ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কবিতার বিষয়বস্তু
‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ সনেটটি হল অন্তরের অক্ষরে বিদ্যাসাগরের প্রতি মধুসূদনের শ্রদ্ধা রচনা। সনেট হল ১৪ পঙ্ক্তির এক ধরনের বিশিষ্ট কাব্যরীতি। সাধারণত সনেট দুটি স্তবকে বিভক্ত হয়ে থাকে। প্রথম ৮টি পক্তি নিয়ে গঠিত হয় অষ্টক (Octave) এবং পরবর্তী ৬টি পক্তি নিয়ে গঠিত হয় ষটক (Sestet)। অষ্টকে যে মূলভাবটি উপস্থাপিত হয় ষটকে তারই বিস্তার অথবা ব্যাখ্যা লক্ষ করা যায়। একটিমাত্র অখণ্ড মূলভাব নিয়েই রচিত হয় সনেট। বাংলায় প্রথম সনেট রচনার ঐতিহাসিক গৌরবও – মধুসূদনেরই প্রাপ্য।
আলোচ্য সনেটটির মূলভাব হল বিদ্যাসাগরের প্রতি কবির কৃতজ্ঞতা স্বীকার। অষ্টকের প্রথমে ঈশ্বরচন্দ্রের বিদ্যাসাগর ও করুণাসাগর সত্তার তুলনা করার পর আকস্মিকভাবেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে তাঁর এদেশীয় প্রিয়জনেদের কারণে প্রবাসী জীবনে নির্দয়ভাবে প্রতারিত হওয়ার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটুকু দিয়েছেন মাত্র। এরপরেই গিরিশ্রেষ্ঠ হিমালয়ের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রকে অভিন্ন জ্ঞানে বন্দনা করেছেন কবি।
ষটকে কবিকল্পনায় গিরীশের মধ্যেই লীন হয়ে গেছেন ঈশ্বরচন্দ্র। মহিমময় হিমালয়তুল্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী যে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর দাক্ষিণ্য লাভ করে প্রবাস জীবনের বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছেন কবি। তাই কবি নিজে কতটা সৌভাগ্যবান সে কথাই প্রকাশ করেছেন ষটকে।
প্রসঙ্গ অষ্টক এবং প্রাসঙ্গিক ইতিহাস
ব্যারিস্টার হওয়ার লক্ষ্যে ৯ জুন ১৮৬২, সোমবার সকাল বেলায় কলকাতা থেকে বিলেতের উদ্দেশ্যে পাল তোলেন মধুসূদন। নিজ সম্পত্তি জনৈক মহাদেব চট্টোপাধ্যায়কে মাসিক ৪০০ টাকার বিনিময়ে লিজ-এ দিয়ে যান মধুসূদন। জামিন হিসেবে ছিলেন দিগম্বর মিত্র এবং বৈদ্যনাথ মিত্র। কিন্তু কয়েক মাস পরেই আকস্মিকভাবে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন মহাদেব চট্টোপাধ্যায়। কথা ছিল কলকাতায় কবিপত্নী হেনরিয়েটা পাবেন ১৫০ টাকা এবং মধুসূদনকে পাঠানো হবে ২৫০ টাকা করে। নিরুপায় হেনরিয়েটাও কলকাতায় থাকার পরিবর্তে লন্ডনে স্বামীর কাছে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
এর ফলে, কবির বিপদ বেড়ে গেল আরও বহুগুণ। নিরন্তর চিঠি লেখা সত্ত্বেও উপরোক্ত তিনজন নির্দয়ভাবে নিরুত্তর এবং নিষ্ক্রিয় রইলেন। সুদূর প্রবাসে ঋণে জর্জরিত কবির জেলে যাওয়া যখন প্রায় সুনিশ্চিত, সেই সময়েই দুর্গত মধুসূদনের পরিত্রাতা হয়ে আসেন ঈশ্বরচন্দ্র। সুদূর প্রবাসে আক্ষরিক অর্থেই ঈশ্বরচন্দ্র হয়ে ওঠেন দীনবন্ধু।
করুণার সাগর বিদ্যাসাগর
কবিতার শুরুতেই মধুসূদন ঈশ্বরচন্দ্রের দুটি সত্তার উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিসেবে ভারত-বিখ্যাত এবং দ্বিতীয়ত, কবির ব্যক্তিগত উপলব্ধিতে তিনি ‘করুণার সিন্ধু’ অথবা ‘করুণার সাগর’। সহজ অর্থে, করুণা হল অপরের দুঃখ দূর করার আন্তরিক এবং নিঃস্বার্থ আকাঙ্ক্ষা। এই নিঃস্বার্থ মনোভাবই মানুষকে ঈশ্বরতুল্য করে গড়ে তোলে। অর্থাৎ, বিদ্যা কিংবা জ্ঞান মানুষের মেধাশক্তির প্রকাশ। অন্যদিকে, সহৃদয় করুণা হল মনুষ্যত্বের সবচেয়ে বড়ো লক্ষণ। মনুষ্যত্ব যেমন জ্ঞানের চেয়েও উন্নততর তেমনই করুণার সিধুও বিদ্যার সাগরের চেয়ে মহত্তর এই উপলব্ধিই স্পষ্ট হয়েছে এখানে।
সূর্যকরোজ্জ্বল পৃথিবীতে হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান। সেই হেমাদ্রির সুবর্ণ চরণে তিনি নাকি বহু ভাগ্যবলে আশ্রয় পেয়েছেন। ‘হেম’ অর্থাৎ সোনা এবং ‘অদ্রি’ অর্থাৎ পর্বত। কিন্তু সাধারণ হিসাবে পর্বত কখনও সোনার হয় না। কিন্তু হিমালয়ের বরফাচ্ছাদিত শিখরে যখন সূযের কিরণ প্রতিফলিত হয় তখন তা হেমকায়া লাভ করে। বন্ধুর শৈলপথ যেমন হিমালয়ের সুবর্ণ কান্তির কাছে নতি স্বীকার করে, জীবনের চরম দুরবস্থাও বিদ্যাসাগরের করুণার সুবর্ণ স্পর্শে তেমনি মুছে যায়-জীবন হয়ে ওঠে দ্যুতিময়। মধুসূদনের জীবনও চরম দুবিপাক থেকে উদ্ধার পায় হিমালয় সদৃশ সত্তার অধিকারী বিদ্যাসাগরের করুণার হেম স্পর্শে।
ষটক প্রসঙ্গ
প্রতারণা বনাম করুণার ব্যক্তিগত ইতিহাসের দ্বন্দ্ব অতিক্রম করে ষটকে কবি গিরীশরূপী ঈশ্বরচন্দ্রের বিবিধ উপকারের বহুমাত্রিক প্রকাশ ঘটিয়ে বলেছেন,
১। গিরীশের অর্থাৎ, হিমালয়ের সে সুখ-সদনে বিমলা নাম্নী নদীরূপিণী দাসী তৃষ্ণার্তকে জল দান করে।
২। দাসরূপে অমৃত ফল জোগায় হিমালয়বাসী দীর্ঘশির তরুদল।
৩। কুসুমদলও সুগন্ধে ভরিয়ে তোলে দশ দিগন্ত।
৪। দেবী বনেশ্বরীর শীতলশ্বাসী ছায়া যেমন ব্যক্তিকে দিনের বেলায় স্নিগ্ধ করে তোলে একই সঙ্গে রাত্রিবেলায় সুশান্ত নিদ্রাদানে তার ক্লান্তিও দূর করে।
সুদূর প্রবাসে বিপন্ন এবং প্রতারিত মধুসূদনের অন্নজলের সংস্থান করেছিলেন বিদ্যাসাগর। জল এবং অমৃত ফল তারই ইঙ্গিত। চরম বিপর্যয়কর মুহূর্তে বিদ্যাসাগর পাশে এসে না দাঁড়ালে মধুসূদনের সমস্ত কামনা-কুসুমের ঝরে পড়াটা ছিল অনিবার্য। সুরভি ছড়িয়ে দেওয়ার সামান্যতম সম্ভাবনাও থাকত না। শ্বাপদ-সংকুল অরণ্যে বনদেবী যেমন করে তাঁর শরণাগত সন্তানকে রক্ষা করেন, শীতল করেন এবং নিশ্চিন্ত নিদ্রা দান করেন তেমন করেই বিদ্যাসাগরও রক্ষা করেছিলেন মধুসূদনকে।
ঈশ্বরচন্দ্রের হৃদয়ের প্রশংসা করতে গিয়ে মধুসূদন লিখেছিলেন, বিদ্যাসাগরের হৃদয় ছিল একজন বাঙালি মায়ের মতোই (কোমল); ‘the heart of a Bengali mother’। কবিকথিত এই দেবী বনেশ্বরী হলেন মূলত বনদুর্গা, বনষষ্ঠী, বনচণ্ডীরই একটি রূপ। মুসলিম সমাজে তিনিই বনবিবি নামে পূজিতা হন। ভক্তবৎসল, দয়াবতী, লাবণ্যময়ী এই দেবী ব্যাঘ্রবাহনা। তাঁর একটি হাতে লাঠি এবং অপর হাতে থাকে ত্রিশূল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে, তাঁর কোলে থাকে একটি ছেলে যার নাম ‘দুখে’। এই দুখে কি মধুসূদন নিজেই নন! মাতৃহৃদয়ে বিদ্যাসাগর তাঁকেই তো রক্ষা করেছিলেন। লৌকিক বিশ্বাসে এই বনেশ্বরী আসলে বিশ্বমাতা। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, বনদুর্গা বা বনেশ্বরী হল হিমালয়কন্যা পার্বতীরই একটি রূপ।
ঈশ্বরচন্দ্র যেমন একই সত্তায় বিদ্যা ও করুণার সাগর ঠিক তেমন তাঁর হৃদয়ও একই সঙ্গে পর্বতশ্রেষ্ঠ হিমালয়ের মতো দানবীর এবং বাঙালি মায়ের মতোই কোমল ও স্নিগ্ধ।
আরও পড়ুন – ভারতে প্রচলিত ভাষা পরিবার MCQ