনার সঙ্গে সুগভীর আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। রসিক বাঙালি পাঠকসমাজ তাঁর পদাবলীর রসমাধুর্য উপভোগ করে তাঁকে ‘অভিনব জয়দেব’ এবং ‘মৈথিলি কোকিল’ অভিধায় ভূষিত করেছেন। শ্রীচৈতন্য থেকে রবীন্দ্রনাথ সকলেই তাঁর পদাবলীর রসাস্বাদন করে তৃপ্ত হয়েছিলেন। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে অবাঙালি কবিদের মধ্যে বিদ্যাপতির প্রভাব সর্বাধিক। তাঁর প্রভাবগুলি হল-
(১) জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম’ ও বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের মধ্য দিয়ে বাঙালি রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলার স্বাদ আস্বাদন করেছেন। সেই স্বাদ উপভোগ্য হয়ে ওঠে বিদ্যাপতির পদে।
(২) মধ্যযুগের বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিদ্যাপতির অবদান চিরস্মরণীয়। সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রে পান্ডিত্য থাকার জন্য তিনি রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলাকে পূর্বরাগ থেকে ভাব সম্মিলন পর্যন্ত কয়েকটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে বিভক্ত করে বৈষ্ণব সাহিত্যের পথ তৈরি করে দেন। বিদ্যাপতির সেই পথকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলীর আলোচনা সম্পূর্ণ হতে পারে না।
(৩) রাজসভার কবি বিদ্যাপতির কাব্যে সম্ভোগে, আদিরস এবং বাবৈদগ্ধের প্রাচুর্য থাকলেও চিরন্তন প্রেমের প্রকাশেও উজ্জ্বল ছিল। বিদ্যাপতির পদ থেকেই বাঙালি প্রথম অপার্থিব প্রেমের সৌরভ লাভ করে। তাই শ্রীচৈতন্য থেকে রবীন্দ্রনাথ সকলেই বিদ্যাপতিকে আপনার হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
(৪) বিদ্যাপতির পদের সুললিত ভাষা এবং গীতিমূর্ছনা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। সমালোচকরা বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে যে গীতিধর্মিতার অন্বেষণ করেন তার অন্যতম কারণ বিদ্যাপতির পদসমূহ।
(৫) বিদ্যাপতি ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেছেন। এই ভাষার মাধুর্য বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাসকে আকৃষ্ট করে এবং তিনি তাঁর ভাব ও ভাষাকে এতটাই অনুসরণ করেন যে তিনি ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ নামে খ্যাত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই ভাষার মাধুর্যে বিমোহিত হয়ে ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ রচনা করেন।
পরিশেষে বলা যায়, ‘মাথুর’ পর্যায়ের বিরহের পদগুলি বাংলা সাহিত্যের চিরন্তন সম্পদ। বিরহের এমন শিথিল প্রকাশ শুধু মধ্যযুগে নয় আধুনিক যুগেও দুর্লভ। তা ছাড়া ‘প্রার্থনা’ পর্যায়ে বিদ্যাপতির ভক্তিভাব যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে সেই ভক্তিবাদ সমগ্র মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের মূলসুর। ভাষা, ভাব, ছন্দ প্রভৃতি সবদিক দিয়েই বিদ্যাপতি বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তাই মিথিলার কবি হয়েও তিনি কখন যেন বাংলার ও বাঙালির কবি হয়ে উঠেছেন।
ব্রজবুলি: প্রথমে বিদ্যাপতির পদে এই বিশেষ ধরনের ভাষাটি পাওয়া যায়, পরবর্তীতে গোবিন্দদাসের পদে; সেইজন্য গোবিন্দদাসকে দ্বিতীয় বিদ্যাপতি বলা একটি অনতম কারণ।
বৈষ্ণব পদাবলীতে ব্রজবুলি ভাষার ব্যাবহারিক ঐতিহ্য অনেক আগেই সুবিদিত। অথচ এই ভাষার জন্ম সম্পর্কে আমাদের ধারণা অর্ধস্বচ্ছ। বস্তুত ‘ব্রজবুলি’ কথাটি খুব প্রাচীন নয়, অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালেই এর উদ্ভব হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে ঈশ্বর গুপ্ত এই নামটি ব্যবহার করেন। মূল শব্দটি সম্ভবত ‘ব্রজাওলি’ অর্থাৎ ব্রজ সম্পর্কিত। একসময় মনে করা হত ব্রজধাম অর্থাৎ বৃন্দাবনের ভাষাই হল ব্রজবুলি। কিন্তু বৃন্দাবনে প্রচলিত ভাষা আর বৈয়ব পদাবলীতে ব্যবহৃত ব্রজবুলি এক নয়। অনেকে মনে করেন বিদ্যাপতির মৈথিলি ভাষায় রচিত পদগুলি বিকৃত প্রাপ্ত হয়ে ব্রজবুলির উৎপত্তি হয়েছে।
কারও কারও মতে, বিদ্যাপতিই এই ব্রজবুলি ভাষার সৃষ্টি করেছেন। এসব প্রচলিত ধারণা ঠিক নয়, আসলে এই ভাষার জন্মরহস্য নিহিত আছে ‘অবহট্ট’ ভাষার মধ্যে। অবহট্টের একটা কৃত্রিম সাহিত্যিক রূপ অবলম্বনে গড়ে উঠেছে ব্রজবুলি। ভাষাতাত্ত্বিকেরাই এই ভাষার একটা সুষ্ঠু ব্যাকরণসম্মত রূপও প্রত্যক্ষ করেছেন। ‘ব্রজবুলি’ ভাষা সম্পর্কে ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “ব্রজবুলির বীজ হইতেছে ‘লৌকিক’ অর্থাৎ অবহট্ট। …ব্রজবুলির বীজ অঙ্কুরোদ্ভিন্ন হইয়াছিল সম্ভবত মিথিলায়। বাঙ্গালায় তাহা প্রতিরোপিত হইয়া বৃদ্ধি পাইয়াছিল।” ব্রজবুলি বিদ্যাপতির মৈথিলি পদের বিকৃত রূপ না-হলেও বিদ্যাপতির হাতেই এ ভাষার যথার্থ শিল্পরূপটি গড়ে উঠেছিল।
বাংলা দেশে প্রথম ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেন যশোরাজ খান। মিথিলায় প্রথম ব্রজবুলি পদ রচনার কৃতিত্ব ‘উমাপতি ওঝার’। ওড়িশা ও অসমেও এই পদ রচিত হয়। সমগ্র উত্তর ভারতে ব্রজবুলি পদের প্রচলন ঘটলেও পদাবলী রচনায় এই ভাষার যথার্থ অনুশীলন হয়েছে বাংলার মাটিতে। ব্রজবুলি ভাষা কোমল ও শ্রুতিসুখকর। এই ভাষার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি গোবিন্দদাস। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও অল্পবয়সে এই ভাষায় রচনা করেছেন ‘ভানুসিংহের পদাবলী’।
ভাব সম্মিলন কী-আলোচনা
বিদ্যাপতির কাব্যবিশ্লেষণ ও কৃতিত্ব আলোচনা করতে গেলে কয়েকটি বিশেষ রসপর্যায় সম্পর্কে অবহিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তাঁর রচিত পদগুলিতে শ্রীরাধিকার পর্যায়ক্রমিক বিকাশ অঙ্কিত হয়েছে। বয়ঃসন্ধি, পূর্বরাগ, অভিসার, মাথুর, বিরহ, ভাবোল্লাস বা ভাব সম্মিলন ও প্রার্থনা ইত্যাদি পদের মাধ্যমে শ্রীরাধিকার ক্রমবিকাশ ঘটেছে। এইরকমই একটি পর্যায় ভাবোল্লাস বা ভাব সম্মিলন। শ্রীকৃষ্ণ অঙ্কুরের রথে চড়ে শেষবারের মতো বৃন্দাবন বা ব্রজধাম ছেড়ে মথুরায় চলে যান এবং আর কোনোদিনই বৃন্দাবনে ফিরে আসেননি। তাঁর বৃন্দাবনলীলা এভাবেই সমাপ্ত হয়। বিরহের পর যেসকল মিলনের পদ বৈয়ব কাব্যে দেখতে পাওয়া যায়, তা পুনর্মিলনের বর্ণনা নয়। মাধবের (শ্রীকৃষ্ণ) সাথে রাধার আর সাক্ষাৎ হয়নি। বিরহের আতিশয্যে রাধা কল্পনা করতেন, মাধব আবার এসেছেন, তাঁদের উভয়ের মিলন হয়েছে; এটাই ভাব সম্মিলন। এককথায় বলা যায়-ভাবজগতে রাধাকৃষ্ণের মিলনকে ভাবোল্লাস বা ভাব সম্মিলন বলে। ভাবোল্লাসে রাধাকৃষ্ণের মিলনলীলা সম্পূর্ণ হয় বৃন্দাবনের রূপজগতে নয়, রাধার আন্তর্জগতের বৃন্দাবনে। বিদ্যাপতির এইসকল পদ অতি উচ্চশ্রেণির, তাঁর সমকক্ষ আর কোনো কবি নেই। কখনও রাধা স্বপ্ন দেখছেন যে মাধব এসেছেন, কখনও মাধব ফিরলে রাধা কী করবেন তার উল্লেখ করছেন। কখনও মোহাবেশে তাঁকে সম্বোধন করছেন। প্রকৃত চাক্ষুষ সাক্ষাৎ আর তাঁদের ঘটেনি।
ভাব সম্মিলন কবিতার বিষয়বস্তু
বৈষ্ণব পদকর্তাগণ প্রেম মনস্তত্ত্বের সুনিপুণ রূপকার, ভাবোল্লাস বা ভাব সম্মিলন পর্যায়ে তাঁরা সেই প্রেম মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে অসাধারণ পরিচয় দিয়েচেন। ভাবোল্লাস-মিলনের এক বিচিত্র রূপ। মিলন যেহেতু সম্ভোগ-শৃঙ্গারের অন্তর্ভুক্ত, তাই ভাবোল্লাসও সম্ভোগ শৃঙ্গার। তবে এই মিলন শারীরিক নয়, সম্পূর্ণভাবে মানসিক। শ্রীরূপ গোস্বামী ‘উজ্জ্বল { নীলমণি’ গ্রন্থে ভাবোল্লাসের কথা উল্লেখ করেননি। কিন্তু ‘পদকল্পতরু’ গ্রন্থের চতুর্থ শাখার দ্বাদশ পল্লবের নাম রেখেছেন ভাবোল্লাস। ‘ভাবোল্লাস’ একাধারে মিলনও বটে, আবার বিরহও বটে। আসলে কৃষ্ণ মথুরায় চলে যাওয়ার পর, আর কোনোদিনই বৃন্দাবনে ফিরে আসেননি। কিন্তু বৈষ্ণব মহাজনগণ রাধার বিরহকাতর অবস্থা দেখতে পারছিলেন না। তাই বাস্তবে না-হলেও তাঁরা রাধাকৃষ্ণের মানসিক মিলনের ব্যবস্থা করে দেন। এই মিলনই হল ভাবোল্লাস। আমাদের পাঠ্য ‘কি কহব রে সখি আনন্দ ওর’ পদটি ভাবোল্লাস বা ভাব সম্মিলন পর্যায়ের একটি বিখ্যাত পদ। পদটির মধ্যে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনে উল্লসিতা রাধার আনন্দ-উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটেছে। আনন্দে আত্মহারা রাধা তাঁর সখিকে বলেছেন, তাঁর আনন্দের সীমা নেই। কারণ আর তিনি কোনোদিনই প্রিয়কে হারাবেন না। কৃষ্ণ চিরদিনের জন্য বন্দি হয়েছেন তাঁর ঘরে। বিরহ অবস্থায় রাধাকে বাঁধভাঙা চাঁদের হাসি যে পরিমাণ দুঃখ দিয়েছে, আজ প্রিয়-মুখ দর্শনে তিনি তত সুখই লাভ করলেন। রাধাকে যদি কেউ আঁচলভরে মহারত্ন দান করেন, তবুও তিনি তাঁর প্রিয়তমকে দূরদেশে পাঠাবেন না। কৃষ্ণকে আর দূরদেশে না-পাঠানোর দৃঢ় সংকল্প থেকেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে পদটি ভাবোল্লাসের। দীর্ঘ গ্রীষ্মের পর বর্ষার বারিধারায় জীব ও উদ্ভিদ জগৎ যেমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে, তেমনি দীর্ঘ বিরহের পর প্রিয়-সান্নিধ্য রাধাকে আকুল করে তুলেছে। কৃষ্ণের সঙ্গে নিজের সম্পর্ককেও রাধা তাঁর অস্তিত্ব রক্ষার অনিবার্য প্রয়োজনের সঙ্গে তুলনা করে নতুন মাত্রা দান করেছেন। কৃষ্ণ তাঁর কাছে শীতের আচ্ছাদন, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষাকালের ছাতা, আর অকূল সমুদ্রের তরণী। এখানেও রাধার একাগ্র-তন্ময়তা কৃষ্ণপ্রেমের অপূর্ব ব্যাখ্যা ভাবসম্মিলনের পদকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে তুলেছে। এই উপমার মালা ব্যবহার করেও কবি রাধার প্রেমকে যেন মর্ত্যচারী করে তুলেছেন। এক্ষেত্রে বোঝাই যাচ্ছে প্রিয়তমকে পাওয়ার আনন্দে রাধা সব কিছু বিস্মৃত হয়েছিলেন, জড়সত্তার সঙ্গে প্রাণসত্তার পার্থক্য বোধও লুপ্ত হয়েছিল তাঁর। বৈয়ব তত্ত্ব মেনে বিদ্যাপতি ভাবোল্লাসের পদ রচনা করেননি। তবুও রাধার অন্তরে তিনি প্রিয় মিলনের যে অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিলেন তা কাব্যিক প্রগাঢ়তায় আস্বাদনীয় হয়ে উঠেছে।
ভাব সম্মিলন কবিতার নামকরণের তাৎপর্য
বৈষ্ণব পদ বা পদাবলী বিভিন্ন রসপর্যায়ে বিভক্ত। এই রসপর্যায়ের অন্যতম একটি পর্যায় হল ভাবোল্লাস বা ভাব সম্মিলন। কৃষ্ণ যখন অঙ্কুরের রথে চড়ে বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় চলে যান তখন ব্রজধামে অর্থাৎ বৃন্দাবনে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। মাধবের সাথে শ্রীরাধিকার আর সাক্ষাৎ হয়নি। বিরহের আতিশয্যে রাধা কল্পনা করতেন মাধব আবার এসেছেন, তাঁদের উভয়ের মিলন হয়েছে; এটাই ভাব সম্মিলন। এককথায় বলা যায়, ভাবজগতে রাধাকৃষ্ণের মিলনকে ভাবোল্লাস বা ভাব সম্মিলন বলে। বিদ্যাপতি রচিত আমাদের পাঠ্য পদ ‘কি কহব রে সখি আনন্দ ওর’ পদটিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় শ্রীরাধিকা ভাবজগতে শ্রীকৃষ্ণের সাথে মিলনের আকাঙ্ক্ষায় বিভোর। শ্রীরাধিকা বলে ওঠেন তাঁর আনন্দের সীমা নেই; কারণ মাধব স্বয়ং তাঁর ঘরে। পাপী চন্দ্র তাঁকে শতদুঃখ দিলেও শ্রীরাধিকা প্রিয়া-মুখ দেখে সব দুঃখ ভুলে গেছেন। আসলে এ সবই রাধার স্বপ্নবিলাপ। বৈষুব রসশাস্ত্রকারেরা শ্রীরাধিকার এই অবস্থাকে ভাবোল্লাস বা ভাব সম্মিলন বলে অভিহিত করেন। পদকর্তারা পদ রচনাকালে পদের নাম দেন না। তাঁরা রসপর্যায়ের পদ লেখায় সময় শুধুমাত্র সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করেন। সংকলকগণ পদটি রসপর্যায়ের নাম অনুসারে ভাব সম্মিলন নামকরণটি করেছেন।
আরও পড়ুন – শিক্ষামনোবিজ্ঞান প্রশ্ন ও উত্তর