মৌলানা আবুল কালাম আজাদের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা ব্যাখ্যা করো

মৌলানা আবুল কালাম আজাদের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা ব্যাখ্যা করো

মৌলানা আবুল কালাম আজাদের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা ব্যাখ্যা করো
মৌলানা আবুল কালাম আজাদের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা ব্যাখ্যা করো

মৌলানা আবুল কালাম আজাদের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা

মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন একজন আপসহীন জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী। স্বাধীনতা সম্পর্কে কোনো তত্ত্বগত ধারণার কথা তিনি বলেননি। পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মৌলানা আজাদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে, স্বাধীনতা সম্পর্কে তাঁর ধারণা পাওয়া যাবে। এগুলি হল-

[1] স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের আহ্বান: মৌলানা আজাদ তরুণ বয়সে তুর্কি বিপ্লবীদের সংস্পর্শে এসে বুঝতে পেরেছিলেন ভারতীয় মুসলিমদের উচিত দেশব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদের যুক্ত করা। তরুণ মৌলানা আজাদের সেই কুড়ি বছর বয়সেই মনে হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার যাতে কিছুতেই মুসলিমদের কাজে লাগাতে না পারে তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আরও মনে করতেন যে, ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে নতুন একটা আন্দোলন গড়ে তোলা খুব জরুরি। এসময় ভারতে মুসলিম রাজনীতি যাদের (আলিগড় পার্টির) হাতে ছিল তাদের মূল কথা ছিল, মুসলিমদের ব্রিটিশরাজের অনুগত হতে হবে এবং স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শত হস্ত দূরে থাকতে হবে। এই অবস্থা থেকে ভারতীয় মুসলিমদের বের করে এনেছিলেন মৌলানা আজাদ এবং পরে তাদের যুক্ত করেছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে।

[2] স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘আল হিলাল’ পত্রিকার ভূমিকা: তরুণ আজাদ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মুসলিম সমাজের গণজাগরণ গড়ে তুলতে যে সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘আল হিলাল’ প্রকাশ করেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উর্দু সাংবাদিকতার ইতিহাসে ‘আল হিলাল’ প্রকাশ এক যুগান্তকারী ঘটনা। ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ‘আল হিলাল’ যে বলিষ্ঠ জাতীয়তাবাদ প্রচার করেছিল ততে ভয় পেয়েছিল ব্রিটিশরা। শুধু ব্রিটিশরা নয়, তাদের অনুচর ব্রিটিশভক্ত মুসলিমরাও। শেষে ব্রিটিশ সরকার ভারত রক্ষা আইন ‘আল হিলাল’-এর সম্পাদক মৌলানা আজাদকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করে। শেষে তাঁকে বিহারের রাঁচীতে নজরবন্দি করা হয়।

[3] খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান: পরাধীন ভারতে যে খিলাফত অসহযোগ আন্দোলন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল, তাতে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সক্রিয়। মৌলানা আজাদ 1920 খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটির সভায় মুসলিমদের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিতে আন্তরিক আবেদন জানান। এ সময় আজাদ সারা দেশ জুড়ে অসংখ্য মিটিং করে গান্ধিজি ও অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে খিলাফত অসহযোগ আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলেন। ভারতীয় মুসলিমদের কাছে তিনি অসহযোগের প্রয়োজনীয়তা ও ব্রিটিশ বিরোধিতার কথা বুঝিয়েছেন। ছাত্রদের আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জনের।

[4] আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান: মৌলানা আজাদ কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে 1930 খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এসময় তাঁর প্রভাবে বেশ কিছু মুসলিম সংগঠন আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেয়। আইন অমান্য আন্দোলনের জন্য তাঁকে এক বছরেরও বেশি সময় আটক করে রাখা হয়।

[5] ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগদান: 1942 খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট বোম্বাইতে যখন অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ঐতিহাসিক অধিবেশনে ‘ভারত ছাড়ো’ (Quit India) প্রস্তাব নেওয়া হয়, তখন সভাপতি ছিলেন আজাদ। আমাদের কাছে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তর। তারপরই রাত না পোহাতেই সভাপতি-সহ ওয়ার্কিং কমিটির প্রথম সারির নেতাদের গ্রেফতার করা হয়।

[6] হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির সেতুবন্ধন: পরাধীন ভারতে স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ হিন্দু- মুসলিম সম্প্রীতির সেতুবন্ধনে বড়ো ভূমিকা পালন করেছিলেন। আজাদের বক্তব্য ছিল, ভারতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে হিন্দু-মুসলিমদের এক জাতি হিসেবে লড়তে হবে।

[7] স্বাধীনতা এক স্বাভাবিক বস্তু, স্বাধীনতা ঈশ্বরের উপহার: আজাদ মনে করতেন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ে তিনি নেমেছেন তা এক পবিত্র লড়াই। এডমন্ড বার্কের মতো তিনি বিশ্বাস করতেন, স্বাধীনতা এক স্বাভাবিক বস্তু, স্বাধীনতা ঈশ্বরের উপহার। কোনো দেশ যত মহানুভবই হোক-না-কেন তার অধিকার নেই অন্যকে পরাধীন করে রাখার। কারণ দাসত্ব হল ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধ এক বস্তু। মৌলানা আজাদ বিদেশি শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার লড়াইকে তাঁর ‘নৈতিক কর্তব্য’ বলে ঘোষণা করেছিলেন।

[৪] স্বাধীনতার যুদ্ধ রাষ্ট্রদ্রোহিতা না দেশপ্রেম: ব্রিটিশ সরকার মৌলানা আজাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছিল। সেই প্রেক্ষিতে আজাদ আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে কিন্তু আমি আগে বুঝি ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ কী? ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ কি সেটাই যে স্বাধীনতার যুদ্ধে সফল হয়নি? তা যদি হয়, আমি পরিষ্কারভাবে স্বীকার করছি ও একই সঙ্গে আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাইছি এটাই হবে দেশপ্রেম, যখন তা সফল হবে”।

[9] জিন্নার ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ এবং দেশভাগের কঠোর বিরোধিতা: মুসলিম লিগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্নার ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ অখণ্ড ভারতবর্ষকে খন্ডিত করার পথ প্রশস্ত করেছিল। 1930-এর দশকের শেষদিক থেকে জিন্না তাঁর কট্টর মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদী দ্বিজাতি তত্ত্বের সূচনা করেন। জিন্না অখণ্ড ভারতবর্ষকে ‘মুসলিম ভারত’ ও ‘হিন্দু ভারত’-এ ভাগ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, ‘জাতি’ শব্দের পরিভাষা অনুসারে মুসলিমরা যেহেতু জাতি তাই তাদের নিজস্ব বাসভূমি, ভৌগোলিক এলাকা এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজন।

মন্তব্য: কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে (1939-1946) মৌলানা আবুল কালাম আজাদ জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্ব ও দেশভাগের কঠোর বিরোধিতা করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই অন্তিম পর্বে ব্রিটিশ ভারতের সর্বোচ্চ প্রশাসক লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত ভাগের যে পরিকল্পনা করেন। তা মুসলিম লিগ এবং শেষপর্যন্ত কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ মেনে নিলেও কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আজাদ মানতে পারেননি। তিনি সুস্পষ্টভাষায় বলেছিলেন, “সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত বিভাজন উভয় পক্ষের মানুষের জন্যে ধ্বংস ডেকে আনবে।”

আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment