ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা প্রবন্ধ রচনা
১৭ জুন, ২০২৪। সোমবার সকাল ৮টা ৩২ মিনিট। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের কাছে রাঙাপানি ও নিজবাড়ি স্টেশনের মধ্যে সিগন্যাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কলকাতামুখী ডাউন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। সময় গড়িয়ে পৌনে ৯টা। হঠাৎই বিকট শব্দ! আর্তনাদ! ঘটল ভয়াবহ দুর্ঘটনা! ট্রেনটিকে পিছন দিক থেকে এসে ধাক্কা মারল একটি মালগাড়ি। গত বছরের ওড়িশার স্মৃতি উসকে দিয়ে গেল এই ঘটনা।
ভয়াবহ এই ট্রেন দুর্ঘটনায় কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের তিনটি কামরা লাইনচ্যুত হয়। উল্লম্বভাবে উপরে উঠে যায় কয়েকটি কামরা। নিহত হন মালগাড়ির চালক। যাত্রীদের আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়তে থাকে পার্শ্ববর্তী এলাকায়। উদ্ধারকার্যে প্রাথমিকভাবে ছুটে আসে স্থানীয়রাই। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া কামরাগুলির ভিতর থেকে যাত্রীদের বার করে আনা হয়। প্রায় এক ঘণ্টা পর এসে পৌঁছোয় এন ডি আর এফ কর্মীরা এবং অন্যান্য উদ্ধারকারী বাহিনী ও সামাজিক সংগঠনগুলি। হতাহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর উদ্যোগ চলতে থাকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেদিন ছিল কুরবানির ইদ। উৎসব স্থগিত রেখেই গ্রামবাসী সেদিন ছুটে আসে দুর্ঘটনাগ্রস্তদের উদ্ধারকর্মে। সত্যিই তো, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। পঞ্চাশেরও বেশি অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছোয় ঘটনাস্থলে। আহতদের তৎক্ষণাৎ উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ এবং অন্যান্য হাসপাতালে পাঠানো হতে থাকে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের গার্ড আশিস দে-ও মারা গিয়েছেন দুর্ঘটনায়। জানা গিয়েছে, সেদিন তার ডিউটি ছিল শতাব্দী এক্সপ্রেসে। নিয়তিই টেনে নিয়ে গেল তাকে। সকাল হতে-না-হতেই কতশত প্রাণ ঝরে পড়ল অকালে। কেবল কি ঘটনাস্থল, সারা দেশজুড়ে সেদিন আবারও স্বজনহারাদের হাহাকার। এ দায় কার?
রেল দপ্তর অবশ্য মালগাড়ির চালককেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এটাই কি সঠিক সিদ্ধান্ত? উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের চিফ কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটি জনককুমার গর্গ বিভাগীয় তদন্ত করবেন বলে জানিয়েছেন। ঘটনাস্থল দেখে গিয়েছেন রেল মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষুবও। কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে রেলের দেখভালে অবহেলার প্রসঙ্গটিই বারবার উঠে আসছে। রেল বোর্ডের তরফে দাবি করা হয়, মালগাড়ির চালক সিগন্যাল না মানায় এই কাণ্ড।
কিন্তু সংশয় এখানে যে, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস যে কোচ দিয়ে চালানো হচ্ছে, তার সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ হয় না কেন! কিংবা দুই ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ আটকাতে তৈরি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ‘কবচ’ কেন সব ট্রেনের ক্ষেত্রে চালু হয়নি। প্রাক্তন রেলকর্তাদের তরফে প্রশ্ন উঠেছে, মালগাড়ির চালকই বা কীভাবে সিগন্যাল না পেয়েও পূর্ণ গতিতে ট্রেন চালিয়ে দিলেন? এমনকি দুর্যোগের কারণে যে সিগন্যালের ত্রুটি ছিল, এটা জানার পরও কেন ‘অ্যাবসলিউট ব্লক সিস্টেমে’ রাঙাপানি থেকে ট্রেন চালানো হল না?
১৭ জুনের ঘটনায় মারা গিয়েছেন প্রায় পনেরো জন। আহত ৫০-এরও বেশি। মালগাড়ির সহকারী চালক মনু কুমারের শারীরিক অবস্থাও আশঙ্কাজনক। এই দুর্ঘটনায় অনেক রেলকর্মীও নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে রেল দপ্তর।
রেল মন্ত্রী অশ্বিনী বৈয়ব মৃতের পরিবারপিছু দশ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পাশাপাশি গুরুতর আহতদের আড়াই লাখ টাকা এবং স্বল্প আহতদের ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা-সহ স্বজনহারা পরিবারবর্গের পাশে দাঁড়িয়েছে সমগ্র দেশ। দেশের বিভিন্ন মহল থেকে এসেছে শোকবার্তা।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিশ্বে দাঁড়িয়েও এদেশে আর কত দুর্ঘটনা ঘটবে? যে পরিবহণ মাধ্যম ব্যবহার করে ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, তার এই দুর্ব্যবস্থা নিত্যযাত্রীদের কপালে ভাঁজ ফেলছে প্রতিমুহূর্তে। ভারতীয় রেল মন্ত্রকের কাছে তাই প্রার্থনা, দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর নয়! সামান্য ভুলত্রুটিগুলো নিষ্ঠাভরে শুধরে নিলেই আগামী দিনে বাঁচবে শতাধিক প্রাণ।
আরও পড়ুন – ভারতে প্রচলিত ভাষা পরিবার MCQ