পুরুষার্থরূপে অর্থের বিষয়টি আলোচনা করো
পুরুষার্থরূপে অর্থ
ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে পুরুষার্থের চারটি মূলস্তম্ভের মধ্যে একটি হল অর্থ, যা মানবজীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নির্দেশ করে। অর্থ হল দ্বিতীয় পুরুষার্থ। অর্থ মূলত মানুষের জীবনের আর্থিক ও বস্তুগত দিকগুলিকে ইঙ্গিত করে। মানুষের জীবনের বিভিন্ন কামনা-বাসনা পূরণের জন্য, বিভিন্ন সামাজিক কর্তব্য পালনের জন্য, এমনকি ধর্মাচরণের জন্যও অর্থের প্রয়োজন হয়।
অর্থ পুরুষার্থের প্রয়োজনীয়তা
অর্থ ব্যতীত মানুষের ঐহিক জীবনযাত্রা নির্বাহ করা যে দুষ্কর সে বিষয়ে আমরা অজ্ঞ নই। সহজ কথায় ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণের জন্য অর্থ যে এক আবশ্যিক উপাদান, সেই বিষয়ে নিম্নে আলোচনা করা হল-
অর্থ জীবিকা অর্জনের উপায়
ধনসম্পদ, বিষয়সম্পত্তি প্রভৃতি যা আমাদের ভোগের বিষয় তা হল অর্থ। পুরুষার্থ প্রসঙ্গে অর্থ হল জীবিকা অর্জনের একটি উপায়। মহাভারতে অর্জুন ধর্ম, অর্থ, কাম-এই ত্রিবর্গের মধ্যে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন অর্থের উপর (“অর্থেভ্যো হি বিবৃদ্ধেভ্যঃ”)। অর্থ লাভের উপায়ের কথা বলতে গিয়ে মহাভারতে বলা হয়েছে, উত্থানশক্তির সাহায্যে অর্থ লাভ হয়। উত্থানশক্তি বলতে এখানে প্রচেষ্টাকে বোঝানো হয়েছে। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে এ কথা সমর্থন করে বলেছেন-প্রচেষ্টাই অর্থের মূল “অর্থস্য মূলম্ উত্থানম্”)।
অর্থ ইষ্ট সাধনের উপায়
অর্থ ইষ্ট সাধনের উপায়। সেই কারণে ব্যাবহারিক প্রয়োজন ব্যতিরেকে অর্থের আর কোনো দরকার নেই। অর্থাৎ শুধুমাত্র অর্থের জন্য অর্থকে কামনা করা যায় না। তাই অর্থ স্বতঃমূল্যবান নয়। ভোগ সুখের জন্য অর্থকে কামনা করা হয় বলে অর্থকে পরতমূল্যবান বলা হয়। সংসার প্রতিপালনের জন্য অর্থ অবশ্যই দরকার। কিন্তু সেই অর্থ ন্যায়সম্মতভাবে উপার্জন করে যদি নিজের ও জনহিতের জন্য ব্যয় করা হয় তবেই তা পুরুষার্থরূপে গণ্য হবে। আবার অপরকে প্রতারণা করে কিংবা নিজের সুখ-সম্ভোগের জন্য উপার্জিত অর্থকে ব্যয় করলে সেই অর্থ পুরুষার্থরূপে গণ্য হয় না।
জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ
ব্যক্তির মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণের জন্য অর্থের প্রয়োজন। যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের জন্য অর্থ অপরিহার্য তেমনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি গৌণ চাহিদাগুলি পূরণের জন্যও অর্থের বিকল্প কিছু নেই। এককথায় অর্থের সাহায্যেই ব্যক্তি নিজের তথা পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলি পূরণ করতে পারে। সুতরাং অর্থ ব্যক্তিকে আত্মনির্ভরশীল করে, যা ব্যক্তিকে মানসিক শান্তি দেয় ও আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করে।
অর্থের উপর ধর্মের নিয়ন্ত্রণ
অর্থের সংযত ব্যবহারের জন্য ধর্মের নিয়ন্ত্রণ একান্ত প্রয়োজন। অর্থকে কামনা করা হয় দুটি পুরুষার্থের (ধর্ম ও কাম) জন্য। সংসার ধর্ম পালনের জন্য যেমন অর্থের প্রয়োজন তেমনি শাস্ত্রবিহিত অনুষ্ঠানের জন্যও অর্থের প্রয়োজন। সুতরাং অর্থ কাম্যবস্তু হলেও তাকে সৎপথে অর্জিত হতে হবে। এমন অর্থকে বৈধ অর্থ বলে। সুতরাং সৎ পথে অর্জিত বা সঞ্চিত অর্থ যা মানুষের কোনো অনিষ্টের হেতু হয়নি, সেই বৈধ অর্থকে প্রকৃত অর্থও বলে।
পরিশেষে বলা যায়, দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের জন্য যতটা অর্থের দরকার তার বেশি অর্থ সঞ্চয় করা উচিত নয়। ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য যেটুকু অর্থ প্রয়োজন ততটুকুই অর্থই আমাদের কাম্য হওয়া উচিত। সহজ কথায়, অসংযত অর্থ উপার্জন যেমন কাম্য নয় তেমনি নিজের প্রয়োজনের স্বার্থে বা পরার্থে ব্যয় না করলে বা কার্পণ্য করলে মানুষের সামাজিক সত্ত্বা ক্ষুণ্ণ হয়।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ