ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্বটি আলোচনা করো

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্বটি আলোচনা করো

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্বটি আলোচনা করো
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্বটি আলোচনা করো

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্ব

মূল বক্তব্য

আধুনিক রাষ্ট্রে সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করার জন্য প্রধান তিনটি বিভাগ হল আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল কথা হল, রাষ্ট্র পরিচালনার তিন প্রধান স্তম্ভ আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতার সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য। তিনটি বিভাগ পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবে এবং এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।

বৈশিষ্ট্য

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল-(১) শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য, (২) অন্য বিভাগের কাজে কোনোরকম হস্তক্ষেপ না করা, (৩) একই ব্যক্তির একাধিক বিভাগের পদে একই সময়ে নিযুক্ত না থাকা।

উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল স্রষ্টাদের মধ্যে রয়েছেন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্ল, রোমের দার্শনিক পলিবিয়াস ও সিসেরো, ফরাসি দার্শনিক জাঁ বোদী এবং ইংল্যান্ডের চিন্তাবিদ জন লক ও হ্যারিংটন। পরবর্তীকালে ফরাসি চিন্তাবিদ মতেস্কু এবং ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্ল্যাকস্টোনের রচনায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে। 1748 সালে মতেস্কু তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Spirit of the Laws প্রণয়ন করেন। এই গ্রন্থে তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার জন্য ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির কথা বলেন। মঁতেস্কর অভিমত হল, আইন ও প্রশাসনের ক্ষমতা যদি কোনো একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বৈরাচারী আইন প্রণয়ন করে তাকে যথেচ্ছভাবে প্রয়োগ করতে পারে। এর ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। কাজেই ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির স্বীকৃতি আবশ্যক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্ল্যাকস্টোন তাঁর Commentaries on the Laws of England গ্রন্থে প্রায় অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান রচয়িতাদের মধ্যে অন্যতম ম্যাডিসন ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি উদারভাবে গ্রহণ করার পক্ষে জোরালো যুক্তি দেখিয়ে বলেছিলেন, আইন, শাসন ও বিচারের সমস্ত ক্ষমতা একই বিভাগের হাতে থাকলে তা স্বৈরাচারিতায় পর্যবসিত হয়।

বাস্তব প্রয়োগ

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে সর্বপ্রথম বাস্তবে প্রয়োগ করা হয় 1787 সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে। মার্কিন সংবিধানের 1, 2 এবং 3 নং ধারা অনুযায়ী যথাক্রমে আইন, শাসন ও বিচারের যাবতীয় ক্ষমতা তিনটি বিভাগের হাতে আলাদাভাবে ন্যস্ত রয়েছে। 1789 সালে ফ্রান্সের গণপরিষদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে অপরিহার্য বলে ঘোষণা করে। বর্তমানে মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তব প্রয়োগ লক্ষ করা যায়।

সমালোচনা

[1] বাস্তবায়ন দুরূহ: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা হল বাস্তবে এই নীতির পূর্ণ প্রয়োগ আদৌ সম্ভব নয়। কারণ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের প্রধান তিনটি বিভাগকে কখনোই পুরোপুরি স্বতন্ত্র করা যায় না।

[2] পূর্ণ প্রয়োগ অনভিপ্রেত: জন স্টুয়ার্ট মিল, ব্লুন্টন্সি, ফাইনার, ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির পূর্ণ প্রয়োগ আদৌ কাম্য নয়। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করলে এই স্বাতন্ত্র্য বিরোধ ডেকে আনবে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পটভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বয়ং ম্যাডিসন ও অন্য যুক্তরাষ্ট্রীয়পন্থীরা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন যে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলে প্রশাসন অচল হয়ে পড়বে।

[3] ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ নয়: গিলক্রিস্ট, স্যাবাইন প্রমুখ আধুনিক লেখকরা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলে মেনে নেননি। কারণ, আইন বিভাগ যদি স্বৈরাচারী হয়, তবে তার দ্বারা প্রণীত স্বৈরাচারী আইনকে কার্যকর করতে শাসন বিভাগ যেমন বাধ্য থাকে, তেমনি সেই আইন অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন করতে বিচার বিভাগও বাধ্য। সুতরাং, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ কখনোই ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ হতে পারে না।

[4] তিন বিভাগের অসম ক্ষমতা: সমালোচকরা শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে সমক্ষমতাসম্পন্ন বলতে রাজি হননি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন বিভাগ তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষমতার অধিকারী। কারণ আইন বিভাগের প্রণীত আইন অনুসরণ করে শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে চলতে হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে আইনসভা হল চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।

[5] জৈব মতবাদীদের সমালোচনা: বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্লুন্টসলির মতে সরকার হল জীবদেহের মতো। দেহ থেকে মস্তিষ্ককে পৃথক করলে জীবদেহের মৃত্যু যেমন অবশ্যম্ভাবী, ঠিক তেমনি সরকারের প্রধান বিভাগগুলিকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করলে সরকারের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।

[6] মার্কসবাদী সমালোচনা: মার্কসবাদী সমালোচকরা সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্বের সাফল্য সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মার্কসবাদীদের মতে, অসমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকার এক বিশেষ শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে চলে। কাজেই এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ অর্থহীন।

[7] সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় প্রয়োগ অসম্ভব: যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বা মন্ত্রীসভা-চালিত শাসনব্যবস্থা রয়েছে (যেমন ব্রিটেন, ভারত ইত্যাদি), সেখানে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় থাকায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ সম্ভব নয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, বাস্তবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পূর্ণ প্রয়োগ কখনোই কাম্য নয়। তবে আংশিক ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রয়োজন। কারণ ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচারের স্বার্থে বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য অপরিহার্য।

আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment