জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণাটি আলোচনা করো
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা মূলত পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া হিসেবেই প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রভাবনার তিনটি ধারা অত্যন্ত স্পষ্ট-
- ইংরেজ শাসনের অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো,
- প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার আদর্শগত বিরোধকে তুলে ধরা এবং করা।
- স্বাদেশিকতার গঠনমূলক ভাবনা প্রকাশ করা।
ন্যাশনালিজম গ্রন্থে তাঁর বক্তব্য
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ সরাসরি প্রবেশ করেছেন তাঁর ন্যাশনালিজম (Nationalism) সংক্রান্ত বক্তৃতা সংকলনে। তিনি প্রধানত জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমি জাতীয়তাবাদ, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি ন্যাশনালিজম গ্রন্থে লিখেছেন যে, জাতীয়তাবাদ (উগ্র) মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার মনুষ্যত্বকে অবরুদ্ধ করে। অর্থাৎ কাল্পনিক সমষ্টির কাছে ব্যক্তিকে বলি দিয়ে মানুষের সৃজনশীল সত্তার বিকাশকে ব্যাহত করে।
ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা
তদানীন্তন ইউরোপীয় রাষ্ট্রদার্শনিকগণ যখন জাতীয়তাবাদকে একটি মহান আদর্শ হিসেবে সাদরে গ্রহণ করেছেন ও জাতীয় রাষ্ট্রকে শ্রেষ্ঠ মানবিক সংস্থা হিসেবে পুজো করার পরামর্শ দিয়েছেন, তখন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে জাতীয়তাবাদকে সেইরূপ আশীর্বাদ হিসেবে ভাবা সম্ভব ছিল না। এই কারণেই তিনি তাঁর তত্ত্বে জাতীয়তাবাদী আদর্শের নগ্ন-বীভৎস ও অন্যায় রূপটিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন।
উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা
রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমি সভ্যতার মনোভাব ও তার তাগিদে পররাজ্যগ্রাস প্রবৃত্তিকে ধিক্কার জানান। তিনি পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কিন্তু জাতীয়তাবাদের নামে পাশ্চাত্যে যে সংঘবদ্ধ দানব শক্তি প্রদর্শিত হয়, তার প্রতি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কলমের মাধ্যমে তীব্র কশাঘাত হেনেছিলেন। *2
মানুষের শুভসভার বিনাশ
রবীন্দ্রনাথের মতে, জাতীয়তাবাদ মানুষের { শুভসত্তাকে খর্ব করে তাকে হাতের পুতুলে পরিণত করেছে। তাই মানুষের এক শুভবুদ্ধির জাগরণের জন্য জাতীয়তাবাদী যন্ত্রদানবের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রামের আহবান জানিয়েছেন। এ ছাড়া জাত্যভিমানের বদলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষকে এক অখন্ড রাজ্যের নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন।
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনাগুলি থেকে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিশ্বমানবতাবাদী, আন্তর্জাতিকতাবাদী, বিশ্বজনীন ব্যক্তিত্ব। তা সত্ত্বেও তাঁর ন্যাশনালিজম সম্পর্কিত ধারণাটি ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত রাষ্ট্রনেতাদের নিকট নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে।
জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার শত্রু- আলোচনা করো
অথবা, জাতীয়তাবাদ কি সভ্যতার শত্রু? আলোচনা করো
জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার শত্রু-বিশ্লেষণ
সমগ্র ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের ধারণাটি উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা আন্দোলনকে যে জাতীয়তাবাদের প্রেরণা দান করেছে, সেই জাতীয়তাবাদই উগ্র মূর্তি ধারণ করে বিগত শতাব্দীর দ্বিতীয় শতকে সমগ্র পৃথিবীতে বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছে। এই কারণে জাতীয়তাবাদকে মানবসভ্যতার শত্রুরূপে অনেকে অভিহিত করেছেন। উপরোক্ত উক্তিটির বিশ্লেষণ করলে যেসকল যুক্তিসমূহের অবতারণা করা হয়, তা হল-
(i) সাম্রাজ্যবাদের আশঙ্কা
ঐতিহাসিকভাবে জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের উদ্ভব হয় উদীয়মান মধ্যবিত্ত এবং বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশকে ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনে, যা অভ্যন্তরীণ বাজার দখল সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আবশ্যক। যার প্রয়োজন থেকেই জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। পরবর্তীকালে, ধনতন্ত্রের পরবর্তী স্তরে উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছিল না বলেই জাতীয়তাবাদ পরিণত হয় সাম্রাজ্যবাদে।**
(ii) অগণতান্ত্রিক
জাতীয়তাবাদের উগ্র, হিংস্র, বীভৎস প্রকাশ গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার ও সমস্ত মানবিক চেতনার পরিপন্থী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘জাতীয়তাবাদ হল সভ্যতার সংকটস্বরূপ’।
(iii) বিশ্বশান্তির বিরোধী
উগ্র জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিক শান্তির পক্ষে ক্ষতিকর। কারণ এইরূপ জাতীয়তাবাদ সর্বক্ষেত্রে স্বদেশ ও স্বজনের দাবিকে অগ্রাধিকার দেয়। এর ফলে ন্যায়, অন্যায়, যুক্তি ও আলাপ-আলোচনাকে অস্বীকার করা হয় এবং সর্বপ্রকার বিরোধ-মীমাংসার জন্য যুদ্ধের পথ গ্রহণ করা হয়। এই যুদ্ধবাদী প্রবণতাই বিশ্বশান্তির ঘোরতর শত্রু।
(iv) সভ্যতার সংকটস্বরূপ
জাতীয়তাবাদ স্বদেশ ও স্বজনের প্রতি গভীর অনুরাগের ভিত্তিতে জাত্যভিমানে রূপান্তরিত হয়, যার ফলে জাতির মনে নিজের সম্পর্কে গর্ববোধ এবং অপর জাতির প্রতি ঘৃণা জন্মায়। এইভাবে জাতীয়তাবাদ বিকৃত রূপ ধারণ করে বিভিন্ন জাতির মধ্যে হিংসা, ঘৃণা ও বিদ্বেষের সম্পর্ক সৃষ্টি করে। ফলস্বরূপ মানবসভ্যতা সংকটের সম্মুখীন হয়।
মূল্যায়ন
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদের মূল রূপটি সম্পূর্ণ প্রয়োগভিত্তিক। অর্থাৎ, জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার শত্রু না মানবসভ্যতার কাছে আশীর্বাদস্বরূপ-সেটা মূলত নির্ভর করে জাতীয়তাবাদকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার উপর। যেমন- জাতীয়তাবাদ যদি উগ্ররূপ ধারণ করে তবে সমগ্র জাতির কাছেই তা হয়ে ওঠে বিভীষিকার মতো। অন্যদিকে, জাতীয়তাবাদ যদি দেশপ্রেমের সমার্থক হয়ে ওঠে তবে তা মানবজাতির কাছে আশীর্বাদস্বরূপ।
রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো
রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ন্যাশনালিজম’ (Nationalism) শীর্ষক গ্রন্থে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে নিজের মৌলিক চিন্তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। ১৯১৬-১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের সময় বিভিন্ন জায়গায় তিনি যেসব বক্তৃতা দেন, সেগুলি নিয়েই তাঁর ‘ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথের নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কয়েকটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদও এই সংকলন গ্রন্থটির শেষদিকে সংযোজন করা হয়েছে। নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে। এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বিশেষত ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের তীব্র সমালোচনা করেন। পাশ্চাত্যের মাটিতে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম, তাকে তিনি ভালো চোখে দেখেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ শুধু ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিরোধ আর বিচ্ছেদের জন্ম দেয়। এই জাতীয়তাবাদ ধর্ম, মানবতাবাদ, নীতিবোধ ও মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এই কারণে পশ্চিমের দেশগুলিতে মারামারি-হানাহানি নিরন্তর ঘটে চলেছে। নিজের দেশ, নিজের জাতি বড়ো আর অন্য সব দেশ, অন্য সব জাতি ছোটো ও নীচ, জাতীয়তাবাদের এই ধারণাই বিভেদের বীজ বপন করে ক্রমশ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। শেষপর্যন্ত তা দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে গ্রাস করে সমগ্র বিশ্বে আধিপত্য কায়েমে সচেষ্ট হয়। এজন্য রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমি জাতীয়তাবাদকে আধিপত্যবাদ বা প্রভুত্ববাদ বলে অভিহিত করেছেন। ইউরোপীয় ধাঁচের জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং এই গ্রন্থে তাঁর বিরূপ মনোভাবের অভিব্যক্তি ঘটেছে। পশ্চিমি জাতীয়তাবাদী আদর্শের অমানবিক নগ্ন বীভৎসতা তাঁকে ব্যথিত করেছিল। তাঁর মতে, ইউরোপীয় ধাঁচের জাতীয়তাবাদ মানবতার আদর্শ নয়, সভ্যতার সংকট।
রবীন্দ্রনাথ-এর মতে, জাতীয়তাবাদ হল পাশ্চাত্যের আবিষ্কার। কিন্তু পশ্চিমি সংস্কৃতি এই ধারণার উৎস নয়, এই ধারণার উৎস হল পশ্চিমি সভ্যতা। তাঁর মতে, সংস্কৃতি হল সৃষ্টিশীল আত্মার উদ্ভাবক অপরদিকে, সভ্যতা হল বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের এক নির্মাণমূলক যান্ত্রিক ব্যবস্থা। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, জাতীয়তাবাদ যে বিভেদের বীজবপন করেছিল, তা পরবর্তীকালে বিশাল আকার ধারণ করে। নিজের জাতি শ্রেষ্ঠ এবং অন্যের জাতি হীন-এই ধারণা থেকেই জন্ম নেয় ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ। রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমি জাতীয়তাবাদের নামে অনুসরণ করা অত্যাচার, দমনপীড়ন ও নিষ্ঠুরতার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, রুশো (Rousseau) এবং বার্কার (Barker)- এর মহান আদর্শ থেকে পশ্চিমি ইউরোপীয় দেশসমূহ অনেক দূরে সরে গেছে। সংকীর্ণ স্বার্থকে চরিতার্থ করতে ইউরোপের দেশগুলি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও সভ্যতা-সংস্কৃতিকে কাজে লাগিয়েছে। ফলে জাতীয়তাবাদ মানবসমাজের অভিশাপস্বরূপ আমাদের নিকট উপস্থিত হয়েছে। যে তিনটি বক্তৃতার সংকলন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ-এর ন্যাশনালিজম গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়, সেই বক্তৃতাগুলি হল- ন্যাশনালিজম ইন দ্য ওয়েস্ট, ন্যাশনালিজম ইন জাপান এবং ন্যাশনালিজম ইন ইন্ডিয়া।
মূল্যায়ন
পরিশেষে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, ইউরোপ তথা পশ্চিমের যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি হল জাতীয়তাবাদ। পরাধীন দেশগুলিকে শোষণ করে রিক্ত করে তোলাই এর একমাত্র উদ্দেশ্য। পাশ্চাত্য সভ্যতার জাতীয়তাবাদ সমগ্র মানবজাতি এবং সমগ্র মানবসভ্যতার পক্ষে এক ভয়াবহ বিপদ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে পশ্চিমি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা আলোচনা করো
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে পশ্চিমি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য: রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন-এর ভাষায় তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট দার্শনিক। তাই রবি ঠাকুরের কাছ থেকে রাজনৈতিক ধারণার প্রাপ্তি প্রত্যাশা করা অনুচিত। এতদসত্ত্বেও, তৎকালীন সময়ের নানান রাজনৈতিক ঘটনাক্রম উঠে এসেছিল তাঁর সুচিন্তিত লেখনীতে। পরবর্তীকালে তাঁর চিন্তাধারার ব্যাখ্যাকারগণ সেই লেখনীগুলিকেই রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা নামে অভিহিত করেন।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য গ্রন্থে তাঁর বক্তব্য
১৩০৮ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠে রবীন্দ্রনাথ-এর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ নামক প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। পশ্চিমি জাতীয়তাবাদ বিষয়ে তাঁর মনে যে সন্দেহের বীজ দানা বেঁধেছিল তা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর এই প্রবন্ধটির মাধ্যমে। এই প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “স্বার্থের প্রকৃতিই বিরোধ। ইউরোপীয় সভ্যতার সীমায় সীমায় সেই বিরোধ উত্তরোত্তর কণ্টকিত হইয়া উঠিতেছে। পৃথিবী লইয়া ঠেলাঠেলি, কাড়াকাড়ি পড়িবে, তাহার পূর্বসূচনা দেখা যাইতেছে।” পরবর্তী কিছু বছরের মধ্যেই তৎকালীন ইউরোপের উগ্র জাতীয়তাবাদী চরিত্রটি রবীন্দ্রনাথের কাছে স্বচ্ছভাবে প্রতীয়মান হয়ে উঠেছিল, যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৩২১ বঙ্গাব্দে রচিত তাঁর ‘লড়াইয়ের মূল’ নামক প্রবন্ধে।
জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের বক্তব্য
জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামক একটি নিবন্ধে লিখেছেন, “বাণিজ্যস্বার্থের সঙ্গে ‘গান্ধর্ব বিবাহ’-সূত্রে আবদ্ধ হয়ে জাতীয়তাবাদ যে অনিবার্যভাবে উগ্র ও আগ্রাসী রূপ ধারণ করে সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়, ‘বাণিজ্যপ্রবাহের মতো রাজত্বপ্রবাহেরও দিনরাত আমদানি রফতানি চলে’ এবং এক দেশের উপর আরেক দেশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উপনিবেশের বিস্তার ঘটে। সাম্রাজ্যবাদের অন্তর্নিহিত এই আর্থ-রাজনৈতিক সারসত্যটি রবীন্দ্রনাথের বিচক্ষণ দৃষ্টিতে স্পষ্ট ধরা পড়ে। শুধু তাই নয়, এর অনিবার্য পরিণাম যে উপনিবেশবাদী ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্রগুলির মধ্যে পৃথিবীর ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে লড়াই এবং দেরিতে ঘুম-ভাঙা জার্মানিই যে এবার ‘অন্যের পাত কাড়তে’ সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়বে-তার ইঙ্গিতও তিনি এই প্রবন্ধে দিয়েছিলেন।”
জাতীয়তাবাদের উগ্র রূপ
রবীন্দ্রনাথ-এর মতে, ইউরোপের জাতীয়তাবাদ ঐক্য, সংহতি, সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী নয়। – পাশ্চাত্যের জাতীয়তাবাদ ধর্ম, নৈতিকতাবোধ, মানবতাবাদ ও মূল্যবোধ বর্জিত বলেই আজ পশ্চিমি দেশগুলিতে মারামারি ও হানাহানি দেখা যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে যখন পাশ্চাত্য সভ্যতার স্বরূপ উদ্ঘাটনে মনোনিবেশ করেন, তখনও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্কর রূপ বিশ্ববাসী দেখেনি। সাম্রাজ্যবাদের যে নগ্ন চেহারা রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তারই প্রেক্ষিত পর্যালোচনা করতে গিয়ে তিনি জাতীয়তাবাদ বিশ্লেষণে সচেষ্ট হন। তিনি প্রত্যক্ষ করেন, ইউরোপীয় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি নিজেদের ক্ষমতার দাম্ভিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যেই পৃথিবী জুড়ে সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটিয়েছিল এবং নিজেদের সভ্যতা, সংস্কৃতি-সহ সবকিছুই এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশসমূহের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল। সমকালীন ইউরোপীয় দেশগুলির চিন্তাবিদগণ জাতীয়তাবাদকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। জাপান ও আমেরিকা এই জাতীয়তাবাদকে উগ্র পর্যায়ে উন্নীত করতে সচেষ্ট হয়ে উঠেছিল। জাতীয়তাবাদের এই উগ্র রূপটিকে রবীন্দ্রনাথ তীব্র ধিক্কার জানান। তিনি মানবসভ্যতার বিকাশের লক্ষ্যে জাতির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, সদ্ভাব বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া, মূল্যবোধের বিকাশ ইত্যাদির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধচলাকালীন পশ্চিমি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা আলোচনা করো
প্রথম বিশ্বযুদ্ধচলাকালীন পশ্চিমি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণদামামা বেজে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাবলি রবীন্দ্রনাথকে বিচলিত করে তুলেছিল। তিনি তাঁর ‘Nationalism in the West’ শীর্ষক বক্তৃতার মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্যের উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণার তীব্র নিন্দা শুরু করেন। সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা’-য় জাতীয়তা সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের বিরূপ মনোভাব এবং রবীন্দ্রনাথের ‘ন্যাশনালিজম’ নামক শীর্ষক গ্রন্থের সারসংক্ষেপ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন-
(i) প্রথম রচনাটিতে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমি সভ্যতার অন্তর্বিরোধ তুলে ধরেছিলেন। তাঁর মতে, পশ্চিমি সভ্যতা ক্ষমতালোলুপ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অর্জনে মত্ত হয়ে পড়েছে। তিনি এও বলেছেন যে, জাতীয়তাবাদ একটি মহামারী, যার ক্রমাগত আক্রমণে মানবসভ্যতা বিপন্ন; পশ্চিমে উদ্ভূত জাতীয়তাবাদ সেখানকার সভ্যতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে।
(ii) দ্বিতীয় রচনাটিতে রবীন্দ্রনাথ আত্মঘাতী পশ্চিমি সভ্যতার অনুগামী জাপানের জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও সম্প্রসারণে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ইউরোপীয় সভ্যতার অমৃতধারার আস্বাদ না নিয়ে তার হলাহল পানে জাপানকে উদ্যত দেখে তিনি জাপানের চিন্তাশীলদের সতর্ক করেছিলেন।
(iii) তৃতীয় রচনায় তিনি দেখিয়েছেন যে, পশ্চিমী সভ্যতা ভারতের তমসাচ্ছন্ন জড়তা দূর করে মঙ্গলালোকের পথনির্দেশ করেছে, অপরদিকে জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত পরিবেশের সৃষ্টি করেছে, সহিষ্ণুতার পথ ত্যাগ করে আত্মঘাতী জাতীয়তাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার অর্থ সংঘাতকে অনিবার্য করা।
রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, জাতীয়তবাদ হল পাশ্চাত্যের আবিষ্কার, যার সঙ্গে ভারতবর্ষের নাড়ির কোনো সংযোগ নেই। তিনি পশ্চিমি সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করে বলেছিলেন পশ্চিমি সভ্যতা থেকেই Nationalism-এর জন্ম। এ প্রসঙ্গে জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের মতে সংস্কৃতি হল সৃষ্টিধর্মী ও আত্মার মাধ্যমে উদ্ভূত। আর সভ্যতা একটি নির্মাণমূলক যান্ত্রিক ব্যবস্থাবিশেষ। পুঁজিবাদী সভ্যতাকে তিনি বৈশ্যরাজকতন্ত্র বলে অভিহিত করেছিলেন, যা সাম্রাজ্যবাদের রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই ভাবেই রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি তথা আত্মাকে পশ্চিমি সভ্যতা থেকে পৃথক করে পশ্চিমি সভ্যতাকে জাতীয়তাবাদ নামক অভিশাপের জন্য দায়ী করেছেন। তাঁর কাছে পশ্চিমি সভ্যতা ছিল জন্তুর সভ্যতা। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য বা জাতীয়তাবাদ-এই কোনোটিই মানবসভ্যতার জন্য ক্ষতিকারক নয়। এগুলির প্রয়োগকর্তা নিজেদের স্বার্থে এগুলিকে ক্ষতিকারক করে তোলে। তাই তাঁর ভাষায়, “ইম্পিরিয়ালিজম অজগর সাপের ঐক্যনীতি, গিলে খাওয়াকে সে এক করা বলে প্রচার করে…”
মন্তব্য
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, জাতীয়তাবাদ পুঁজিতন্ত্র ও বাণিজ্যিক স্বার্থের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এবং অনিবার্যভাবেই তা উগ্র, আগ্রাসী, ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। শেষপর্যন্ত, আন্তর্জাতিকতার বিরোধী হিসেবে জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদের নতুন মোড়কে আবির্ভূত হয়। এর সবচেয়ে বড়ো দৃষ্টান্ত হল, গত শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া দুই মহাযুদ্ধ। তাই রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদকে মানবতার শত্রু, মানবতা বিরোধী এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায় বলে মনে করেছেন।*
জাপানের জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা আলোচনা করো
জাপানের জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য
‘ন্যাশনালিজম ইন জাপান’ রচনাটি ন্যাশনালিজম শীর্ষক গ্রন্থের দ্বিতীয় রচনা। সেখানে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যটি ছিল-
জাতীয়তা হল যান্ত্রিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সংগঠিত একটি মানবীয় প্রতিষ্ঠান, যার মূল ভিত্তি আর্থ-রাজনৈতিক বিষয়সমূহ। বিরোধ এবং বিজয়ের মনোভাব এর কেন্দ্রস্থলে বিরাজমান। এর ফলস্বরূপ জাতিগুলির মধ্যে পারস্পরিক ঈর্ষানল প্রজ্জ্বলিত হয়ে একটি জাতি অপর এক জাতির শত্রুতে পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছিলেন, “জাতির শক্তি ও বৈভবের গরিমা, তার পতাকা ও মন্ত্র, তার মিথ্যা দেবোপসনা, তাঁর দেশপ্রেমিকতার কপট বজ্রঘোষণার আড়ালে যে-মূল সত্যটি রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছেন, তা হল জাতিই জাতির সবচেয়ে বড়ো শত্রু, অন্য জাতির বিরুদ্ধেই তার যত সতর্কতা, যে-কোনো নতুন জাতির জন্মই তার কাছে এক নতুন আতঙ্কের উদ্ভব। উদাহরণ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন, যে জাপান পাশ্চাত্যেরই আলোকে নিজেকে নেশনে পরিণত করেছিল, সে জাপানই পাশ্চাত্য নেশনগুলির কাছে পরিণত হয়েছে এক আতঙ্কে। জাপান নিজে আবার নেশনের নতুন অস্ত্র হাতে পেয়ে চীনের উপর তার ধার পরীক্ষা করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে।”
সভ্যতার সংকট গ্রন্থে তাঁর বক্তব্য
সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আজ আমার বয়স আশি বৎসর পূর্ণ হল; আমার জীবন ক্ষেত্রে বিস্তীর্ণতা আজ আমার সম্মুখে প্রসারিত। পূর্বতম দিগন্তে যে জীবন আরম্ভ হয়েছিল তার দৃশ্য অপর প্রান্ত থেকে নিঃসক্ত দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি এবং অনুভব করতে পারছি যে, আমার জীবনের ও সমস্ত দেশের মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে, সেই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে গভীর দুঃখের কারণ আছে। যন্ত্রসভ্যতাকে মূলধন করে ইংরেজরা সারা বিশ্বকে মুঠোর মধ্যে আনতে ও তাদের উপর মাতব্বরি করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এই যন্ত্রসভ্যতা এবং তার থেকে উৎসারিত জাতীয়তাবাদ ভারতের মতো হতভাগ্য দেশের কোনো কল্যাণ করতে পারেনি। পক্ষান্তরে, যন্ত্রনির্ভর সভ্যতা সর্বতোভাবে জাপানকে ঐশ্বর্যশালী করেছে।” অর্থাৎ, তাঁর এই বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্ট যে, যন্ত্রশক্তি কীভাবে জাপান, রাশিয়া-সহ ইউরোপের নানান দেশের উন্নতিসাধন করেছে তা তিনি ওইসব দেশসমূহে ভ্রমণ করে প্রত্যক্ষ করেছেন।
জাপানি জাতীয়তাবাদের সমালোচনা
তিনি ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ জাপানের আগ্রাসী মানসিকতাকে কখনোই সমর্থন করেননি। কারণ এশিয়া মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত একটি রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও জাপান ইতিবাচক পশ্চিমি সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার পরিবর্তে ইউরোপীয় নেতিবাচক সভ্যতাকে সাদরে গ্রহণ করেছিল, তাই তিনি জাপান সফরে গিয়ে জাপান রাষ্ট্রকে আধিপত্যবাদী বলে তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। জাপানের এরূপ জাত্যভিমান এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী মানসিকতার উদ্ভব ও তার ক্রমবিকাশে তিনি আতঙ্কিত হন। পরবর্তীকালে জাপানের চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গদের তিনি এ বিষয়ে সতর্ক করে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
ভারতের জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা আলোচনা করো
ভারতের জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য
ন্যাশনালিজম গ্রন্থে তাঁর বক্তব্য
‘ন্যাশনালিজম’ শীর্ষক গ্রন্থের তৃতীয় রচনাটি হল ন্যাশনালিজম ইন ইন্ডিয়া। এই রচনায় তিনি বলতে চেয়েছেন, পশ্চিমি সংস্কৃতি একদিকে ভারতের কালিমালিপ্ত অতীত জড়তা দূরীভূত করে সমাজের মঙ্গলসাধনের পথনির্দেশিকা দান করেছে। অপরদিকে, পশ্চিমি সভ্যতা জাতীয়তাবাদের করালগ্রাসে ভারতের অতীত ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করতে উদ্যত হয়েছে। ভারতের জন্য রবীন্দ্রনাথের গভীর, আন্তরিক ও আবেগপূর্ণ ভালোবাসা ছিল। তাঁর দেশাত্মবোধক স্বদেশপ্রীতির গান ১৯০৫-১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র বাংলা তথা ভারতবর্ষে পরিব্যাপ্তি লাভ করেছিল। কিন্তু তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি ব্রিটেনকে কেবল একটি সাম্রাজ্যবাদী শোষক রাষ্ট্র হিসেবে দেখেননি, ইংরেজ জাতির সাংস্কৃতিক গুণাবলিগুলিকে তিনি অনুসরণ ও অনুকরণের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু তিনি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। তবে আত্মসম্মানবোধকে বিসর্জন দিয়ে ইংরেজ জাতির নিকট স্বাধীনতা ভিক্ষা করার বিপক্ষে তিনি বিশেষ মতামত প্রদান করেন।
আত্মশক্তি গ্রন্থে তাঁর বক্তব্য
তিনি তাঁর ‘আত্মশক্তি’ নামক গ্রন্থে ভারতবাসীর আত্মোন্নতির কথা বলেছেন। ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে নানান অন্তরায় সৃষ্টির প্রচেষ্টা করত, যাতে ভারতের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হয়। ব্রিটিশদের নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী রূপধারী এই জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, “ভারতবর্ষের মতো এত বড়ো দেশকে এক করিয়া তোলার মধ্যে একটা গৌরব আছে। ইহাকে চেষ্টা করিয়া বিচ্ছিন্ন রাখা ইংরেজের মতো অভিমানী জাতির পক্ষে লজ্জার কথা। কিন্তু ইম্পিরিয়ালিজম মন্ত্রে এই লজ্জা দূর হয়। ব্রিটিশ এম্পায়ারের মধ্যে এক হইয়া যাওয়াই ভারতবর্ষের পক্ষে যখন পরমার্থলাভ তখন সেই মহদুদ্দেশ্যে ইহাকে যাঁতায় পিষিয়া বিশ্লিষ্ট করাই হিউম্যানিটি।” এভাবেই তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের জাতীয়তাবাদকে বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে সমালোচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যাশা করেছিলেন ব্রিটিশ সভ্যতা তথা জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ভারতের কল্যাণসাধন করবে। কিন্তু জীবনের অন্তিম লগ্নে দাঁড়িয়ে তাঁর এই বিশ্বাস হয়েছে যে, ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের ক্ষতিকারক অগ্রাসী রূপ ভারতের কোনো কল্যাণ করতে পারেনি।
মূল্যায়ন
পরিশেষে যায় যে, ভারত পাশ্চাত্য অর্থে কোনোদিনই নেশন ছিল না। ভারতের জাতিগত সমস্যাকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু তিনি মনে করতেন, ভারত সামাজিক বিধিব্যবস্থার মাধ্যমে সেই জাতিগত সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছিল। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রতন্ত্রের মতো চরম রাষ্ট্রীয় আধিপত্য ভারত-সহ প্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলিতে কখনও লক্ষ্য করা যায় নি। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল, মানবজাতির আত্মিক সৌহার্দ্য ও বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা। তিনি স্বজাতির মধ্য দিয়ে সর্বজাতির এবং সর্বজাতির মধ্য দিয়ে স্বজাতির সত্যরূপকে উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন, ভারত এমতাবস্থায় পশ্চিমি সভ্যতাকে, না পশ্চিমি সংস্কৃতিকে গ্রহণ করবে- তা ঠিক করা উচিত। তাঁর অভিমত অনুসারে, দানবরূপী নেশনকে গ্রহণ করা ভারতের পক্ষে কখনোই সুখপ্রদ হবে না। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে উগ্র মানসিকতার অনুপ্রবেশকে রবীন্দ্রনাথ ‘আন্তর্জাতিক দুষ্প্রবৃত্তির স্বদেশি সংস্করণ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি মনে করতেন এরূপ উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে পাথেয় করে কখনোই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরোধিতা করা সম্ভব নয়।*
জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রভাবনার প্রভাব আলোচনা করো
জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রভাবনার প্রভাব
রবীন্দ্রনাথের ‘ন্যাশনালিজম’ শীর্ষক গ্রন্থটিতে তাঁর জাতীয়তাবাদী ভাবনা, যুদ্ধ সম্পর্কিত আত্মোপলব্ধি এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থান বিশ্বমানবচেতনাকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “কবির ন্যাশনালিজম বিরোধী বক্তৃতাগুলি লইয়া জাপানে আমেরিকায় ও য়ুরোপে যেরূপ বিরুদ্ধ সমালোচনা হইয়াছিল, বোধহয় তাঁহার আর কোনো গ্রন্থ সম্বন্ধে তাহা হয় নাই। ‘ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থটি ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়, ফরাসি দেশে ইহার অনুবাদ হয় অনেক পরে। শোনা যায়, যুদ্ধের মধ্যে ট্রেঞ্চে-ট্রেঞ্চে টাইপ করা কপি সৈনিকদের মধ্যে চালাচালি হইত। Max Plowman নামে একজন তেজস্বী ইংরেজ যুবক ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধে যোগদান করেন, কিন্তু ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘ন্যাশনালিজম’ পাঠ করিয়া তাঁহার জীবনের আমূল পরিবর্তন হয়। তিনি যুদ্ধ করিবেন না স্থির করায় সমরবিভাগীয় শাস্তি তাঁহাকে ভোগ করিতে হয়।” এ ছাড়াও ওই সময় রবীন্দ্রনাথের ইউরোপীয় ন্যাশনালিজম- এর উপর প্রদত্ত বক্তৃতাগুলি অধ্যয়ন করার পর ফরাসি মনীষী রোমাঁ রোলাঁ তাঁর প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে রোমাঁ রোলাঁ চিন্তা স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করার দাবি নিয়ে যখন বুদ্ধিজীবীদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছিলেন, তখন রবীন্দ্রভাবনাই তাঁর মনে সর্বপ্রথম এসেছিল। তাছাড়া লেনিন-এর ব্যক্তিগত গ্রন্থশালায় যে-কটি রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ-পুস্তক ছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘ন্যাশনালিজম’ শীর্ষক গ্রন্থটি। জার্মান ভাষায় অনূদিত এই গ্রন্থটির সংস্করণের বেশ কয়েকটি লাইনের নিম্নভাগে তাঁর নিজের হাতে দাগ দেওয়ার চিহ্ন রয়েছে। এই সকল ঘটনাবলি থেকেই ‘ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থটির বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা প্রমাণিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ন্যাশনালিজম সম্পর্কিত ধারণাটির সীমাবদ্ধতা আলোচনা করো
রবীন্দ্রনাথ এর ন্যাশনালিজম সম্পর্কিত ভাবনার সীমাবদ্ধতা
রবীন্দ্রনাথ এর জাতীয়তাবাদী ভাবনা সমালোচনার উর্ধ্বে ছিল না। তাঁর ন্যাশনালিজম ধারণাটি প্রসঙ্গে যে সমালোচনাগুলি করা হয়ে থাকে, সেগুলি হল-
(i) রবীন্দ্রগবেষক নেপাল মজুমদার তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ-এর প্রথম খণ্ডে বলেছেন, ন্যাশনালিজম প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ধারণাটি সামগ্রিকভাবে সত্য এবং অভ্রান্ত হলেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কখনোই বিজ্ঞানসম্মত ছিল না। কারণ তিনি (নেপাল মজুমদার) মনে করেছিলেন যে জাতীয়তাবাদ, জাতিরাষ্ট্র, একচেটিয়া পুঁজিবাদ এবং সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদ-এই পৃথক ধারণাগুলিকে রবীন্দ্রনাথ অভিন্ন বলে মনে করতেন এবং তাঁর ধারণায় ন্যাশনালিজম হল এগুলিরই মিলিত রূপ। আবার, পুঁজিবাদী আগ্রাসনের ক্রমবিকাশের জন্য তিনি ন্যাশনালিজমকেই দায়ী করেছিলেন। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ বিপরীত একটি ধারণা। কারণ, পুঁজিবাদের তাগিদেই জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল। বস্তুতপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ যে জাতীয়তাবাদী ধারণার অবতারণা করেছেন তা আসলে পশ্চিমি উদারনৈতিক পুঁজিবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদের সম্মিলিত রূপ।
(ii) দীর্ঘকাল যাবৎ পরাধীন ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলির যে প্রগতিশীল ভূমিকা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে ফুটে উঠেছিল, রবীন্দ্রনাথ তা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। এশিয়া ও আফ্রিকাকে তিনি পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির প্রভুত্বের ক্ষেত্র হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তাই জাতীয় আন্দোলনকে সমর্থন জানালেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সূচনা করার জন্য তিনি এই দেশগুলিকে আহবান জানাতে বা তাদের চেতনাকে জাগ্রত করতে পারেননি। অথচ এই রাষ্ট্রগুলির মুক্তিসংগ্রামের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ও মমত্ব ছিল অকুণ্ঠ এবং নির্ভেজাল।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, সমকালীন পৃথিবী যে সময় উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মাদনায় উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদের উদগ্র কামনায় মেতে উঠেছিল, সেসময় রবীন্দ্রনাথ সমগ্র মানবজাতির ঐক্যচেতনার কথা ভেবেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, মানবজাতির আত্মিক সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ধারণায় নিজের জাতির মধ্যে সকল জাতির এবং সকল জাতির মধ্যে নিজের জাতির সত্য রূপটিকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার সীমাবদ্ধতা থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারণ তিনি পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যে জাতীয়তাবাদের উগ্র, বিকৃত ও নগ্ন রূপ দেখে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাই, তিনি এরূপ ন্যায়নীতি বর্জিত, আদর্শভ্রষ্ট জাতীয়তাবাদের ধ্বংসসাধন করতে চেয়েছিলেন এবং বিশ্ববাসীকে এক আদর্শনিষ্ট বিশ্বমানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি এক আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র-সমবায় প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন।
আরও পড়ুন – শিক্ষামনোবিজ্ঞান প্রশ্ন ও উত্তর