ছুটি গল্পের প্রশ্ন উত্তর class 11 বাংলা দ্বিতীয় সেমিস্টার
১। “বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট্ করিয়া একটা নূতন ভাবোদয় হইল;”-উৎস লেখো? ফটিক কে? তার কী নতুন ভাবোদয় ঘটল?
আলোচ্য অংশটি বিশ্ববরেণ্য কবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে।
ছুটি গল্পের প্রধান চরিত্র, বারো-তেরো বছর বয়সের দুরন্ত, প্রাণচঞ্চল বালক হল, ফটিক।
সদাচঞ্চল, দুরন্ত, দামাল ফটিক, বালকদলের সর্দার। নতুন নতুন খেলা আবিষ্কার করে অনাবিল আনন্দ উপভোগ করবার জন্য ফটিকের মনে এক নতুন ভাবোদয় ঘটেছিল। নদীর ধারে পরে থাকা একটা প্রকান্ড শালকাঠের গুড়ি মান্ডুলে পরিণত হওয়ার জন্য পড়ে ছিল। সেই শালকাঠকে ঠেলে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়াই ছিল ছেলেদের নতুন খেলা। আর এই নতুন খেলার উপায় বার হয়েছিল দুষ্টু ফটিকের মাথা থেকেই।
২। “ছেলেরা তাহার এইরূপ উদার ঔদাসীন্য দেখিয়া কিছু বিমর্ষ হইয়া গেল।”-উৎস লেখো। ‘তাহার’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? ‘ছেলেরা’ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে? ছেলেদের বিমর্ষ হওয়ার কারণ কী?
আলোচ্য উদ্ধৃতাংশটি বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বিখ্যাত ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে নেওয়া হয়েছে।
তাহার’ বলতে ফটিকের ছোটো ভাই মাখনলালকে বোঝানো হয়েছে। ‘ছেলেরা’ বলতে বোঝানো হয়েছে নদীর ধারে খেলায় রত বালকদের, যাদের মধ্যে ফটিক ও তার ভাই মাখনলালও ছিল।
নদীর ধারে পড়ে থাকা শালকাঠের গুঁড়িকে ঠেলে ঠেলে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার মজাদার খেলায় রত হয়েছিল ছেলের দল। ফটিকের নেতৃত্বে তারা সেই শালকাঠকে ঠেলে অন্যত্র নিয়ে যাবার খেলায় আয়োজন করলে তাতে বাধা দেওয়ার জন্য মাখন শালকাঠের গুঁড়ির ওপর বসে পড়ে। ফলে খেলার সাময়িক বিরতি ঘটে। অনেকবার বলার সত্ত্বেও মাখন তার জেদের বশে সেই কাঠের গুঁড়ি থেকে নামে না। তার উদ্দেশ্য ছিল এই খেলা বন্ধ করা। মাখন গুঁড়ির ওপর বসে থাকলে আর মজার খেলা হবে না। তাই ছেলেরা বিমর্ষ হয়েছিল।
৩। “দেখ, মার খাবি। এইবেলা ওঠ।”-বক্তা কে? কাকে বলা হয়েছে? বক্তার এইরূপ বলার কারণ কী?
প্রকৃতিপ্রেমিক মানবতাবাদী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পে প্রধান চরিত্র ফটিক হল এই উক্তিটির বক্তা।
ফটিকের নিজের ছোটোভাই মাখনলালকে উদ্দেশ্য করে একথা বলা হয়েছে।
নদীর ধারে পড়ে থাকা শাল কাঠের গুঁড়িকে গড়িয়ে গড়িতে মজার খেলায় রত হয়েছিল ছেলের দল। এই দলের সর্দার ফটিকের নেতৃত্বে উদ্দাম ছেলের দল যখন কাঠের গুঁড়ি সরানোর মজার খেলা শুরু করে তখনই মাখনলাল তার অকাল তত্ত্বজ্ঞানী গম্ভীর রূপ নিয়ে তার উপর বসে পড়ে। ফলে খেলায় সাময়িক বাধার সৃষ্টি হয়। মাখনলালের বড়োদাদা এবং ছেলের দলের সর্দার হিসেবে নিজের ক্ষমতার আস্ফালন করতে ফটিক আলোচ্য উক্তিটি করেছিল। মজার খেলাকে সাবলীল করতে কাঠের গুঁড়ি থেকে মাখনলালকে নেমে আসার কথা বলা হয়েছে। মাখনলালের কারণে যদি খেলা বন্ধ হয় তবে ফটিকের হাতে সে মারও খাবে এ কথাও জানিয়ে দিয়েছে। আলোচ্য উক্তিটির মধ্য দিয়ে প্রাণচঞ্চল, উদ্দাম ফটিকের জেদ ও শাসন ফুটে উঠেছে।
৪। “এই অকাল-তত্ত্বজ্ঞানী মানব সকল প্রকার ক্রীড়ার অসারতা সম্বন্ধে নীরবে চিন্তা করিতে লাগিল।”-কে, কোন্ প্রসঙ্গে, কার সম্বন্ধে এ কথা বলেছে? তাকে ‘অকাল তত্ত্বজ্ঞানী’ বলা হয়েছে কেন?
পদ্মাপাড়ে সাধনা পর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটোগল্পগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটোগল্প হল ‘ছুটি’। ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র ফটিকের ভাই মাখনলাল সম্বন্ধে এ কথা বলা হয়েছে। ছেলের দল ফটিকের পরামর্শে নদীর ধারে পড়ে থাকা শাল কাঠের গুঁড়িকে ঠেলে ঠেলে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার মজার খেলায় রত হতে চাইলে, সেই খেলায় বাধা দেওয়ার জন্য মাখনলাল কাঠের গুঁড়ির ওপর গম্ভীর ভাব নিয়ে বসে পড়ে। এই প্রসঙ্গে আলোচ্য উক্তিটি করা হয়েছে।
সাধারণভাবে মাখনলালের মতো বয়সি ছেলেরা দুরন্ত, প্রাণচঞ্চল, অবাধ্য হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মাখনলালকে লেখক অকাল তত্ত্বজ্ঞানী বলেছেন কারণ, সে তার স্বভাববিরুদ্ধ হয়ে অন্যান্য ছেলেদের মতো উদ্দাম, উচ্ছৃঙ্খল খেলায় মত্ত হয়নি। এই ধরনের খেলায় যোগ দিতে সে কোথাও আগ্রহও দেখায়নি। বরং খেলায় যোগ না দিয়ে খেলাকে বন্ধ করার জন্য কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে অকাল তত্ত্বজ্ঞানীর মতো গভীর সংসারের চিন্তায় মগ্ন হয়েছে। এই উক্তিটির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিহাসপ্রিয়তার পরিচয় দিয়েছেন।
৫। “সে তাহাতে আরো একটু নড়িয়াচড়িয়া আসনটি বেশ স্থায়ীরূপে দখল করিয়া লইল।”-‘সে’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সাধনা পর্বের বিখ্যাত ‘ছুটি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিকের ছোটোভাই মাখনলালকে ‘সে’ বলা হয়েছে।
‘ছুটি’ গল্পের সূচনাতেই দেখা যায়, ছেলের দল নদীর ধারে পড়ে থাকা শাল কাঠের গুঁড়িকে গড়িয়ে গড়িয়ে এক মজার খেলার কৌশল বের করে তা খেলতে আগ্রহী। এই ছেলের দলের সর্দার ফটিক। এই অভিনব খেলার কৌশল তারই মস্তিষ্কপ্রসূত। ছেলের দল সবাই এই খেলায় আগ্রহী হলেও ফটিকের নিজের ছোটোভাই মাখনলাল খেলায় বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে গুঁড়ির উপর গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। মাখনলাল তার সমবয়সি সাধারণ ছেলেদের মতো দুরন্ত, চঞ্চল হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অকাল তত্ত্বজ্ঞানী মাখনলাল তার বয়সবিরুদ্ধ কাজ করে এই খেলায় বাধা দিতে চেয়েছে। সর্দার ফটিক তাকে নানাভাবে ভয় দেখিয়েও নিরস্ত করতে পারেনি। ছেলেদের ও ফটিকের অনুরোধ, ভীতিপ্রদর্শন সবকিছুকে উপেক্ষা করে মাখনলাল আরও দৃঢ়ভাবে, স্থায়ীভাবে কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে থাকে।
৬। “তাহাতে আর একটু বেশি মজা আছে।”-উৎস নির্ণয় করে তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদ্মাপাড়ে সাধনা পর্বে লেখা ‘ছুটি’ ছোটোগল্প থেকে আলোচ্য উক্তিটি নেওয়া হয়েছে।
নদীর ধারে পড়ে থাকা শাল কাঠের গুঁড়িকে ঠেলে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার মজার খেলার আয়োজনে ফটিকসহ সব ছেলের দল বেশ উত্তেজিত ও আনন্দিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তাদের আনন্দে ও খেলায় বাধা দেওয়ার জন্য মাখন কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে পড়েছিল। ফটিকসহ অন্যান্য ছেলেরা মাখনকে অনেক অনুরোধ করলেও নিজের জেদের দ্বারা চালিত মাখন কিছুতেই কাঠের গুঁড়ি থেকে নামেননি। শৈশবের স্বাভাবিক চাপল্যবর্জিত মাখন অকাল তত্ত্বজ্ঞানীর মতো বসে থাকার ফলে খেলার আনন্দ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু দস্যিছেলে ফটিককে দমানো কার সাধ্য। প্রথমে মায়ের ভয়ে ভাইকে অনুরোধ করলেও শেষ পর্যন্ত মাখনসহ কাঠের গুঁড়ি ঠেলার পরিকল্পনা করে। তাতে আরও বেশি মজা আছে। কাঠের গুঁড়িকে গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মাখনও অনিবার্যভাবে মাটিতে পড়বে এই ভেবেই তাদের মজা আরও বৃদ্ধি পায়। দস্যি দামাল ফটিকের উপস্থিত মজার বুদ্ধি প্রশংসা করার মতো।
৭। “একেবারে অন্ধভাবে মারিতে লাগিল।”-কে, কাকে, কেন মারিতে লাগল? উক্ত চরিত্রের কোন্ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়?
আলোচ্য উক্তিটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে নেওয়া হয়েছে।
আলোচ্য অংশে মাখনলাল, তার দাদা ফটিককে মারতে লাগল।
নদীর ধারে এক শাল কাঠের গুঁড়িকে ঠেলে ঠেলে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ভিন্ন এক মজার খেলার কৌশল ফটিকসহ ছেলের দল আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু সেই খেলাতে বাধা সৃষ্টি করার জন্য ফটিকের নিজের ছোটোভাই মাখনলাল কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে পড়ে। অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও সে কাঠের গুঁড়ি থেকে নামতে রাজি না হওয়ায় ছেলের দলের খেলার আনন্দ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এমত অবস্থায় ফটিকের পরামর্শে মাখনসহ কাঠের গুঁড়ি ঠেলার পরিকল্পনা করা হয়। তাতে আরও বেশি আনন্দ। মাখনসহ কাঠের গুঁড়ি ঠেলার সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্যভাবে মাখন মাটিতে পড়ে যায়। নিজের জেদকে চরিতার্থ করতে না পেরে রাগবশত ফটিককে অন্ধভাবে মারতে থাকে।
মাখন, ফটিকের নিজের ভাই হলেও চরিত্রগত দিক দিয়ে সে একেবারে ফটিকের বিপরীত। শৈশবের চাপল্য তার মধ্যে নেই। তাই লেখক তাকে ‘অকাল তত্ত্বজ্ঞানী’ বলে পরিহাস করেছেন। খেলার আনন্দে আনন্দিত হওয়ার পরিবর্তে মাখন খেলা ভন্ডুল করতে বেশি আগ্রহী। মাখন জেদি তাই সবাই তাকে অনুরোধ করলেও সে কাঠের গুঁড়ি থেকে নামে না। নিজের জেদের কাছে পরাজিত হলে অপমানজনিত কারণে ফটিককে মারতে থাকে।
৮। “ওমা, এ যে দাদা, তুমি কবে এলে।”-বক্তা কে? দাদার নাম কী? তাঁর আসার ইতিহাসটি বর্ণনা করো।
আলোচ্য অংশটির বক্তা হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধনা পর্বের বিশেষ পরিচিত ছোটোগল্প ‘ছুটি’-র কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিকের মা।
দাদার নাম হল বিশ্বম্ভরবাবু।
বিশ্বম্ভরবাবু কাজের জন্য অনেক দিন পশ্চিমে ছিলেন। তারপর তিনি কলকাতায় এসে বোনের ভাগ্যবিপর্যয়ের কথা শুনে গ্রামের বাড়িতে তাকে দেখতে এসেছিলেন। গ্রামের ঘাটে এসে তিনি ফটিকের কাছে তাদের বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলে দুরন্ত বালক বিশ্বম্ভরবাবুকে ভুল রাস্তা দেখায়। শেষে গ্রামের অন্যান্য লোকের সাহায্যে তিনি ফটিকদের বাড়ি এসে পৌঁছান।
৯। “কিছুদিন খুব সমারোহে গেল।”-উৎস নির্দেশ করে প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করো।
আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সাধনা পর্বের উল্লেখযোগ্য বহু পরিচিত ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে নেওয়া হয়েছে।
গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারে সদ্য বিধবা ফটিকের মা তার দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন। দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি বিব্রত। বিশেষ করে ফটিক অত্যন্ত দুরন্ত ও অবাধ্য। দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত ঝগড়া মারপিট লেগে থাকত। এইরকম এক অশান্ত পরিবেশে ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবুর আগমন ঘটে। বিধবা ফটিকের মা নিজের দাদাকে দেখে আশ্বস্ত হন। অভিভাবকহীন ফটিকদের পরিবার বিশ্বম্ভরবাবুকে পেয়ে অভিভাবকত্বের ছায়ায় কিছুদিন আনন্দে কাটান। যতদিন বিশ্বম্ভরবাবু ছিলেন ততদিন তাদের খুব আনন্দ-সমারোহে দিনগুলি কেটেছিল-আলোচ্য অংশে এই কথাই বলা হয়েছে।
১০। “বিধবা এ প্রস্তাবে সহজেই সম্মত হইলেন।”-বিধবা মহিলার পরিচয় দাও। তিনি কার, কোনো প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলেন? কেন সম্মতি দিয়েছিলেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধনা পর্বের লেখা ‘ছুটি’ গল্পের আলোচ্য অংশে উক্ত বিধবা মহিলাটি হলেন ফটিকের মা।
দীর্ঘদিন পশ্চিমে কাটানোর পর বিশ্বম্ভরবাবু বোনের বিপর্যয়ের কথা শুনে তাদেরকে দেখতে আসেন। বোন এবং বোনের সন্তানদের প্রতি তার দয়ামায়া মমতাবোধ আছে। তিনি গ্রামের বাড়িতে বোনের কাছে এসে জানতে পারেন, স্বামীর অবর্তমানে দুই সন্তানকে নিয়ে তার বোন বিব্রত। বিশেষ করে ফটিক দুরন্ত, অবাধ্য এবং পড়াশোনায় একেবারে অমনোযোগী। বোনের সামান্য সাহায্যের জন্য এবং ফটিকের ভালো ভবিষ্যতের জন্য তিনি ফটিককে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। সহায়সম্বলহীনা বিধবা ফটিকের মা ফটিকের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে দাদা বিশ্বম্ভরবাবুর এই প্রস্তাবে সম্মতি দেন।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংসারের ব্রাহ্মণ বিধবা ফটিকের মা তার দুই সন্তান ফটিক ও মাখনকে নিয়ে খুবই বিব্রত ছিলেন। দুই ভাই চরিত্রগতভাবে
আলাদা, তাই তাদের মধ্যে কোনো সদ্ভাব ছিল না। উপরন্তু তাদের প্রতিনিয়ত ঝগড়া মারামারি লেগেই থাকত। মাখন পড়াশোনায় মনোযোগী, তাই মা সবসময় তার পক্ষ নিতেন। অন্যদিকে ফটিক দুরন্ত এবং পড়াশোনার প্রতি একেবারে উদাসীন ও অমনোযোগী। তাই দাদা বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইলে তিনি রাজি হন। ফটিকের লেখাপড়ার জন্য – এবং মূলত তার চঞ্চলতাকে কমাতে তার সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে ফটিকের মা, দাদা বিশ্বম্ভরবাবুর সঙ্গে ফটিককে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবে সম্মতি দেন। তা ছাড়া ফটিকেরও আগ্রহ ছিল এবং দাদা – বিশ্বম্ভরবাবুর সদাশয়তা সম্বন্ধে তাঁর কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু ভাইকে চিনলেও ভ্রাতৃবধূকে তিনি ঠিকমতো চেনেননি। চিনলে তার সন্তানের অকালে ঝরে যাওয়ার পথকে তিনি সহজ করতেন না, ফটিককে তিনি কখনোই কলকাতায় পাঠাতেন না।
১১। “তাঁহার মনে সর্বদাই আশঙ্কা ছিল”-‘তাহার’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? তার আশঙ্কাগুলি কী ছিল?
আলোচ্য উক্তিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পের অন্তর্গত। ‘তাহার’ বলতে এখানে সহায়সম্বলহীন, বিধবা, দরিদ্র ফটিকের মায়ের কথা বলা হয়েছে।
ফটিকের মা সদ্য স্বামীহারা। তার উপরে তার দুই সন্তান মাখন ও ফটিক। দুই ভাই চরিত্রগত দিক থেকে আলাদা। ফটিক দুরন্ত, পড়াশোনায় অমনোযোগী কিন্তু সে সরল, সত্যবাদী ও মুক্তপ্রাণ। অন্যদিকে মাখন বাধ্য ও পড়াশোনায় মনোযোগী হলেও যে খুব জেদি ও মিথ্যাবাদী ছিল। পড়াশোনায় ভালো হওয়ার কারণে মা তাকে ফটিক অপেক্ষা বেশি ভালোবাসতেন ও বিশ্বাস করতেন। ফটিকের সরলতা বোঝার মতো মানসিকতা তার ছিল না। তা ছাড়া দুই ভাই ফটিক ও মাখনলালের সম্পর্কও ভালো ছিল না। তারা পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া করত, মারপিঠ করত। ফটিকের মায়ের মনে সবসময় এক ভয়-ভীতি কাজ করত যে দুরন্ত ফটিক কখন মাখনকে জলে ফেলে দেয়, কখন আবার মাথা ফাটিয়ে দেয়। সবসময় তিনি কোনো বিপদ বা দুর্ঘটনার আশঙ্কায় থাকতেন।
১২। “উৎসাহে তাহার রাতে নিদ্রা হয় না।”-কার উৎসাহ? উৎসাহের কারণ কী?
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সাধনা পর্বের উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশটিতে গল্পের প্রধান চরিত্র ফটিকের উৎসাহের কথা বলা হয়েছে।
বিশ্বম্ভরবাবু, তার বোনের দুর্ভাগ্যের কথা শুনে, দীর্ঘদিন বাদে তাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। বোন এবং বোনের সন্তানদের প্রতি স্বাভাবিক মায়া-মমতাবশত তিনি সেখানে কিছুদিন থেকেছিলেন। বাড়িতে থাকাকালীন ভাগ্নেদের পড়াশোনা ও অন্যান্য বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, মাখন পড়াশোনায় ভালো হলেও ফটিক অবাধ্য, পড়াশোনায় তার একেবারে মন নেই। পড়াশোনায় উদাসীন ফটিক তার সমবয়সি ছেলেদের দলের নেতা। দস্যি ছেলে ফটিকের চিন্তায় ফটিকের মায়ের মনে কোনো শান্তি ছিল না। তাই ফটিকের পড়াশোনা ও চঞ্চলতাকে কমানোর জন্য বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিশোর মনের স্বাভাবিক কৌতূহলবশত ফটিক কলকাতায় যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিল। ফটিকের মন সেই সময় মায়ের স্নেহাঞ্চল, প্রকৃতির উদারতা থেকে কলকাতায় চলে যেতে একবারও ব্যথিত হয়নি। উপরন্তু বয়ঃসন্ধিকালীন অতিরিক্ত আগ্রহে কলকাতায় যাওয়ার চিন্তা তার কিশোর মনকে আচ্ছন্ন করেছিল। গ্রামের সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে কলকাতা শহর দেখার অতিশয় আগ্রহে সে রাতে ঘুমাতে পর্যন্ত পারত না।
১৩। “এই অনাবশ্যক পরিবার বৃদ্ধিতে মনে মনে যে বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন তাহা বলিতে পারিনা।”-কার কথা বলা হয়েছে? ‘অনাবশ্যক পরিবারবৃদ্ধি’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? উদ্দিষ্ট ব্যক্তির সন্তুষ্ট না হওয়ার কারণ কী?
মানবদরদি ও মানবতাবাদী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সাধনাপর্বের উল্লেখযোগ্য ‘ছুটি’ গল্পের অন্তর্গত আলোচ্য অংশটিতে কলকাতায় বসবাসকারী বিশ্বম্ভববাবুর স্ত্রী অর্থাৎ ফটিকের মামির কথা বলা হয়েছে।
কলকাতায় বসবাসকারী বিশ্বম্ভরবাবুর পরিবারে স্ত্রী-সহ তিন সন্তান ছিল। ফটিকের মামি তার তিন সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যবিপর্যস্ত বিধবা বোনকে দেখতে গিয়ে ফটিককে সঙ্গে করে আনেন বিশ্বম্ভরবাবু। পরিবারে ফটিক আসাতে স্বাভাবিকভাবেই পরিবার বৃদ্ধি পায়। ফটিককে কলকাতায় না আনলেই ভালো হত এই মানসিকতার বশবর্তী হয়ে অত্যন্ত বিরক্ত হৃদয়হীন মামির ফটিককে আনা অনাবশ্যক পরিবারবৃদ্ধি বলে মনে করেছেন।
বিশ্বম্ভরবাবুর নিজের তিন সন্তান থাকা সত্ত্বেও মায়ার বশে তিনি ফটিককে কলকাতায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ফটিককে পড়াশোনায় মনোযোগী করতে, তার চঞ্চলতাকে দূর করতে বিশ্বম্ভরবাবুর এই পদক্ষেপকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। কিন্তু নিজের স্ত্রী-সন্তান থাকা সত্ত্বেও এতটা হৃদয়হীন, অমানবিক, স্নেহশূন্য হবেন তা বোধ করি কল্পনা করতে তিনি পারেননি। তাই কলকাতায় ফটিক আসার পর প্রথম থেকেই ফটিক মামির চোখের বালিতে পরিণত হয়। ফটিকের মতো তেরো চোদ্দো বছরের গ্রাম্য অপরিচিত, অশিক্ষিত কিশোর তার সাজানো সংসারে কিরকম অশান্তির কারণ হতে পারে, তা কল্পনা করেই তিনি খুব অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত হয়েছিলেন। চরিত্রগতভাবে তিনি নিষ্ঠুর, স্নেহহীনা, অমানবিক ছিলেন বলেই ফটিকের মতো সরল সন্তানসম ছেলেকে তিনি ভালোবাসতে পারেননি।
১৪। “বিশ্বম্ভরের এত বয়স হইল, তবু কিছুমাত্র যদি কাণ্ডজ্ঞান আছে।” -বক্তা কে? বিশ্বম্ভরবাবু কে ছিলেন? বক্তার এইরূপ বলার কারণ কী?
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধনা পর্বের উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয় ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে আলোচ্য অংশটি গৃহীত, যেখানে বক্তা হলেন কলকাতাবাসী, স্নেহহীনা নারী ফটিকের মামি, অর্থাৎ বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী।
ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র হতভাগ্য ফটিকের একমাত্র কলকাতাবাসী মামা হলেন বিশ্বম্ভরবাবু।
দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার পর বিশ্বম্ভরবাবু কলকাতায় ফিরে এসে বোনের ভাগ্যবিপর্যয়ের কথা জানতে পারেন। সদ্য স্বামীহারা বিধবা বোনের খোঁজখবর নেওয়ার আশায় তিনি গ্রামে আসেন। কিছুদিন তাদের সঙ্গে আনন্দেই কাটান। বোন ও বোনের সন্তানদের প্রতি স্বাভাবিক ভালোবাসার টানে তাদের অভাব-অভিযোগের কথা তার কানে আসে। বিশ্বম্ভরবাবু জানতে পারেন, ফটিক ও মাখনের মধ্যে কোনো বনিবনা নেই। প্রতিনিয়ত তারা ঝগড়া, মারপিট করে। তা ছাড়া ফটিক খুব দুরন্ত ও পড়াশোনায় অমনোযোগী। তাই বোনকে চিন্তামুক্ত করতে, ফটিককে পড়াশোনায় মনোযোগী করে তুলতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ফটিককে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রাখবেন। তার এই সিদ্ধান্ত সাধুবাদযোগ্য হলেও মানবচরিত্র সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান না থাকার কারণে তিনি নিজের পরিবারে ও ফটিকের জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছিলেন। কলকাতায় তার তিন সন্তান-সহ পরিবারের মধ্যে ফটিকের মতো অশিক্ষিত, অপরিচিত গ্রাম্য বালক কী ধরনের বিপদ হতে পারে, তা তিনি কল্পনা করতে পারেননি। তা ছাড়া নিজের স্ত্রীকেও তিনি সঠিকভাবে চিনতে পারেননি। বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী অর্থাৎ ফটিকের মামি প্রথম থেকেই ফটিককে বোঝাস্বরূপ মনে করেছে। নিজের সন্তানদের মধ্যে এই তেরো বছরের বালক যে কী ভয়ানক বিপদের কারণ হতে পারে, তা বিশ্বম্ভরবাবু বুঝতে পারেননি বলে ফটিককে কলকাতায় নিয়ে আসাকে তিনি কান্ডজ্ঞানহীন কাজ বলেছেন। ম্যাক
১৫। “তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।”-এ কথা কোন্ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে? ‘বালাই’ শব্দের অর্থ কী? তেরো-চোদ্দো বৎসরের ছেলেকে বালাই বলা হয়েছে কেন?
‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু যখন ফটিককে তাদের কলকাতার বাড়িতে নিয়ে এলেন এবং ফটিকের মামি এই অনাবশ্যক পরিবারবৃদ্ধিতে বিরক্ত হলেন, তখন স্বয়ং লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মন্তব্যটি করেছেন।
‘বালাই’ শব্দের অর্থ বালকের অহিত। এখানে অমঙ্গল বা উৎপাত বা বিপদ অর্থে শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। ক্যাশ শান্তগীর কর্মীদের ফটিক যখন মামার সঙ্গে কলকাতায় আসে তখন তার বয়স তেরো-চোদ্দো বছর। এই তেরো-চোদ্দো বছর বয়স ছেলেমেয়েদের বয়ঃসন্ধির সময়। মূলত শিশু-কিশোরদের বয়ঃসন্ধিকালীন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনজনিত কারণে নানারকম আবেগ, অনুভূতি, কৌতূহল, দেখা যায়। ফটিক চরিত্রের মধ্যে দিয়ে লেখক এই বয়সের স্বভাববৈশিষ্ট্য তুলে ধরে তাকে বালাই বলেছেন। কেন-না নানারকম শারীরিক পরিবর্তন ঘটে বলে শৈশবের লালিত্য চলে যায়। কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা ম্লান হয়ে আসে। এই বয়সের আধো আধো কথা ন্যাকামো মনে হয় আবার পাকাপাকা কথা জ্যাঠামো মনে হয়। তা ছাড়া নানারকম কৌতূহল জন্ম নেয় এই বয়সে।
অথচ বড়োদের মধ্যে যোগ দেওয়া যায় না আবার ছোটোদের সঙ্গেও খেলতে বেমানান লাগে। আমাদের সমাজব্যবস্থায় এই বয়সন্ধিকালীন আচরণকে ঔদ্ধত্য হিসেবে দেখা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আধুনিক মনস্তাত্ত্বিকতার পরিচয় দিয়ে ফটিক চরিত্রের বয়ঃসন্ধিকালীন আচরণের ব্যাখ্যা করেছেন এবং সহানুভূতিশীল হয়েছেন।
১৬। “তাহার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হইয়া যায়।”-‘তাহার’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? তাকে প্রভুহীন কুকুর বলার কারণ কী?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সাধনা পর্বের উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে ‘তাহার’ বলতে ফটিককে বোঝানো হয়েছে।
আধুনিকতম লেখক রবীন্দ্রনাথ তাঁর আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক ভাবনাচিন্তা দ্বারা চালিত হয়ে ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র ফটিকের মধ্যে বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোরের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন। শৈশব ও যৌবনের বয়স ধর্মকালীন আচরণের সঙ্গে আমরা পরিচিত হলেও বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তিত আচরণকে আমরা ঔদ্ধত্য মনে করি। ফটিকের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তেরো-চোদ্দো বয়সে বয়ঃসন্ধিকালে দাঁড়িয়ে ফটিক মায়ের স্নেহাঞ্চল ছেড়ে চলে এসেছিল কলকাতার স্নেহহীন স্থানে। যেখানে একমাত্র মামা ছাড়া সবাই তাকে দুর্গহ মনে করত। কোথাও স্নেহ-মায়া-মমতার আশ্রয় ছিল না। এই বয়সের কোনো শোভা নেই, কোনো কাজে লাগে না। তার দেহ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করে হঠাৎ বেমানানরূপে বেড়ে ওঠে। শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা হঠাৎ চলে যায়। লোকে সেইজন্য তাকে মনে মনে অপরাধী করে। এই বয়সের স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও অসহ্য বলে মনে হয়। তা ছাড়া ছেলেমেয়েরাও নিজেদেরকে অন্যের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। সে স্নেহ পেতে চায় কিন্তু কেউ সাহস করে স্নেহ দিতে পারে না। কারণ তাকে প্রশ্রয় বলে মনে হয়। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, তার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হয়ে যায়। এই সময়ে সবচেয়ে বড়ো আশ্রয়স্থল হল মা। কিন্তু ফটিকের দুর্ভাগ্য যে এই সময়েই মায়ের ভালোবাসা, স্নেহ থেকে সে বহুদূরে অমানবিক পরিবেশে থেকেছে। যার অনিবার্য ফলস্বরূপ ডেকে এনেছে তার অকাল মৃত্যু।
১৭। “এমন অবস্থায় মাতৃভবন ছাড়া আর-কোনো অপরিচিত স্থান বালকের পক্ষে নরক।”-প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা লেখো।
পদ্মাপাড়ে রচিত ছোটোগল্পগুলির মধ্যে ‘ছুটি’ গল্পটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। রবীন্দ্রসাহিত্যে যত উল্লেখযোগ্য বালক চরিত্র আছে ফটিক তাদের মধ্যে অবিস্মরণীয় চরিত্র। আলোচ্য অংশে যে বালকের কথা বলা হয়েছে, সে হল ফটিক। বয়ঃসন্ধির অস্বস্তিকর বিড়ম্বনার মনস্তত্ত্বসম্মত চিত্র অত্যন্ত সুন্দর করে রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন ফটিকের জীবনে ।
তেরো-চোদ্দো বছর বয়সের বয়ঃসন্ধিকালে দাঁড়িয়ে থাকা ফটিক মাকে ছেড়ে এসেছিল মামার বাড়ি কলকাতায়। এই বয়সের কোনো শোভা নেই, কোনো কাজেও লাগে না। কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করে তার শরীর হঠাৎ বেমানানরূপে বেড়ে যায়। শরীরে আসা নানা পরিবর্তন। মনে দেখা দেয় নানা কৌতূহল। গলার স্বরের মিষ্টতা চলে যায়। লোকে তাকে অপরাধী মনে করে। এই বয়সের স্বাভাবিক-অনিবার্য ত্রুটিও অসহ্য বলে মনে হয়। পৃথিবীর কোথাও নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে না। তাই নিজেদেরকে প্রতিনিয়ত অপরাধী, লজ্জিত বলে মনে করে। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা স্নেহের কাঙাল থাকে, সামান্য ভালোবাসা স্নেহ পেলে আত্মবিক্রিও করে দেয়। কিন্তু কোথাও স্নেহ-ভালোবাসা না পেলে প্রভুহীন কুকুরের মতো হয়ে থাকে। এইসময় একমাত্র আশ্রয়স্থল শান্তির নীড় হল মা ও মায়ের স্নেহাঞ্চল। মায়ের স্নেহই সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম এবং সৌভাগ্যের প্রতীক। বঞ্চিত হতভাগ্য সন্তানেরও একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় মা। সেই আশ্রয়চ্যুত ফটিক স্নেহশূন্য, মায়া মমতাহীন, ভালোবাসাহীন পরিবেশে থেকেছে; যা নরক বেদনার সমতুল্য।
১৮। “এমন অবস্থায় মাতৃভবন ছাড়া আর-কোনো অপরিচিত স্থান বালকের পক্ষে নরক।”-কার সম্বন্ধে এ কথা বলা হয়েছে? কোন্ প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছে? তা ‘নরকতুল্য’ কেন?
আলোচ্য অংশটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধনাপর্বের উল্লেখযোগ্য গল্প ‘ছুটি’-এর প্রধান চরিত্র ফটিকের সম্বন্ধে বলা হয়েছে।
ফটিকের যখন বয়ঃসন্ধিকাল তখন নিজের মায়ের কাছ থেকে বিশ্বম্ভরবাবুর সঙ্গে কলকাতায় মামার বাড়ি চলে আসা প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছে। দুরন্ত অবাধ্য ছেলেকে দাদার কাছে রেখে সহায়-সম্বলহীন ফটিকের মা শান্তি পেতে চেয়েছিল। ভেবেছিল ছেলেটা মানুষ হয়ে আসবে। দাদা বিশ্বম্ভরবাবু তার অভিভাবকত্ব নেওয়ায় তিনি আশ্বস্ত হয়েছিলেন।
খুব সূক্ষ্মভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফটিকের মধ্য দিয়ে বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেদের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন। অসাধারণ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন তিনি এই সময়ের বয়সধর্মের। এই বয়সের ছেলেদের কোনো শোভা থাকে না। শরীর হঠাৎ বেমানানভাবে বেড়ে ওঠে। কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা চলে যায়, হয়ে ওঠে কর্কশ। তার আধো আধো কথা ন্যাকামি এবং পাকা পাকা কথা জ্যাঠামি বলে মনে হয়। এইসময় কেউ তাকে স্নেহ ও ভালোবাসা দিতে চায় না। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা নিজেকে সবার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। সবসময় নিজেকে অপরাধী মনে করে এবং অন্যের সামান্য স্নেহশূন্য ব্যবহার তাকে কাঁটার মতো বিদ্ধ করে। এইসময় নারীমাত্রই স্বর্গের দুর্লভ জীব বলে মনে হয়। কিন্তু সেই নারীর কাছ থেকে অনাদর-অবহেলা ও অপমান পেলে তা হয়ে উঠতে পারে হৃদয়বিদারক। ফটিকের বয়ঃসন্ধিকালের পর্বে মামির নিষ্ঠুর ও অমানবিক স্নেহশূন্য ব্যবহার ফটিককেও ব্যথিত করত। এই সময় মায়ের আশ্রয়ই শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। অন্য কোনো স্থান তার কাছে নরকতুল্য, বেদনাদায়ক। কারণ সেখানে স্নেহ, ভালোবাসা, সহানুভূতি কোনো কিছুই থাকে না।
১৯। ছোটোগল্প হিসেবে ‘ছুটি’ গল্পের সার্থকতা আলোচনা করো।
ছোটোগল্প রচনাতে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর ছোটোগল্প যেন নখদর্পণে বিশ্বদেখা। ঈশ্বরের সৃষ্টিতে কোনো পুনরুক্তি ছু নেই, ছোটোগল্পের রবীন্দ্রনাথ যেন ঈশ্বরেরই প্রতিদ্বন্দ্বী। মানবজীবন ও মানবমনের ‘অনন্তপার’ বৈচিত্র্য এইসব গল্পে যেমন দেখা যায় তেমনই শিল্পের প্রসাধনেও ‘নিতুই নব’। সাধনা-ভারতী পর্ব রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পের সুবর্ণযুগ। আর এই সুবর্ণযুগের বহু পরিচিত ছোটোগল্প আমাদের পাঠ্য ‘ছুটি’ গল্পটি’। ‘ছুটি’ গল্পটি ছোটোগল্প হিসেবে কতটা সার্থক তা বিচার করবার আগে ছোটোগল্পের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যের প্রতি আলোকপাত করা যেতে পারে।
যা ছোটো এবং যথার্থ গল্প তাই ছোটোগল্প। ছোটোগল্পের বাহন গদ্য, এর লক্ষ্যে একাগ্রতা থাকে। ছোটোগল্পে অবাস্তব বিন্যাস বর্জনীয়, ঘটনা বা ভাবগত একটি নাটকীয় চমক দিয়ে ছোটোগল্পের সমাপ্তি ঘটে থাকে, যাকে ‘Climax’ বলা হয়। এক্ষেত্রে Hudson-এর সংজ্ঞাটি উল্লেখ করা যেতে পারে-‘A short story must contain one and only one informing idea and that idea must be worked out to its logical conclusion with absolute singleness of method.’ ছোটোগল্পের সংজ্ঞা দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের ‘বর্ষাযাপন’ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন-
‘ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখ কথা নিতান্তই সহজ সরল; সহস্র বিস্তৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি তারি দু-চারিটি অশ্রুজল। নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ। অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে শেষ হয়ে হইল না শেষ। ‘
ছোটোগল্পে যোগ করলেন, তা হল এর উপসংহার হবে অত্যন্ত অতৃপ্তিজনক।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘ছুটি’ গল্পের ক্ষেত্রে যে প্রথম বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, তা হল সহজ-সরল বিষয়বস্তু। গ্রামবাংলার মধ্যবিত্ত এক ব্রাহ্মণ পরিবারের বিধবা মা, তার দুই সন্তানের কাহিনি। এই সংক্ষিপ্ত কাহিনিবৃত্তে এসেছে ফটিকের মামা, মামি, মামাতো ভাইরা, ফটিকের খেলার সাথি প্রমুখরা। কিন্তু কেন্দ্রবিন্দুতে ফটিক। প্রকৃতির কোলবিচ্ছিন্ন চিরচঞ্চল, দামাল বালক কীভাবে শহরের হৃদয়হীনতার মধ্যে একেবারে হারিয়ে গেল মৃত্যুর জগতে, তারই করুণ কাহিনি ‘ছুটি’ গল্পের বিষয়বস্তু। গল্পের ভাষা সহজ-সরল, কাব্যধর্মী। এই গল্পে কোনো শাখাকাহিনি বা উপকাহিনির সমাবেশ করে ঘটনার ঘনঘটা সৃষ্টি করা হয়নি। স্বল্প পরিসরেই
ফটিকের মধ্যে বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা ফুটিয়ে তুলেছেন এবং সূক্ষ্মভাবে শিশু-মনস্তত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
গল্পের একেবারে শেষে অসুস্থ ফটিক মাকে দেখতে চেয়েছে। মর্ত্যপৃথিবী থেকে একেবারে ছুটির সময় তার মাকে বলেছে-“মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি”। এই ‘ছুটি’ কোনো সাধারণ ছুটি নয়, তা পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন। আর এখানেই ছোটোগল্পের প্রাণ ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’। সবদিক থেকে বিচার করলে ‘ছুটি’ গল্পটি সার্থক ছোটোগল্প এ কথা বলতে অত্যুক্তি হয় না।
২০। ‘ছুটি’ গল্পে ফটিক চরিত্রটি আলোচনা করো।
অথবা, ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র কোনটি? সেই চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
বাংলা সাহিত্যে আজ পর্যন্ত যেসব দুর্দান্ত কিশোর চরিত্র পাঠকের কাছে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি চরিত্র হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক চরিত্রটি। কৈশোরের উদ্দামতা, আবেগ, অসহায়তা সবকিছু মিলিয়ে ফটিক আজও কিশোরের কিশোরবেলার প্রতিচ্ছবি। পৃথিবীর অনেক কিশোর চরিত্রের মধ্যে ফটিক এক অসাধারণ, অনবদ্য এবং চমৎকার চরিত্র।
বাস্তব চরিত্র: সাধনা পর্বে লেখা ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র ফটিক, রবীন্দ্রনাথের লেখা বাস্তব চরিত্রের আদলে রচিত। রবীন্দ্র-গবেষকদের লেখা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের দেখা দ্বারিকাপুরের চক্রবর্তীদের ছেলে হারানচন্দ্র, ফটিক চরিত্রের বাস্তবভিত্তি।
দুরন্ত দস্যি ছেলে: ফটিক পিতৃহীন, স্বভাবে বাউন্ডুলে, দরিদ্র বিধবা মায়ের দস্যি ছেলে। গ্রামের সমবয়সি ও ছোটোদের দুষ্টুমির দলপতি সে। গল্পের শুরুতে নদীর ধারে পড়ে থাকা শাল কাঠের গুঁড়িকে ঠেলে ঠেলে খেলার পরিকল্পনা তার মস্তিষ্কপ্রসূত।
সরল ও সত্যবাদী: ফটিক দুরন্ত, অবাধ্য হলেও সরল ও সত্যবাদী। খেলতে গিয়ে পড়ে গেলে অপমানিত মাখন ফটিককে অন্ধভাবে মেরেছে এবং মায়ের কাছে নালিশ করেছে। যেখানে দেখা যায়, মাখন তার মায়ের কাছে মিথ্যে কথা বলেছে। কিন্তু ফটিক মায়ের তিরস্কারের কথা ভেবেও কোনো মিথ্যা কথা বলেনি। ফটিক যে মাখনকে মারেনি এটিই সত্য, এই কথাই সে বারবার বলেছে। আমি হীপালন।
মমত্ববোধ: মা ও ভাই মাখনলালের প্রতি ফটিকের মমত্ববোধ ছিল। তাই কলকাতা যাওয়ার সময় নিজের খেলার সামগ্রী ভাই মাখনকে দিয়েছিল। আবার অসুস্থ অবস্থায় অত্যাচারিণী মাকেই সে বারবার কাছে পেতে চেয়েছিল। মায়ের জন্য ফটিকের মন বারবার বেদনাময় হয়েছিল।
লেখাপড়ার প্রতি উদাসীনতা লেখাপড়ার প্রতি উদাসীনতা ও অমনোযোগিতা ফটিক চরিত্রের সবচেয়ে বড়ো ত্রুটিময় বৈশিষ্ট্য। শহরের স্কুলে অমনোযোগী ফটিক মাস্টারমশাইয়ের কাছে বারবার অপদস্ত ও অপমানিত হয়েছে- “স্কুলে এতবড়ো নির্বোধ এবং অমনোযোগী বালক আর ছিল না।”
বয়ঃসন্ধিকালের বিড়ম্বনা: ফটিকের বয়স তেরো-চোদ্দো বছর, এই বয়সে বয়ঃসন্ধিকাল। এই বয়সের নানারকম শারীরিক, মানসিক পরিবর্তনজনিত কারণে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়। গলার স্বর পরিবর্তন, দৈহিক বৃদ্ধি, স্নেহ ভালোবাসার কাঙাল পরিবর্তন, স্নেহ-ভালোবাসার কাঙাল, সহজ-সাবলীল মেলামেশার অভাব, কুণ্ঠাবোধ-এইসব বৈশিষ্ট্যই ফটিক চরিত্রে দেখা যায়। বয়ঃসন্ধিকালীন বিড়ম্বনা ফটিক চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
প্রকৃতির প্রতি প্রীতি: প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের নিগূঢ় সম্পর্কের চিত্র এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ ফটিক চরিত্রের মধ্য দিয়ে। গ্রামবাংলার উদার আকাশের নীচে পথে-প্রান্তরে, নদীর ঘাটে ছুটির আনন্দে বন্ধুদের সঙ্গে সারাদিন ঘুরে বেড়ানোই তার জীবন। ফটিক ছিল বনের পাখির মতো। স্বচ্ছন্দ, স্বাধীন, অনন্ত-উদার নীল আকাশে আপন মনে উড়ে বেড়ানো আর গান গাওয়াতেই ছিল ফটিকের প্রাণের মুক্তি, আত্মার আনন্দ।
বিশ্বম্ভরবাবু বনের এই মুক্ত পাখি ফটিককে খাঁচায় পুরলেন। কিন্তু সেখানে মামির ভর্ৎসনা, স্কুলে মাস্টারমশাইয়ের হৃদয়হীন প্রহার, মামাতো ভাইদের নির্মম অপমানজনক ব্যবহার; সর্বোপরি মায়ের প্রতি অভিমানে সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ফটিকের এই চলে যাওয়া ‘আপদ’ গল্পের নীলকান্তের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়।
২১। “মামীর স্নেহহীন চক্ষে সে যে একটা দুগ্রহের মতো প্রতিভাত হইতেছে,”-‘সে’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? ‘দুগ্রহের মতো’ বলার কারণ কী?
সাধনা পর্বে লেখা রবীন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে। এখানে ‘সে’ বলতে ফটিককে বোঝানো হয়েছে।
পড়াশোনায় অমনোযোগী ফটিকের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে কলকাতায় নিয়ে আসেন। কিন্তু কলকাতায় নিজের সংসারে স্ত্রী-সহ আরও তিন সন্তান কেউই আর এই সিদ্ধান্তে খুশি হননি। বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী অর্থাৎ ফটিকের মামি ফটিককে দেখামাত্রই বিরক্ত হয়েছিলেন। তার সাজানো সংসারে ফটিকের মতো অবাধ্য, দুরন্ত, গ্রাম্য, অপরিচিত বালক কী ধরনের উচ্ছৃঙ্খল কারণ হতে পারে, তাই ভেবেই তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। সর্বোপরি ফটিক তেরো-চোদ্দো বছরের এক কিশোর। এই বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর বালক ফটিককে আনার সিদ্ধান্তকে তিনি বিশ্বম্ভরবাবুর কাণ্ডজ্ঞানহীনতার কাজও বলেছেন। বয়ঃসন্ধিকালে স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে। দেহের বৃদ্ধি, কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন-এইসব এই বয়সের ধর্ম। শৈশবের লালিত্য হারিয়ে যায়। শৈশব ও যৌবনের মাঝখানে দিশেহারা বালকের কোনো শোভা থাকে না। পৃথিবীতে কোথাও কারও সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। স্নেহ পেতে চায়, ভালোবাসা দিতে চায় কিন্তু কেউ তাকে স্নেহ-ভালোবাসা দিতে চায় না। নারীজাতি তাদের কাছে স্বর্গের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কিন্তু সেই নারীজাতির কাছ থেকে অনাদর, স্নেহহীনতা সহ্যাতীত। এই বয়সের একমাত্র আশ্রয়স্থল হল মা। কিন্তু ফটিকের মামি এমন এক হৃদয়হীন নিষ্ঠুর নারী যে, কখনও ফটিকের মা হয়ে উঠতে পারেনি। উপরন্তু ফটিককে সবসময় দুগ্রহের মতো দেখেছে এবং তার সঙ্গে অতি অমানবিক আচরণ করেছে।
২২। “দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়িয়া কেবলই তাহার সেই গ্রামের কথা মনে পড়িত।”-‘তাহার’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? তার গ্রামের কোন্ কথা, কেন মনে পড়ত?
পদ্মাপাড়ে রচিত সাধনা পর্বের বহু পরিচিত ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে ‘তাঁহার’ বলতে ফটিককে বোঝানো হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ‘ছুটি’ গল্পে প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের নিগূঢ় সম্পর্কের চিত্র এঁকেছেন ফটিক চরিত্রের মধ্য দিয়ে। গ্রামবাংলার উদার আকাশের নীচে পথে-প্রান্তরে, নদীর ঘাটে ছুটির আনন্দে সঙ্গীদের নিয়ে সারাদিন ছুটোছুটি করে বেড়ানোই ছিল ফটিকের একমাত্র কাজ। প্রকাণ্ড একটা ধাউস ঘুড়ি নিয়ে বোঁ-বোঁ করে মাঠে দৌঁড়ে বেড়ানো, ‘তাইরে নাইরে নাইরে না’ করে গাওয়া, দিনের মধ্যে যখন-তখন ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটা-সেইসব গ্রামবাংলার দস্যি ছেলের দলবল, সর্বোপরি মায়ের কথা ফটিকের মনে পড়ত।
নিয়মমাফিক পড়াশোনা বা কোনো সাংসারিক কাজে তার কোনোদিনই মন ছিল না। ফটিক ছিল বনের পাখির মতোই স্বাধীন, মুক্ত, স্বচ্ছন্দ; অনন্ত-উদার নীল আকাশে আপন মনে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেই ছিল তার প্রাণের আনন্দ, মনের মুক্তি। কিন্তু সেই মুক্তপ্রাণা ফটিককে পড়াশোনার অমনোেযাগিতার কারণে কলকাতায় এনে চার দেয়ালে বন্দি করা হয়। বন্দিদশায় মামির নিষ্ঠুর স্নেহহীন আচরণ, স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের অমানবিক প্রহার, মামাতো ভাইদের অবহেলা-তাচ্ছিল্য তাকে বারবার নিজের গ্রামের কথা, মায়ের কথা মনে করিয়ে দিত।
২৩। “সেই লজ্জিত শঙ্কিত শীর্ণ দীর্ঘ অসুন্দর বালকের অন্তরে কেবলই আলোড়িত হইত।”-এই বালক কে? তার অন্তরে কী আলোড়িত হওয়ার কথা বলা হয়েছে?
এই লজ্জিত, শঙ্কিত, শীর্ণ, দীর্ঘ, অসুন্দর বালক বলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটোগল্প ‘ছুটি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিককে বোঝানো হয়েছে।
প্রকৃতির স্নেহের দুলাল ফটিককে প্রকৃতি মায়ের স্নেহাঞ্চল ছিন্ন করে কলকাতায় মামার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। উদার-মুক্ত শ্যামল অরণ্য থেকে তাকে লোহার খাঁচায় বন্দি করা হয়। সেই স্নেহহীন নিষ্প্রাণ বন্দিজীবনের মধ্যে ক্লান্ত ফটিক গ্রামের জীবনে প্রকৃতি মায়ের কোলে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠত। তার মনে পড়ত প্রকাণ্ড ঢাউস ঘুড়ি নিয়ে বোঁ বোঁ শব্দে উড়ে বেড়ানোর সেই মাঠ, ‘তাইরে নাইরে নাইরে না’ করে উচ্চস্বরে স্বরচিত গান গেয়ে অকর্মণ্যভাবে ঘুরে বেড়ানোর সেই নদীতীর, দিনের মধ্যে যখন-তখন ঝাঁপ দিয়ে পড়ে সাঁতার কাটাবার সেই নদী আর খেলার সঙ্গী, স্বাধীনতা সর্বোপরি সেই অত্যাচারিণী, অবিচারিণী মা। এইসবই
রাতদিন তার অসহায় মনকে আকর্ষণ করত। বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর ফটিক নিজের মধ্যে অনুভব করত জন্তুর মতো এক অবুঝ ভালোবাসা। প্রকৃতি মায়ের কাছে, সর্বোপরি নিজের মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার অব্যক্ত ইচ্ছা এবং সেই ইচ্ছাই বেদনা হয়ে ফটিকের অন্তরের ‘মা মা’ কান্নার রোল তুলত। এইসব ভাবনাই ফটিকের মনকে আলোড়িত করত। চাও ২৪। “জন্তুর মতো একপ্রকার অবুঝ ভালোবাসা”-প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা লেখো।
গ্রামের মুক্ত প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা দুরন্ত বালক ফটিক কেমন করে শহরের চার দেয়ালে কঠিন বাঁধনে বন্দি হয়ে রইল, কেমন করেই বা এই মুক্তি, পাগল বালক চিরকালের মতো ছুটি নিয়ে হারিয়ে গেল তার বাস্তব করুণ কাহিনি ‘ছুটি’। আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথের এই ‘ছুটি’ গল্পের অন্তর্গত প্রধান হতভাগ্য চরিত্র ফটিক সম্বন্ধে বলা হয়েছে। দুরন্ত অবাধ্য ফটিকের শিক্ষার দায়িত্ব নিয়ে ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু কলকাতায় নিয়ে আসে ফটিককে। নিরুপায় অসহায়তা অভিভাবকহীন সংসারে সন্তান প্রতিপালনের অক্ষমতাই ফটিকের মাকে বাধ্য করেছিল ফটিককে নিজের স্নেহাঞ্চল থেকে দূরে সরিয়ে দিতে। কলকাতায় এসে মামির স্নেহহীনতা, নিষ্ঠুর আচরণ, স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের অমানবিক মার, মামাতো ভাইদের তাচ্ছিল্য-অবহেলা ফটিককে বেদনাময় করে তুলেছিল। অসহায় অবস্থায় শহরের চার দেয়ালে আবদ্ধ ফটিকের বারবার মনে পড়ত গ্রামের কথা সর্বোপরি অত্যাচারী, অবিচারিণী মায়ের কথা। জননীর স্নেহাঞ্চল, প্রকৃতির শ্যামলাঞ্চল বঞ্চিত এই বালক শহরের সুকঠিন মমতাহীন আশ্রয় থেকে নিরুদ্দেশ হতে চেয়েছে। মায়ের কাছে ফটিক যেতে পারেনি। মাকে দেখ ার প্রবল ইচ্ছা, মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার ব্যাকুলতাকে লেখক ‘জন্তুর মতো একপ্রকার অবুঝ ভালোবাসা’-র সঙ্গে তুলনা করেছেন।
মানবমনের গভীরতা দেখার ক্ষমতা রবীন্দ্রনাথের ছিল বলেই তিনি ফটিকের এই বেদনাকে অসামান্য এক উপমা দিয়ে প্রকাশ করেছেন- ‘গোধূলিসময়ের মাতৃহীন বৎসের মতো কেবল একটা আন্তরিক ‘মা মা’ ক্রন্দন-সেই লজ্জিত শঙ্কিত শীর্ণ দীর্ঘ অসুন্দর বালকের অন্তরে কেবলই আলোড়িত হইত।’
২৫। ‘ছুটি’ গল্পে অপ্রধান চরিত্র হিসেবে ফটিকের মায়ের চরিত্র লেখো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধনা পর্বের উল্লেখযোগ্য গল্প হল ‘ছুটি’। ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র ফটিকের পর অপর একটি চরিত্র গল্পে অপ্রধান হলেও আমাদের সহানুভূতি ও করুণা আদায় করে নেয়, তিনি হলেন ফটিকের মা।
নিম্নমধ্যবিত্ত বিধবা গ্রামীণ অসহায় নারী। স্বামীর অবর্তমানে সংসারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার পাশাপাশি দুই পুত্র সন্তান নিয়ে বিব্রত। বিশেষত ফটিক অত্যন্ত দুরন্ত, অবাধ্য প্রকৃতির; তাকে নিয়ে ফটিকের মায়ের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই অন্যদিকে মাখন শান্তশিষ্ট হলেও ফটিকের সঙ্গে তার প্রতিনিয়ত ঝগড়া-মারামারি লেগেই থাকে।
মাতৃত্ব-যা মায়েদের প্রধান বৈশিষ্ট্য তা ফটিকের মায়েরও ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন পক্ষপাতদুষ্ট, আপাত দৃষ্টিতে শান্ত মাখনকে বেশি পছন্দ করতেন। তাই ফটিককে কলকাতায় নিয়ে যাবার প্রস্তাবে তিনি অমত করেননি। ফটিকের মতো দুরন্ত ছেলের কাছে মাকে অত্যাচারিণী ও অবিচারিণী হতেই হয়েছে। কিন্তু সেই অত্যাচারের মধ্যেও যে স্নেহের পরম প্রভাব ছিল তাও গল্পের মধ্যে ফটিকের জন্য চিন্তায় পাওয়া যায়। তাই কঠিন রোগসজ্জায় ফটিক কেবল তার মাকেই খুঁজেছে।
ফটিকের মায়ের চরিত্রের অপর বৈশিষ্ট্য হল দূরদর্শিতার অভাব। তিনি তার দাদা বিশ্বম্ভরবাবুকে চিনতেন কিন্তু তার ভাতৃবধূকে চিনতে পারেননি। যদি সাংসারিক দূরদর্শিতা তার থাকত তাহলে তিনি হয়তো কখনই ফটিককে মামার সঙ্গে কলকাতায় পাঠাতেন না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যক্তিগত জীবনে বহুপ্রিয়মানুষের মৃত্যুবেদনার আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন। সেই আঘাত তাকে এই সত্যে উপনীত করতে সাহায্য করেছে যে মৃত্যু জীবনের অনিবার্য চরম সত্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও মায়ের কোলে সন্তানের মৃত্যু যে কী নির্মম বেদনাদায়ক তা চিন্তা করলে ফটিকের মায়ের জন্য চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। এই কারুণ্যের স্পর্শেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফটিকের মায়ের মতো সাধারণ অপ্রধান চরিত্রকে স্মরণীয় করে দিয়েছেন।
২৬। ‘ছুটি’ গল্পে মাখন চরিত্রটি উল্লেখ করো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পে কেন্দ্রীয় চরিত্র হল ফটিক। ফটিকের বিপরীতে লেখক মাখন-এর চরিত্র অঙ্কন করেছেন। মাখনের চরিত্রটি যে একটি অপ্রধান চরিত্র তা বলাই বাহুল্য। মাখনকে সমগ্র গল্পে মাত্র দুবার তাকে দেখা গেছে। মাখন চরিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্রে লেখকের একমাত্র উদ্দেশ্য হল ফটিক চরিত্রের অবাধ্যতা, দুরন্ততা, চঞ্চলতাকে আরও স্পষ্ট করে দেখানো। মাখন, ফটিকের বিপরীত। সে শান্ত, বাধ্য। গল্পের শুরুতে নদীতীরে শালকাঠের গুঁড়িকে ঠেলে যে অভিনব খেলার আয়োজন করেছিল ফটিকসহ অন্যান্য ছেলেরা, তাতে বাধা সৃষ্টি করেছিল মাখন। কাঠের গুঁড়ি যাতে সরাতে না পারে তাই মাখন শালকাঠের গুঁড়ির ওপর বসে গিয়েছিল। কিন্তু শেষরক্ষা আর হয়নি। ফটিকের নেতৃত্বে ছেলের দল মাখনসহ গুঁড়ি ঠেলতে থাকে আর তারই অনিবার্য ফলস্বরূপ মাখন ভূমিসাৎ হয়। লজ্জায়-অপমানে দিশেহারা মাখন ফটিককে অন্ধভাবে মারতে থাকে। এবং কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে যায়।
ফটিক দুরন্ত হলেও সে সৎ ও সরল। মাখন অসৎ ও মিথ্যাবাদী। নিজের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মায়ের কাছে মিথ্যে কথা বলে। – মাকে মিথ্যে করে জানায় ফটিক তাকে মেরেছে কিন্তু সে যে ফটিককে মেরেছে তা স্বীকার করেনি। স্বাভাবগত শান্ত, ফলত বাধ্য মাখন-এর পক্ষ • নিয়েছে মা।
মাখন পড়াশোনায় মনোযোগী। সবার কাছে সে ভালো। ফটিকের মায়ের কাছে বিশ্বম্ভরবাবু ‘মাখনের সুশান্ত সুশীলতা ও বিদ্যানুরাগের বিবরণ শুনিলেন।’
মাখন আসলে খুব জেদি। তার জেদের জন্যই ছেলেদের খেলা পণ্ড হয়েছে। মাখন তার নিজের জেদ ও একগুঁয়েমির জন্য কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে ছেলেদের মজার খেলায় বাধা দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নিজেই পড়ে গেছে।
মাখন শান্ত, সুশীল, বিদ্যাগুরাগী, মনোযোগীও বাধ্য হলেও তার চরিত্রের ত্রুটি আছে। সে জেদি, মিথ্যাবাদী, শিশুসুলভ সরলতা তার মধ্যে একেবারেই নেই।
২৭। ‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের মামির চরিত্র লেখো।
‘ছুটি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশ কিছু অপ্রধান চরিত্র অঙ্কন করেছেন। এই সকল অপ্রধান চরিত্রগুলো কাহিনিকে অনিবার্য পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। এই অপ্রধান চরিত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য হল ফটিকের মামি অর্থাৎ বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী।
কলকাতায় বসবাসকারী আধুনিক নারী হলেও তিনি ছিলেন হৃদয়হীন ও অমানবিক। নিজের দুই ছেলে থাকা সত্ত্বেও সন্তানসম ফটিককে তিনি আপন করতে পারেননি। উপরন্তু নিজের সংসারে ফটিককে ‘দুগ্রহের মতো’ মনে করতেন।
গল্পের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ফটিকের মামি চরিত্রের কোনো বিবর্তন লক্ষ করা যায় না। স্নেহহীনা এই নারী ফটিককে কোনোদিন ভালোবাসতে পারেননি। ফটিকের বয়ঃসন্ধিকালীন ব্যবহার তাকে বিরক্ত ও বিব্রত করেছে। মায়ের স্নেহাঞ্চল থেকে বিচ্যুত ফটিকের শ্রদ্ধার নারী হয়ে উঠতে পারেনি। মামির কটূক্তি তাকে বার বার আঘাত করেছে। স্নেহহীনা এই নারী ফটিকের বই হারানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন। মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি জানিয়েছিলেন ‘আমি তোমাকে মাসের মধ্যে পাঁচবার করে বই কিনে দিতে পারিনে’ মামির এই শ্লেষাত্মক বাক্য পাঠক মাত্রই বিদ্ধ করবে।
ফটিকের মামি এই গল্পে ভিলেন চরিত্র। তার স্নেহহীনতা, অমানবিকতা ফটিককে তিলে তিলে মৃতুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি যদি স্নেহশীলা, মমতাময়ী হতেন তবে ফটিকের মৃত্যু হত না। ফটিকের অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ি ফটিকের মামি। জ্বরে আক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী ফটিকের পাশে মায়ের ভালোবাসা দেওয়ার পরিবর্তে তিনি তার স্বামী বিশ্বম্ভরবাবুকে দোষারোপ করেছেন-‘কেন বাপু পরের ছেলেকে নিয়ে কেন এ কর্মভোগ’।
আদ্যন্ত মমতাহীনা, অমানবিক, স্নেহহীনা নিষ্ঠুর চরিত্রের প্রতীক হলেন ফটিকের মামি।
২৮। ‘ছুটি’ গল্পে বিশ্বম্ভরবাবুর চরিত্র আলোচনা করো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পে অপ্রধান চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হল বিশ্বম্ভরবাবু অর্থাৎ ফটিকের একমাত্র মামা। অপ্রধান চরিত্রের প্রধান কাজ হল কাহিনিকে তার অনিবার্য পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করা। সেইদিক থেকে বিচার করলে বিশ্বম্ভরবাবুর সিদ্ধান্তের জন্যই এই গল্পের কাহিনি করুণ পরিণতি পেয়েছে। এই চরিত্রটির প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নাতীত।
দীর্ঘদিন পশ্চিমে কাটিয়ে দেশে ফিরে তিনি তার একমাত্র বোনের ভাগ্যবিপর্যয়ের খবর পেয়ে তাদেরকে দেখতে গ্রামে আসেন। বিশ্বম্ভরবাবু একজন দায়িত্ববান ব্যক্তি তাই তিনি দাদা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বোন ও বোনের সন্তানের প্রতি তার স্নেহ ছিল অকৃত্রিম। ফটিকের চঞ্চলতার কথা শুনে, তার পড়াশোনার প্রতি অমনযোগিতার কথা শুনে, সর্বোপরি তাকে নিয়ে ফটিকের মায়ের দুশ্চিন্তার কথা ভেবে দায়িত্ববান মামার মতো পিতৃহারা ফটিকের সকল দায়িত্ব পরম মমতার গ্রহণ করেছেন।
দায়িত্ববান, স্নেহ-মমতাযুক্ত নিপাট ভালোমানুষ হলেও বিশ্বম্ভরবাবুর কোনো ব্যক্তিত্ব ছিল না। তাই কলকাতায় পৌঁছেই তিনি তার স্ত্রীর সামনে একেবারে ব্যক্তিত্বহীন কাপুরুষ চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। কলকাতায় থাকাকালীন ফটিকের প্রতি অবহেলা-অনাদরের কোনো প্রতিবাদ তাকে করতে দেখা যায়নি। কলকাতায় নিয়ে এসে ফটিককে স্কুলে ভরতি করিয়ে তিনি নিজের দায়িত্বটুকু শেষ করেছেন।
ব্যক্তিত্বহীন, ভীরু হলেও এই অসহায় মানুষটি আমাদের সহানুভূতি আদায় করে নেয়। অসুস্থ ফটিককে কোলে করে এনে তাকে সেবা করেছেন। জ্বরের মধ্যে ফটিক বাড়ি যেতে চাইলে বিশ্বম্ভরবাবু চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি। স্বস্নেহে ফটিকের তপ্ত হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বসে থেকেছেন। তিনি ফটিকের মাকে কলকাতায় নিয়ে আসার বন্দোবস্তও করেছিলেন। তারপর যে সর্বনাশ ঘটেছে, তার মধ্যে এই অসহায় মানুষটির নীরব বেদনা, আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে।
২৯। “স্কুলে এতবড়ো নির্বোধ এবং অমনোযোগী বালক আর ছিল না।”-কোন্ বালকের কথা বলা হয়েছে? তার নির্বোধ ও অমনোযোগিতার পরিচয় দাও।
পদ্মাপাড়ে সাধনাপর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য গল্প ‘ছুটি’ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশটিতে যে বালকের কথা বলা হয়েছে সে হল ফটিক।
এই গল্পের প্রধান চরিত্র গ্রাম্য সরল, পড়াশোনায় একেবারে অমনোযোগী ফটিক ভাগ্যের পরিহাসে মাতৃস্নেহাঞ্চল থেকে কলকাতায় মামারবাড়িতে আসে। তার চঞ্চলতা ও পড়াশোনার প্রতি উদাসীনতা দেখে বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে কলকাতায় নিয়ে আসেন, এবং কলকাতার স্কুলে ভরতি করিয়ে দেন। সহানুভূতিহীন, ভালোবাসাহীন, স্নেহহীন পরিবেশে ফটিকের মতো অমনোযোগী ছেলে স্কুলের পড়াশোনাতেও মন দিতে পারল না। তথাকথিত শিক্ষাব্যবস্থায় ফটিক শুধু গর্দভের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেয়েছে এবং নীরবে সব সহ্য করেছে। শিক্ষকের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারত না ফটিক ফলে হৃদয়হীন অন্তঃসারশূন্য মাস্টারমশাই ফটিককে নির্বোধ বলে মনে করেছে। মুক্তপ্রাণা সরল ফটিককে মাস্টারমশাই বুঝতে পারেননি। বিদ্যালয়ের পুথিগত পড়াশোনা না পারাকে চরম ব্যর্থতা বলে মনে করে ফটিককে বিদ্যালয়ের সবচেয়ে নির্বোধ ও অমনোযোগী ছাত্র হিসাবে তার ওপর অত্যাচার করেছে।
৩০। “তখন তাহার চিত্ত অধীর হইয়া উঠিত।”-কার চিত্ত অধীর হয়ে উঠত? কেন তার চিত্ত অধীর হয়ে উঠত?
পদ্মাপাড়ে সাধনা পর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে মুক্তপ্রাণ গ্রাম্যবালক ফটিক-এর চিত্ত অধীর হয়ে উঠত।
বিশ্বম্ভরবাবু বনের মুক্তবিহঙ্গকে কলকাতায় নিয়ে এসে খাঁচায় পুরলেন। ফটিক মায়ের স্নেহাঞ্চল ও প্রকৃতির শ্যামাঞ্চল থেকে নির্বাসিত হয়ে শহরের বদ্ধ জীবন কাটাতে লাগল। এই অবস্থার মধ্যে মামির ভর্ৎসনা, স্কুলের মাস্টারমশাই-এর হৃদয়হীন প্রহার ও মামাতো ভাইদের নির্মম অপমানজনক আচরণ সব মিলিয়ে ফটিক তার সহজ চাপল্য হারিয়ে এক ভীরু জীবের মত অসহায় হয়ে গেল। হৃদয়হীন এই পরিবেশে ফটিকের মনে বার বার জেগে উঠত তার গ্রাম্য জীবনের স্মৃতি। তার মনে পড়ত ঘুড়ি ওড়ানোর সেই বিশাল মুক্ত মাঠ, স্বরচিত গান গেয়ে অকর্মণ্যভাবে ঘুরে বেড়ানো সেই নদীতীর, যখন-তখন ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটবার স্রোতস্বিনী, খেলার সঙ্গীদের, স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি অত্যাচারিণী মায়ের কথা। এই অবস্থায় বদ্ধ জীবনে থাকা ফটিক কখনও খোলা ছাদে দু-একটি ছেলেমেয়েদেরকে খেলতে দেখলে অধীর হয়ে উঠত।
৩১। “মামা, মার কাছে কবে যাব।”-বক্তা কে? বক্তার এইরূপ বলার কারণ কী?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র হতভাগ্য ফটিক হল আলোচ্য উক্তিটির বক্তা।
চঞ্চল ফটিক কেমন করে স্তিমিত হয়ে এল শহরের কঠিন প্রাচীরে প্রতিহত হয়ে, তার আকুল কান্না কীভাবে স্তব্ধ হয়ে গেল, কেমন করে এই মুক্ত-পাগল বালক চিরকালের মতো হারিয়ে গেল তার করুণ কাহিনি হল ‘ছুটি’। উদার-মুক্ত প্রকৃতির কোল থেকে, কলকাতায় ফটিকের এক দমবন্ধকরা পরিবেশে থাকতে হয়েছিল। একদিকে তেরো-চোদ্দো বছরের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন এবং সেখানে স্নেহের, ভালোবাসার পরিবর্তে অবহেলা, তাচ্ছিল্য, অপমান, লাঞ্ছনা। ক্লান্ত ফটিক দস্যি বালকের পরিবর্তে এক ভীরু জীবে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু মাঝে মাঝেই তার গ্রামের কথা, মায়ের কথা মনে পড়ত। তার অসহায়-অব্যক্ত বেদনা কোথাও প্রকাশ করবার উপায় ছিল না। মায়ের উপর স্বাভাবিকভাবে রাগ, অভিমান হলে ফটিকের মন সেই অত্যাচারিণী, অবিচারিণী মায়ের কাছে যেতে চাইত, কারণ মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা সর্বশ্রেষ্ঠ, নিখাদ সোনার মত উজ্জ্বল। তাই অসহায় ফটিক নিরুপায় হয়ে মামার কাছে বাড়ি যাওয়ার, জন্য কাতর অনুরোধ করেছিল। কিন্তু পুজোর ছুটির আগে তার বাড়ি যাওয়া সম্ভবপর নয় জেনে ফটিক হতাশ হয়ে গিয়েছিল।
৩২। “পরদিন প্রাতঃকালে ফটিককে আর দেখা গেল না।”-প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করো।
পদ্মাপাড়ে সাধনা পর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত বহুচর্চিত ছোটোগল্প হল ‘ছুটি’ প্রকৃতির উদার অসীমতায় মুক্তিলাভের ইচ্ছায় কাতর এক গৃহবন্দি বালকের অসহায় বেদনা ‘ছুটি’ গল্পে রূপ নিয়েছে।
স্বাভাবিক বয়সকালীন চাপল্য ও পড়াশোনায় উদাসীনতার কারণে ফটিকের মামা, ফটিককে কলকাতায় নিয়ে আসে। বিধবা অসহায় মা ফটিকের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেই সিদ্ধান্তে রাজি হয়। কিন্তু হতভাগ্য ফটিক কলকাতায় মামার বাড়িতে মামির কাছে দুর্বিষহ ছাড়া আর কিছু নয়। নিজের তিন সন্তান থাকলেও সদ্য কৈশোরে পা রাখা, গ্রাম্য, অশিক্ষিত ফটিককে তিনি কোনোদিন ভালোবাসেননি। স্নেহমমতা দিয়ে নিজের কাছে টেনে নেননি। ফলে একদিকে মায়ের স্নেহাঞ্চল-বঞ্চিত অন্যদিকে মামির ভর্ৎসনা, স্নেহহীনতা, বিদ্যালয়ের মাস্টারমশাই-এর অমানবিক আচরণ, মামাতো ভাইদের অপমান; সবকিছুর মধ্যে ফটিক একেবারে অসহায় ভীরু জীবে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবে উদাসীন ফটিক স্কুলের বই হারালে মামির ভর্ৎসনা শোনে। বয়ঃসন্ধিকালীন ধর্ম অনুসারে ফটিক এই সময় স্নেহের কাঙাল। সেখানে নারী মাত্র দেবী এবং তার ভালোবাসা ও স্নেহ কাম্য সেখানে মামি কোনোদিন কণামাত্র স্নেহ নিয়ে ফটিকের দিকে তাকায়নি। এমত অবস্থায় একদিন স্কুল থেকে ফেরার পর মাথাব্যথা ও গা শিরশির করে ফটিকের জ্বর আসে। ফটিকের অসুস্থতার কথা জানতে পারলে মামি কীরকম ব্যবহার করবে তা সে স্পষ্টভাবেই বুঝতে পেরেছিল এবং এই জ্বরে একমাত্র সে মা ছাড়া আর কারো কাছে সেবা ও ভালোবাসা পেতে পারে তা কল্পনাও করতে পারে না। তাই মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য অসহায়, নিরুপায় ফটিক সবার অজান্তে মামাবাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। আলোচ্য অংশে তাই ফটিককে আর পরেরদিন সকালে দেখতে পাওয়া যায় না।
৩৩। “দাও ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও।”-বক্তা কে? কাকে বলা হয়েছে? ‘ওকে’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? বক্তা ‘বাড়ি পাঠিয়ে দাও’ বলতে কী বুঝিয়েছেন? উক্তিটির মধ্য দিয়ে বক্তার চরিত্রের কোন্ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পের অন্তর্গত আলোচ্য অংশটির বক্তা হল বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী অর্থাৎ ফটিকের মামি।
ফটিকের মামি এই কথা তার স্বামী অর্থাৎ বিশ্বম্ভরবাবুকে বলেছিলেন। আলোচ্য অংশে ‘ওকে’ বলতে গল্পের প্রধান চরিত্র হতভাগ্য ফটিককে বোঝানো হয়েছে।
স্বহৃদয় বিশ্বম্ভরবাবু ফটিকের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কলকাতায় নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু মাতৃ স্নেহাঞ্চল ছেড়ে মামির হৃদয়হীন পরিবেশে ফটিক থাকতে পারেনি। কণামাত্র স্নেহের দৃষ্টিতে এই হতভাগ্য ছেলেটার প্রতি তিনি কোনোদিন তাকাননি। বই হারানোর কারণে মামির শ্লেষাত্মক বাক্যে তীব্র জ্বালা সহ্য করতে হয় তাকে। গৃহত্যাগী জ্বরাক্রান্ত ফটিককে যখন পুলিশ ফিরিয়ে আনে তখনও সামান্য সহানুভূতি না দেখিয়ে নির্মম কণ্ঠে ফটিককে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে আসার কথা জানিয়েছিল।
একজন অসুস্থ মানুষকে দেখে পথের পথিকেরও দয়ামায়া হয়। কিন্তু ফটিকের মামি নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন ও অমানবিক। তিনি মাতৃকুলের কলঙ্ক তাই সরল গ্রাম্য বালক ফটিকের মা হয়ে উঠতে পারেনি তিনি কখনও। এমন নির্মম নারী চরিত্র মানব সংসারে বিরল। তাঁর এই ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফটিককে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
৩৪। “মামা, আমার ছুটি হয়েছে কি।”-প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা লেখো।
পদ্মাপাড়ে সাধনাপর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্প থেকে আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে। এই গল্পের প্রধান চরিত্র গ্রাম্য, সরল, দুরন্ত, অবাধ্য, দস্যি বালক ফটিক। ফটিকের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মামা বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে কলকাতায় নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। সদ্য বিধবা, সহায়সম্বলহীনা ফটিকের মা দুরন্ত ছেলের এই সুব্যবস্থার সিদ্ধান্তকে মেনেও নেন। কিন্তু যে অবাধ্য, দুর্বিনীত, চঞ্চল বালককে গল্পের প্রথমে দেখা যায়, গল্পের শেষে সে পরিবর্তিত এক অন্য কিশোর। মামার বাড়ির অনাদর, অবহেলা, বিদ্যালয়ের শহুরে সর্তীথদের অবজ্ঞা, উপহাস, সর্বোপরি মামির স্নেহহীন নিপীড়নে ফটিক তার সহজ চাপল্য হারিয়ে হয়ে ওঠে ভীরু জীবের মতো অসহায়। মামার কাছে বাড়ি যাওয়ার কথা বলাতে সে জানতে পেরেছিল পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাবে। সেই বহু প্রত্যাশিত ছুটির অপেক্ষায় তার অধৈর্য প্রহর কেটেছে। কিন্তু এর মধ্যে বই হারানোর জন্য মামির কাছে এবং স্কুলে মাস্টারমশাইয়ের কাছে তিরস্কৃত হয়। নিজের দৈন্যতা ও হীনতার মর্মবেদনায় তার জ্বর আসে। অসুস্থ অবস্থায় মায়ের স্নেহের আশায় মামাবাড়ি ছেড়ে অজানা পথে বেরিয়ে পরে। কিন্তু হতভাগ্য নিরুদ্দিষ্ট বালক ফটিক যখন আবার মামাবাড়ি ফিরে আসে তখন তার শেষ যাত্রার সময়। প্রচন্ড জ্বরে ফটিকের প্রলাপ বাক্যের মধ্যেও ছিল ছুটি পাওয়ার তীব্র আকুলতা। রোগশয্যায় চারপাশে অবুঝ-বোবা দৃষ্টি নিয়ে সে খুঁজে ফিরেছে মাকে। কঠিন দেয়ালে বাধা পেয়ে তার আশা ফিরে এসেছে শূন্যতায়। শহর থেকে গ্রামে ফেরার জন্য তার ব্যাকুলতা ছিল তীব্রতর। খাঁচার জালে বন্দি বনের পাখির মতোই তার অসহ্য যন্ত্রণা তাকে মুক্তির জন্য ব্যাকুল করে তোলে। অসহায় ফটিক তাই বারবার প্রশ্ন করেছিল-‘কবে তার ছুটি হবে?’
৩৫। “এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলে-এ-এ-না।”-প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পদ্মাপাড়ের ছোটোগল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ছুটি’ গল্প। প্রকৃতির উদার অসীমতায় মুক্তিলাভের ইচ্ছায় কাতর এক গৃহবন্দি বালকের অসহায় বেদনা ‘ছুটি’ গল্পে রূপ নিয়েছে। এই গল্পের শেষ হয়েছে শহরের কৃত্রিম-অমানবিক পরিবেশে ফটিকের করুণ মৃত্যুতে। এই নিরাভরণ সাদামাটা গল্পটি রসোত্তীর্ণ হয়েছে এক দূরায়ত জীবনবোধের আবেদনে। ‘ছুটি’ নিছক এক শহরের পিঞ্জরে আবদ্ধ গ্রাম্যবালকের মৃত্যুর বেদনাময় কাহিনি নয়। গল্পটি অসামান্য মাত্রা পায় জল মাপার জন্য ‘এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে-এ-এ না’, -স্টিমারের খালাসিদের এই রশি ফেলার চিত্রকল্পের মাধ্যমে। ফটিকের চেতনার অতলে এই অভিজ্ঞতালব্ধ চিত্রকল্প নিহিত ছিল, মৃত্যুর মুহূতে সেই ছবি যেন ভেসে উঠেছে তার অবচেতন দর্পণে। বালক ফটিকের মৃত্যু যেন একটি সাংকেতিক চিত্রকল্পের অন্তহীন ব্যঞ্জনা আনে-‘যে অকূল সমুদ্র যাত্রা করিতেছে, বালক রশি ফেলিয়াও কোথাও তাহার তল পাইতেছে না।’ এই সুদুর অকূল সমুদ্রের বিশাল চিত্রপট পাঠক-হৃদয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে যেতে থাকে যেন, সেই নান্দনিক ইঙ্গিতেই নিহিত আছে গল্পটির গূঢ় রস ও রহস্য।
৩৬। “যে অকূল সমুদ্রে যাত্রা করিতেছে, বালক রশি ফেলিয়া কোথাও তাহার তল পাইতেছে না।”-বালক কে? অকূল সমুদ্র কী? সত্যিই কি এই সমুদ্রে তল পাওয়া যায় না?
আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে ‘বালক’ বলতে গল্পের প্রধান চরিত্র হতভাগ্য ফটিককে বোঝানো হয়েছে।
এই অংশে ‘অকূল সমুদ্র’ বলতে মৃত্যু পারাবারের জগৎকে বুঝিয়েছেন। মৃত্যুলোকের যে অন্ধকারময় দেশ, থাকে কূল কিনারাহীন সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
ফটিক তার মামার সঙ্গে কলকাতায় আসার সময় দেখেছিল স্টিমারের খালাসিরা রশি ফেলে ‘এক বাও মেলে না, দোঁ বাও মেলেনা’ বলে সুর করে জল মাপে। ফটিকের চেতনার অতলে এই অভিজ্ঞতালব্ধ চিত্রকল্প নিহিত ছিল, মৃত্যুর মুহূর্তে সেই ছবি ভেসে উঠেছে তার অবচেতনার দর্পণে। বাস্তবে কোনো নদী বা সমুদ্রের তল খুঁজে পাওয়া গেলেও ফটিক যে অকূল-অজানা মৃত্যুলোকের সমুদ্রে যাত্রা করেছিল, তাতে শত চেষ্টা করেও তল পাওয়া যায় না।
৩৭। “মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি”-বক্তা কে? তার ‘ছুটি-র স্বরূপ কী? ‘বাড়ি যাচ্ছি’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
আলোচ্য অংশের বক্তা হল রবীন্দ্রনাথ, ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পের নায়ক চরিত্র ফটিক।
এখানে রবীন্দ্রনাথ যে ছুটির কথা বলেছেন তা আমাদের আপাত স্কুল-কলেজের ছুটি নয়। এই ছুটির অর্থ গূঢ় ও গভীর। জীবন থেকে চিরকালের মতো মুক্তি বা বিদায়কে এখানে ছুটির ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
প্রকৃতির কোল থেকে বিচ্যুত কলকাতা শহরের লোহার কারাগারে অমানবিক পরিবেশে ফটিকের মতো নিষ্পাপ ফুল অকালে ঝরে যায়। ফটিকের অবচেতন মন বারবার ফিরে যেতে চেয়েছে তার গ্রামের বাড়িতে। তাই মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে সে প্রলাপ বকে, মাকে জানিয়েছে সে বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু এই বাড়ি মর্ত্যজগতের কোনো বাড়ি নয়। এই বাড়ি মুক্ত আত্মার চির-আনন্দস্থল অর্থাৎ মৃত্যুলোক বা পরলোক।
৩৮। “প্রকৃতির সাথে মানব-এর অছেদ্য বন্ধন নষ্ট হওয়ার ফলে ফটিকের মৃত্যু।”-বক্তব্যটির সত্যতা যাচাই করো।
অথবা, প্রকৃতির সঙ্গে ফটিকের অচ্ছেদ্য বন্ধনের পরিচয় দাও।
পদ্মাপাড়ে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যান্য ছোটোগল্পগুলির মতো ‘ছুটি’ গল্পেও প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের নিগূঢ় সম্পকের চিত্র এঁকেছেন। গ্রাম্য প্রকৃতির উদার অসীম মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা দুরন্ত বালক ফটিক কেমন করে শহরের চার দেয়ালের কঠিন বাঁধনে বন্দি হয়ে রইল, কেমন করে এই মুক্ত পাগল বালক চিরকালের মতো ছুটি নিয়ে হারিয়ে গেল- তারই বাস্তব করুণ কাহিনি হল ‘ছুটি’।
গ্রামবাংলার উদার আকাশের নীচে, পথে-প্রান্তরে, নদীর ঘাটে ছুটির আনন্দে দস্যি ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে সারাদিন ছুটে বেড়ানোই ছিল ফটিকের কাজ। কখনও ‘তাইরে-নাইরে নাইরে না’ স্বরচিত গান গেয়ে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো, কখনও ঢাউস ঘুড়ি নিয়ে ওড়ানো, যখন-তখন ঝাঁপ দিয়ে নদীতে সাঁতার কাটা-এইসবই ছিল ফটিকের প্রতিদিনের খেলাধুলার অঙ্গ। নিয়মমাফিক পড়াশোনা বা সাংসারিক কাজে তার কোনোদিনই মন ছিল না। ফটিক ছিল বনের মুক্ত পাখি আর প্রকৃতি ছিল তার স্বচ্ছন্দ্য, স্বাধীন চরাচর ক্ষেত্র। অনন্ত-উদার নীল আকাশে আপন মনে উড়ে বেড়ানো আর গান গাওয়াতেই ছিল তার প্রাণের মুক্তি, আত্মার আনন্দ। তাই গ্রাম্য-প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ফটিক কলকাতার শহরে ইট, কাঠ, পাথরের কারাগারে বন্দি হয়ে বাঁচল না। এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘বঁধু’ কবিতার বঁধুকে। তার মনে হয়েছিল-‘হায় রে রাজধানী পাষাণ কায়া’। ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক; ‘সুভা’ গল্পের সুভাষিণী ও ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদর মতো। প্রকৃতির বুকে বেড়ে ওঠা, প্রকৃতির ভাষা বোঝা সহজ-সরল নিষ্পাপ ফুল। ফটিক অন্তরঙ্গ তাৎপর্যেই গ্রামীণ প্রকৃতির সন্তান। কলকাতা তার পক্ষে প্রবাসজীবন। তাই গ্রামে ফিরতে সে ব্যাকুল। তার নিজের মা এবং প্রকৃতি মা এখানে অভিন্ন। মা-ই তার কাছে প্রকৃতির প্রতীক। তাই ‘বঁধু’ কবিতার মতোই প্রকৃতিহীন জীবন থেকে যদি প্রকৃতির বুকে ফিরে যেতে নাই পারে, তবে মৃত্যুই শ্রেয়-
“কবে পড়িবে বেলা ফুরাবে সব খেলা নিভাবে সব জ্বালা শীতল জল জানিস যদি কেহ আমায় বল্।”
৩৯। ‘ছুটি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ফটিকের চরিত্রে বয়ঃসন্ধিকালের বিড়ম্বনা এঁকেছেন, তার পরিচয় দাও।
সাধনাপর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র ফটিক। তেরো-চোদ্দো বছরের বালক ফটিক। এই তেরো-চোদ্দো বছর হল বয়ঃসন্ধিকাল। এই সময় শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিজনিত কারণে নানারকম আবেগ-অনুভূতি, কৌতূহল এবং চারপাশের মানুষের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যায়। ফটিক চরিত্রের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সুনিপুণভাবে এই বয়সটির স্বভাব তুলে ধরে বয়সটিকে বালাই বলেছেন। নানারকম শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায় বলেই শৈশবের লালিত্য চলে চায়। গলার স্বর পরিবর্তিত হয়, ফলে গলার স্বরের মিষ্টতা কমে যায়। আধো কথা ন্যাকামি আর পাকা পাকা কথা জ্যাঠামি বলে মনে হয়। কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করে তার শরীর বেমানান রূপে বেড়ে ওঠে। সেজন্য লোকে তাকে নিন্দা করে। সেও কারোর সঙ্গে সহজে মিশতে পারে না। শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলির জন্য সে নিজেকে সর্বদা অপরাধী মনে করে। এই বয়সের স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও ক্ষমার যোগ্য হয় না। এই বয়সের কিশোর স্নেহ-ভালোবাসার কাঙাল হয়। যে তাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে আপন করতে পারে, তার কাছে সে তি আত্মবিক্রয়ও করে থাকে। এইরকম এক সংবেদনশীল বয়স ধর্মের মধ্যে থাকা ফটিকের কপালে জুটেছিল মামির স্নেহহীন ভর্ৎসনা। ফলে ফটিকের অবস্থা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতোই হয়েছিল। এই সময় মা হল শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল। কিন্তু ফটিক মায়ের স্নেহাঞ্চল থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। বয়ঃসন্ধিকালের বিড়ম্বনার সার্থক সাযুজ্যে ফটিক রবীন্দ্রনাথের অনবদ্য চরিত্রসৃষ্টি।
আরও পড়ুন – বই কেনা প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর