চতুর্বর্গ পুরুষার্থের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সংক্ষেপে লেখো
পুরুষার্থ
‘পুরুষার্থ’ শব্দটি ‘পুরুষ’ এবং ‘অর্থ’ এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ‘পুরুষ’ বলতে সকল মানুষকে বোঝানো হয়েছে। আর ‘অর্থ’ হল প্রীত বিষয় বা ঈঙ্গিত বিষয়। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে যা আমাদের ঈপ্সিত বা কাম্যবস্তু তাই পুরুষার্থ। ভারতীয় নীতিতত্ত্বে চতুর্বিধ পুরুষার্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা- ধর্ম, অর্থ, কাম ও
মোক্ষ। এদের একত্রে চতুর্বর্গ পুরুষার্থ বলা হয়। আর ধর্ম, অর্থ ও কামকে ত্রিবর্গ পুরুষার্থ বলা হয়।
ধর্মের সঙ্গে মোক্ষের সম্পর্ক
ধর্ম একটি নৈতিক বিধি যা মানুষের আচরণকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি ব্যক্তিকে সমাজ কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করে। সহজ কথায় ধর্ম হল সেই ধরনের নিয়ম-শৃঙ্খলা, যা মানুষের মধ্যে শুভ চেতনা তৈরি করে এবং মোক্ষলাভের পথকে প্রশস্ত করে।
অর্থের সঙ্গে ধর্ম ও কামের সম্পর্ক
অর্থ ব্যক্তিকে বস্তুগত আরাম প্রদান করে। আর এই অর্থের সংযত ব্যবহারের জন্য ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ একান্ত প্রয়োজন। অর্থকে কামনা করা হয় দুটি পুরুষার্থের (ধর্ম ও কাম) জন্য। সংসার ধর্ম পালনের জন্য (কাম) যেমন অর্থের প্রয়োজন তেমনি শাস্ত্রবিহিত অনুষ্ঠানের জন্যও (ধর্ম) অর্থের প্রয়োজন। সেজন্য অর্থকে সৎপথে অর্জিত হতে হবে।
কামের সঙ্গে অর্থ ও ধর্মের সম্পর্ক
কাম নিজে সুখস্বরূপ হলেও তা সুখলাভের উপায় নয়। কাম ব্যতীত গৃহস্থের বংশরক্ষা হয় না তেমনি অর্থ ভিন্ন সংসার জীবন পালন সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের অর্থ ও কামের প্রতি একটি স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা বর্তমান। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষা মোক্ষলাভের প্রধান বাধা। তাই প্রত্যেকের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মসংযমের প্রয়োজন, সেজন্য ধর্মের দ্বারা অর্থ ও কাম নিয়ন্ত্রণের কথা ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে বলা হয়েছে।
ত্রিবর্গ পুরুষার্থের সঙ্গে মোক্ষের সম্পর্ক
মোক্ষই একমাত্র নিত্য সুখস্বরূপ। তাই মোক্ষই হল পরমপুরুষার্থ। ধর্ম, অর্থ ও কাম -এই ত্রিবর্গের সাধনা ছাড়া মোক্ষলাভে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। “Artha, Kama and Dharma are instrumental values, but at the same time essential methods for the attainment of Moksha” অর্থাৎ অর্থ ও কামের মতো ধর্মও পরতঃমূল্যবান পুরুষার্থ। স্বতঃমূল্যবান পরমপুরুষার্থ ‘মোক্ষ’ লাভের আবশ্যিক উপায় হিসেবেই ‘ধর্ম’ প্রয়োজনীয়। কাম মানুষকে কর্মে প্রবৃত্ত করে, কামের ফলে আসে সংকল্প, তার থেকে আসে প্রযত্ন আবার সংকল্পের মধ্যে প্রযত্ন শৃঙ্খলিত হলে সেই কর্মই অর্থকে বহন করে নিয়ে আসে। সংকল্প, প্রবৃত্তি, প্রযত্ন- এগুলি ব্যতিরেকে মোক্ষলাভে প্রয়াসী হওয়া যায় না। মোক্ষকামী ব্যক্তিই একমাত্র মোক্ষলাভের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। কিন্তু যার মুক্তির প্রতি ইচ্ছা নেই, প্রবৃত্তি নেই, সংকল্প নেই, সে কখনও মোক্ষলাভের চেষ্টাই করে না।
উক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এদের কোনোটিকে বাদ দিয়ে কোনোটিকে পালন করা সম্ভব নয়। ধর্মাচরণ করতে হলেও কামনা-বাসনা প্রয়োজন হয়। এমনকি অর্থেরও প্রয়োজন হয়। তাই ধর্মের উপাদান শুধু চিন্তন নয়, সেই সঙ্গে অনুভূতি এবং ইচ্ছাও বটে। এককথায় ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বর্তমান।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ