আইনের অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো

আইনের অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো। অথবা, আইনের সংজ্ঞা দাও ও আইনের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করো

আইনের অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো
আইনের অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো

আইনের অর্থ

ব্যাপক এবং সংকীর্ণ-উভয় অর্থেই আইন কথাটির ব্যবহার প্রচলিত আছে। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইন শুধু সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট বা স্বীকৃত আইন একমাত্র আলোচ্য বিষয়।

[1] অধস্তনের প্রতি ঊর্ধ্বতনের আদেশ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আইনের সংজ্ঞা দিয়েছেন। জন অস্টিনের মতে, আইন হল অধস্তনের প্রতি ঊর্ধ্বতন রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্বের আদেশমাত্র। বিশ্লেষণপন্থী লেখক হল্যান্ডের মতে, সার্বভৌম রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্ব দ্বারা প্রযুক্ত মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ নিয়মই আইন।

[2] সব আইন সার্বভৌম শক্তির আদেশ নয়: স্যাভিনি, হেনরি মেইন, মেইটল্যান্ড ক্লার্ক প্রমুখ ঐতিহাসিক মতবাদে বিশ্বাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি, প্রথা ইত্যাদি সাধারণভাবে আইনের মর্যাদা লাভ করে। তাই সব আইনকে সার্বভৌম শক্তির আদেশ বলে অভিহিত করা যুক্তিযুক্ত নয়। দ্যুগুই, ক্লাবে প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানীর মতে, নানান সামাজিক কারণ ও প্রভাবের ফলে আইনের সৃষ্টি হয় এবং আইন সমাজের কল্যাণ সাধন করে বলেই মানুষ তা মেনে চলে।

[3] রাষ্ট্র দ্বারা গৃহীত মানুষের আচার, ব্যবহার ও চিন্তার অংশ: উইলসনের মতে, আইন হল মানুষের স্থায়ী আচার, ব্যবহার ও চিন্তার সেই অংশ যা রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত বিধিতে পরিণত হয়েছে এবং যার পিছনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সুস্পষ্ট সমর্থন আছে।

[4] বৈধ এবং নৈতিক মূল্যবিশিষ্ট: বার্কারের অভিমত হল, আইন শুধু রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত, ঘোষিত এবং প্রযুক্ত হলেই চলবে না, তাকে ন্যায়সম্মত ও যুক্তিসংগত হতে হবে। তাঁর মতে, আদর্শ আইনের দুটি উপাদান রয়েছে- (i) বৈধতা এবং (ii) নৈতিক মূল্য। বৈধতা বলতে বোঝায় আইনটি রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত, ঘোষিত এবং প্রযুক্ত; অন্যদিকে নৈতিক মূল্যের অর্থ হল আইনটি ন্যায়বোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

[5] শাসকশ্রেণির ইচ্ছা: মার্কসীয় মতবাদ অনুযায়ী, আইন রাষ্ট্রপ্রকৃতির সঙ্গে অভিন্নভাবে জড়িত। সমাজের প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্ককে বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্র আইন তৈরি করে। আইন শাসকশ্রেণির ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে।

আইনের প্রকৃতি

আইনের প্রকৃতি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। আইনের প্রকৃতি-সম্পর্কিত মতবাদগুলি হল- [1] দার্শনিক মতবাদ, [2] বিশ্লেষণমূলক মতবাদ, [3] ঐতিহাসিক মতবাদ, [4] তুলনামূলক মতবাদ, [5] সমাজবিজ্ঞানমূলক মতবাদ এবং [6] মার্কসীয় মতবাদ।

[1] দার্শনিক মতবাদ: আইনকে বাস্তব দৃষ্টিতে বিচারবিশ্লেষণ করার বদলে আদর্শের প্রকাশ হিসেবে বর্ণনার মাধ্যমে দার্শনিক মতবাদের সূচনা হয়। দার্শনিক মতবাদ আইনব্যবস্থাকে নৈতিক মানদণ্ডে বিচার করতে চায়। অ্যারিস্টট্ল আইনকে যুক্তিনির্ভর বুদ্ধির প্রকাশ বা ‘Expression of Rea- son’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। স্টোয়িক দার্শনিকরা প্রাকৃতিক আইন বা Natural law-কে আইনের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। রুশোর বক্তব্য অনুযায়ী, আইন হল ‘সাধারণ ইচ্ছা’র প্রকাশ।

[2] বিশ্লেষণমূলক মতবাদ: বিশ্লেষণমূলক মতবাদে আইনকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির নির্দেশ বলে অভিহিত করা হয়েছে (command of the human superior)। এই মতবাদ অনুসারে, আইনের প্রতি স্বাভাবিক আনুগত্য দেখানো জনগণের কর্তব্য। ব্রিটিশ দার্শনিক হন্স সার্বভৌম শক্তির অধিকারী রাজার আদেশকে আইন বলে বর্ণনা করেছেন। অস্টিনের মতে, আইন হল সার্বভৌম শক্তির আদেশ। এই আইনের সঙ্গে নৈতিক সূত্র অথবা প্রথার কোনো সম্পর্ক নেই।

[3] ঐতিহাসিক মতবাদ: ঐতিহাসিক মতবাদের বক্তব্য হল, সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের নেপথ্যে যেসব প্রথা, রীতিনীতি, লোকাচার প্রভৃতি কাজ করে, কালক্রমে সেগুলি আইনের মর্যাদা পায়। কাজেই আইনকে শুধু সার্বভৌম শক্তির আদেশ হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না। স্যাভিনির মতে, আইন সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের কাজ নয়। আইনের প্রয়োগ করা হল রাষ্ট্রের প্রকৃত কাজ।

[4] তুলনামূলক মতবাদ: তুলনামূলক মতবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন ইংল্যান্ডের এক বিখ্যাত আইনবিদ স্যার ভিনগ্রাডফ। এই মতবাদ আইনব্যবস্থার প্রকৃতি উদ্‌ঘাটনের জন্য তুলনামূলক আলোচনায় বিশ্বাসী। এজন্য বিভিন্ন দেশের আইনব্যবস্থার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করা হয়। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে আইনব্যবস্থার বিকাশের একটা ধারণা পাওয়া যায়। যেমন, কোনো রাষ্ট্রে দমনপীড়নমূলক আইনের প্রয়োগ যথেচ্ছভাবে ঘটলে সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। তুলনামূলক মতবাদ অনুসারে, অতীতের আইনব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমানের আইনব্যবস্থার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে আইনের প্রকৃতি সম্পর্কে একটি সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যায়।

[5] সমাজবিজ্ঞানমূলক মতবাদ: এটি আইনের প্রকৃতি বিশ্লেষণে অন্যতম আধুনিক মতবাদ। এই মতবাদের প্রবক্তাদের মতে, সামাজিক কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যেই আইনের সৃষ্টি হয়েছে। আইন সমাজের কল্যাণ সাধন করে বলে লোকে আইন মেনে চলে। আইন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টি, এই যুক্তি ভ্রান্ত। কারণ রাষ্ট্র সৃষ্টির আগেই এর উৎপত্তি হয়েছিল। আইন হল সমাজের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী কয়েকটি নিয়মকানুনমাত্র। ব্যক্তি সামাজিক ঐক্যের প্রয়োজনে সচেতনভাবে আইন মেনে চলে।

[6] মার্কসীয় মতবাদ: মার্কসীয় মতবাদ অনুযায়ী, আইন রাষ্ট্রপ্রকৃতির সঙ্গে অভিন্নভাবে জড়িত। সমাজের প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্ককে বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্র আইন তৈরি করে। মার্কস ও এঙ্গেলসের মতে, শাসকশ্রেণির ইচ্ছা ছাড়া আইন আর কিছু নয়। সমাজবিকাশের বিভিন্ন স্তরে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণি নিজেদের স্বার্থে আইনকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে।

মন্তব্য: আইনের অর্থ ও প্রকৃতি সতত পরিবর্তনশীল। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনের অর্থ ও প্রকৃতির বদল ঘটেছে।

আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment