পুরুষার্থ কী? ভারতীয় নীতিবিদ্যায় কয় প্রকার পুরুষার্থ স্বীকার করা হয়েছে? আলোচনা করো

পুরুষার্থ কী? ভারতীয় নীতিবিদ্যায় কয় প্রকার পুরুষার্থ স্বীকার করা হয়েছে? আলোচনা করো

পুরুষার্থ কী? ভারতীয় নীতিবিদ্যায় কয় প্রকার পুরুষার্থ স্বীকার করা হয়েছে? আলোচনা করো
পুরুষার্থ কী? ভারতীয় নীতিবিদ্যায় কয় প্রকার পুরুষার্থ স্বীকার করা হয়েছে? আলোচনা করো

পুরুষার্থ

বেদভিত্তিক ভারতীয় দর্শন গভীরভাবে আধ্যাত্মিক এবং তা সর্বদা তত্ত্বোপলব্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। ভারতীয় নীতিবিদ্যায় এক পরাতাত্ত্বিক (Metaphysical) আদর্শের পটভূমিতে মানুষের নৈতিকতাকে বিচার করা হয়। সাধারণত কিছু সামাজিক আদর্শ ভারতীয় জনমানসকে নৈতিকতার পথ দেখিয়েছে। এই সকল আদর্শকে বলা হয় ‘পুরুষার্থ’।

পুরুষার্থের অর্থ

‘পুরুষার্থ’ কথাটি ‘পুরুষ’ এবং ‘অর্থ’ এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ‘পুরুষ’ বলতে মানুষকে বোঝানো হয়েছে। আর ‘অর্থ’ হল প্রীত বিষয় বা ঈপ্সিত বিষয়। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে যা আমাদের ঈপ্সিত বা কাম্যবস্তু তাই পুরুষার্থ। পুরুষার্থ হল মানব জীবনের লক্ষ্য।

জৈমিনির মতে পুরুষার্থ

বৈদিক দৃষ্টিতে জীবনের লক্ষ্য (পুরুষার্থ) ভোগ নয়, ত্যাগ। আসক্তি নয়, বৈরাগ্য বা অনাসক্তি। এই প্রসঙ্গে মহর্ষি জৈমিনি তাঁর ‘মীমাংসাসূত্র’ গ্রন্থে বলেছেন- “যস্মিন্ প্রীতিঃ পুরুষস্য তস্য লিঙ্গার্থলক্ষণম অবিভক্তত্বাৎ।”অর্থাৎ যে বিষয়ে মানুষের প্রীতি হয়, তাই পুরুষার্থ, তার যে লিপ্সা বা অনুষ্ঠান তা অর্থত অর্থাৎ স্বাভাবিক অনুরাগবশত প্রাপ্ত।

পুরুষার্থের প্রকার

কাম্যবস্তু মনে করে মানুষ যাকে কামনা করে সেটাই মানুষের জীবনের পুরুষার্থ। সাধারণত দুঃখনিবৃত্তি ও সুখপ্রাপ্তিই পুরুষ প্রার্থনা করে। তাই চিরাচরিতভাবে ভারতীয় নীতিতত্ত্বে চতুর্বিধ পুরুষার্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা- ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ।

এখন আমরা চারটি পুরুষার্থ সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করব-

ধর্ম

পুরুষার্থ সমূহের মধ্যে ধর্ম সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ‘ধর্ম’ শব্দের একটি প্রাচীন অর্থ হল “ধারণাৎ ধর্মম্ ইত্যাহুঃ” অর্থাৎ ধর্ম তাই যা মানুষ ও সমাজকে ধারণ বা রক্ষা করে। ‘ধৃ’ ধাতুর সঙ্গে ‘মন’ প্রত্যয় যোগে ‘ধর্ম’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ধূ+মন ধর্ম। বেদে ধর্ম বলতে অলঙ্ঘনীয় নিয়মকে বোঝানো হয়েছে। পুরাণে ধর্মের দুটি অর্থের উপর আলোকপাত করা হয়েছে-

(i) ধর্ম হল তাই যার থেকে পার্থিব ও অপার্থিব সম্পদ উভয়ই পাওয়া যায়। (ii) ধর্ম হল তাই, যা ধারণ করে অর্থাৎ স্থিতি যার উপর নির্ভরশীল। ধর্মের মূল তাৎপর্য হল নৈতিক পবিত্রতা- যা পরবর্তী জীবনে ফল দান করে। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, ধর্মই একমাত্র সুহৃদ, যে মৃত্যুর পরেও অনুসরণ করে। শরীর ধ্বংস হয়ে গেলে বন্ধুরাও মৃত শরীর বলে তা পরিত্যাগ করে চলে যায়। ধর্ম তখনও (মৃতব্যক্তির) অনুগামী হয়। মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে-

"বেদঃ স্মৃতি সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ।
এতচ্চতুর্বিধং প্রাহুঃ সাক্ষাৎ ধর্মস্য লক্ষণম্।।” (২/২১)

অর্থ

বৈদিক ধর্মনীতিতে দ্বিতীয় পুরুষার্থরূপে অর্থ স্বীকৃত হয়েছে। অর্থ ব্যতীত মানুষের ঐহিক জীবনযাত্রা নির্বাহ করা যে দুষ্কর সেই বিষয়ে মানুষ সচেতন। ভোগের উপায় হিসেবে ‘অর্থ’ হল মানবজীবনের কাম্য বিষয়। বিদ্যা, ভূমি, হিরণ্য, পশু, ধান্য প্রভৃতির অর্জন ও অর্জিতের বিবর্ধনকে বলা হয় অর্থ। পুরাণে বলা হয়েছে- কাম্যবস্তু হলেও অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জন ও রক্ষণ সমাজকে কলুষিত করে। এ কথা সত্য যে, সমাজের সকল স্তরের মানুষেরই অর্থের প্রয়োজন। ভারতীয় চিন্তার মূলকথা হল অর্থই জীবনের পরমার্থ নয়, বরং পরমার্থ সিন্ধির একটি উপায়।

অর্থের সংযত ব্যবহারের জন্য ধর্মের নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। অর্থ যখন ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তখনই তা পরমপুরুষার্থ মোক্ষের অভিমুখে এগিয়ে যায়। অর্থাৎ মোক্ষই সেই আদর্শ যা অর্থলাভকে সার্থক করতে পারে।

কাম

বৈদিক ধর্মনীতি বাস্তবমুখী, সেই কারণে ঐহিক জীবনে মানুষের ভোগপ্রবণতা সহজাত বৃত্তিরূপে গৃহীত হয়েছে। ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ের প্রতি মানুষের গভীর আকর্ষণ মানুষকে ভোগের দিকে টেনে নিয়ে যায়। লৌকিক সুখের স্বরূপ হল কাম, তাই কামনা বাধাপ্রাপ্ত হলে বা পূরণ না হলে দুঃখ অনিবার্য।

‘কাম’ বলতে জাগতিক যে-কোনো বস্তুর প্রতি আকাঙ্ক্ষাকে বোঝায়। পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় এবং মনের উপভোগ্য বিষয়কে পেয়ে যে সুখলাভ হয়, তাকে বলা হয় কাম। কাম দু-প্রকার কাম্যবস্তুর উপভোগ এবং স্ত্রী-পুরুষের মিলনসুখ। ভারতীয় ঋষিদের মতে, বিশুদ্ধ কামের উপভোগ পরিণামে ত্যাগের পথ প্রশস্ত করে।

ভারতীয় চিন্তায় কাম নিন্দনীয় নয়, বরঞ্চ সংযত ও সীমিত কাম মনুষ্যত্ব বিকাশে সমর্থনীয়। মানুষ একাধারে নরদেবতা, অন্যদিকে নরনারায়ণ। মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশে এ দুটি সত্তার লালন ও পরিচর্যার প্রয়োজন। অসংযত অমিতাচার কাম পুরুষার্থ নয়, নীতিসম্মত ও শাস্ত্রবিহিত কামই পুরুষার্থ।

মোক্ষ

মোক্ষ বা মুক্তির ধারণা ভারতীয় দর্শনের অনবদ্য অবদান, যা এই দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। চার্বাকপন্থী ব্যতীত অন্যান্য আস্তিক ও নাস্তিক সকল সম্প্রদায়ের ভারতীয় দার্শনিকেরা পরমপুরষার্থরূপে মোক্ষ স্বীকার করেছেন। আত্মার সত্য পরিচয় অনুসন্ধান করে সেই আলোকে জীবনধারণ করা, সেই শক্তিতে আন্তর ও বাহ্যজগৎকে নিয়ন্ত্রণ করা, আত্মার সত্য ও শক্তিকে সমস্ত জীবনে প্রতিষ্ঠা করাকেই বলা হয় মোক্ষ। মোক্ষ হল চতুর্বর্গ পুরুষার্থের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পুরুষার্থ। ধর্ম, অর্থ ও কাম সাক্ষাৎ সুখ নয়, সুখের হেতু। কিন্তু মোক্ষ সাক্ষাৎ সুখস্বরূপ।

ভারতীয় চিন্তাধারায় মোক্ষ লাভের উপায় হিসেবে তিনটি মার্গের কথা বলা হয়েছে। যথা- জ্ঞানমার্গ, কর্মমার্গ ও ভক্তিমার্গ। জ্ঞানযোগের সার কথা হল- ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা জীব এই জন্মেই মোক্ষ লাভ করতে পারে। কর্ম বর্জন করে মোক্ষ লাভ করা যায় না। নিষ্কাম কর্ম মোক্ষপ্রাপ্তিতে সহায়ক। আর ভক্তিযোগ বলতে বোঝায় ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি অর্থাৎ ঈশ্বর প্রাপ্তিই মোক্ষ। মোক্ষের স্বরূপ সম্পর্কে ভারতীয় দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ আছে।

আমাদের দৈনন্দিন ও ঐহিক জীবন হল অধ্যাত্মপথের সোপান মাত্র, যার মাধ্যমে আমরা মোক্ষ নামক পরমপুরুষার্থকে লাভ করতে পারি। প্রায় সমস্ত ভারতীয় দার্শনিকদের মতে, মোক্ষ হল মানুষের অবিদ্যাজনিত দুঃখ থেকে পরিত্রাণের উপায়।

আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ

পদ, বাক্য, বচন, পদের ব্যাপ্যতা, সত্যতা ও বৈধতা প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment