নৈতিক বিচারের প্রকৃত কর্তা কে তা আলোচনা করো
নৈতিক বিচারের প্রকৃত কর্তা
নীতিবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তার বিষয়বস্তুকে নির্ধারণ করাই যথেষ্ট নয়, নৈতিক বিচারের প্রকৃত কর্তা (Subject) কে, তা-ও নির্ণয় করা উচিত। স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নগুলি এক্ষেত্রে উঠে আসে, তা হল-নৈতিক বিচারের প্রকৃত কর্তা কে? অর্থাৎ বলা যায় যে, নৈতিক কর্মের বিচারের অধিকারী কে? নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্নরকম অভিমতের সম্মুখীন যেমন হই, তেমনই আবার নৈতিক বিচারের কর্তা কে?-এরূপ বিষয়টির ক্ষেত্রেও আমরা বিভিন্নরকম অভিমতের পরিচয় পেয়ে থাকি। এই সমস্ত অভিমতগুলির সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল।
[1] নৈতিক বিচারের কর্তার আসনে বিবেক
অনেক নীতিবিজ্ঞানীই নৈতিক বিচারের কর্তার আসনে বিবেককে অধিষ্ঠিত করেছেন। এই ধরনের নীতিবিজ্ঞানীদের অন্যতম হলেন প্রখ্যাত স্বজ্ঞাবাদী দার্শনিক বিশপ বাটলার (Butler) এবং বিচারবাদী দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (Kunt)। এঁরা মূলত বিবেক (Conscience) কেই নৈতিক বিচারের কর্তারূপে উল্লেখ করেছেন। বিবেককেই এঁরা উচ্চতম মানসিক বৃত্তিরূপে স্বীকার করে নিয়েছেন। বিবেককেই এঁরা নৈতিকতার উৎস বলে গণ্য করেন এবং সেই কারণেই একমাত্র বিবেককেই নৈতিক বিচারের কর্তার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।
বিবেকই হল মানুষের সর্বোচ্চ বৃত্তি এবং তা নৈতিকতার আধাররূপে গণ্য। বিবেকই মানুষের কৃতকার্যের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় প্রভৃতি স্থির করে এবং কোল্টা মানুষের করা উচিত সে সম্পর্কে নির্দেশ প্রদান করে। স্বাভাবিকভাবেই বিবেকের মধ্যে – দুটি দিক দেখা যায়- (i) জ্ঞানাত্মক দিক এবং (ii) নির্দেশাত্মক দিক। জ্ঞানাত্মক দিকের সাহায্যে বিবেক স্থির করে যে, কোন্টি যথার্থ এবং কোন্টি অযথার্থ। অর্থাৎ, বিষয় সম্পর্কে আমাদের একপ্রকার সঠিক জ্ঞান দান করে। অপরদিকে, নির্দেশাত্মক দিকের সাহায্যে বিবেক আমাদেরকে একপ্রকার নির্দেশ দেয় যে, আমাদের কোল্টা করণীয় বা করা উচিত। এরূপ নির্দেশ অনুসারেই আমরা আমাদের নৈতিক কর্মগুলিকে সম্পাদন করি। প্রখ্যাত নীতিবিজ্ঞানী কান্ট তাই নৈতিকতাকে বিবেকের নির্দেশরূপে উল্লেখ করেছেন।
[2]নৈতিক বিচারের কর্তার আসনে নৈতিক ব্যক্তিত্ব
অনেক নীতিবিদই মনে করেন যে, নৈতিক বিচারের কর্তার ভূমিকায় নৈতিক ব্যক্তিত্বকেই স্বীকার করে নেওয়া উচিত। কারণ, একমাত্র নৈতিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিরাই কোনো কর্মের ভালো-মন্দ বিচার করতে পারে। স্বাভাবিকভাবে তাই উল্লেখ করা যায় যে, যাদের মধ্যে কোনো নৈতিক ব্যক্তিত্ব নেই-তারা কখনোই কোনো কর্মের ভালো-মন্দ বিচার করতে পারে না। অর্থাৎ, তাদের দ্বারা নৈতিক বিচার আদৌ সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, যাঁরা সংগীত বোঝেন অর্থাৎ যাঁরা সংগীতজ্ঞ তাঁরাই কেবলমাত্র সংগীতের বিচার করতে পারেন।
আবার যাঁরা খেলাধুলা বোঝেন, তাঁরাই শুধুমাত্র খেলাধুলার বিচার করতে পারেন। একইভাবে বলা যায় যে, যাঁদের মধ্যে নৈতিক ব্যক্তিত্ব আছে, অর্থাৎ যাঁরা নৈতিকবোধসম্পন্ন, তাঁরাই শুধুমাত্র নৈতিক বিচারে কর্তারূপে গণ্য হতে পারেন, অন্য কোনো ব্যক্তি নয়। এরূপ অভিমতের সমর্থকদের অন্যতম হলেন- শ্যাফ্টবেরি (Shaftesbury)। কোনো কর্ম নৈতিক কি নৈতিক নয়, তা কর্মকর্তাই যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম। যে-কোনো নৈতিক ব্যক্তিত্বই এর যথাযথ বিচার করতে পারে না। সুতরাং বলা যায় যে, কোনো নৈতিক ব্যক্তিত্ব নয়, নৈতিক কর্মকর্তাই নৈতিক বিচারের কর্তারূপে গণ্য।
[3]নৈতিক বিচারের কর্তার ভূমিকায় নিরপেক্ষ দর্শক
অনেক চিন্তাবিদ ও নীতিদার্শনিক মনে করেন যে, নৈতিক বিচারের কর্তারূপে নিরপেক্ষ দর্শককে উল্লেখ করা যায়। কোনো কাজ নৈতিকতাসম্পন্ন কী না তা কর্মকর্তা কখনোই নিজে স্থির করতে পারেন না। কর্মকর্তা নৈতিকতা সম্পন্নরূপে গণ্য হলেও তার কর্মের মধ্যে অনেক সময় নৈতিকতার বিষয়টি প্রকাশিত নাও হতে পারে। সেই কারণেই বলা যায় যে, মানুষ নিজেই কখনও নিজের কর্মের নৈতিক বিচার করতে পারে না। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হল নিরপেক্ষ দর্শকের। একমাত্র নিরপেক্ষ দর্শকই কর্মকর্তার কর্মকে বিচারবিশ্লেষণ করে, তা নৈতিকতা সম্পন্ন কী না তা বিচার করতে পারেন। সুতরাং, নৈতিক বিচারের কর্তার ভূমিকায় নিরপেক্ষ দর্শকের কথাই ভাবা যেতে পারে। এরূপ অভিমতের প্রবক্তা হলেন, প্রখ্যাত ইংরেজ অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith)।
[4] নৈতিক বিচারের কর্তার ভূমিকায় ‘আদর্শগত আমি’
অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জি তাঁর ‘A Manual of Ethics’ গ্রন্থে আদর্শগত আমি (Ideal self)-কেই নৈতিক বিচারের কর্তারূপে উল্লেখ করেছেন। ম্যাকেঞ্জি মানুষের মধ্যে দুটি সত্ত্বার উল্লেখ করেছেন- (i) আদর্শগত আমি (Ideal Self) এবং (ii) নিম্নস্তরের বাস্তব আমি (Actual Self)। উচ্চতর আমিরূপে উল্লেখ করা হয় আদর্শগত আমি-কে আর বাস্তব আমি-কে উল্লেখ করা হয় নিম্নস্তরের আমি- রূপে। বাস্তব তথা নিম্ন স্তরের আমি হল সমস্ত প্রকার কামনা-বাসনাজাত ক্রিয়ার হোতা।
কিন্তু, উচ্চতর আমি তথা আদর্শগত আমিই হল সমস্ত প্রকার নৈতিক কর্মের নিয়ন্ত্রক। এই আদর্শগত আমিই আমাদের সমস্ত প্রকার নৈতিক বিচার করতে পারে। অর্থাৎ, আমাদের কর্মগুলি উচিত কী উচিত নয়, ভালো কী ভালো নয়-ইত্যাদির মাপকাঠিতে বিচার করতে পারে। আদর্শগত আমি তাই আমাদের কর্মসমূহের বিচারকরূপে গণ্য। বিচারবিশ্লেষণের মাধ্যমেই এরূপ আমি কর্মের নৈতিক বিচার করতে পারে। সেই কারণেই বলা যায় যে, এই আদর্শগত আমি-ই নৈতিক বিচারের কর্তার রামকৃষ্ণদেব পাকা আমিরূপে উল্লেখ করেছেন।
আরও জানতে – www.wbhsnote.in
2 thoughts on “নৈতিক বিচারের প্রকৃত কর্তা কে তা আলোচনা করো”