সার্ধশতবর্ষে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রবন্ধ রচনা – আজকের পর্বে সার্ধশতবর্ষে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রবন্ধ রচনা আলোচনা করা হল।
সার্ধশতবর্ষে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রবন্ধ রচনা
সার্ধশতবর্ষে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
ভূমিকা
বিদেশী শাসকের করালগ্রাসে ভারতের শিক্ষা- সংস্কৃতি নিমজ্জমান, বিশেষ করে বাংলায় তখন চলছে ঘোর দুর্দিন, বাঙালিরা দিগ্ভ্রান্ত। কালই কালের অভাব পূরণ করে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, দেশাত্মবোধ- সমস্ত ক্ষেত্রে সেই সময় ভারতের ভাগ্যাকাশে আবির্ভাব ঘটেছে একের পর এক নক্ষত্রের, তাঁরা সন্ধান দিয়েছেন নতুন পথের, এগিয়ে যাওয়ার আলোক বর্তিকা নিয়ে। পরপর একই শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০ খ্রিঃ) মাইকেল মধূসূদন দত্ত (১৮২৪), সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮ খ্রিঃ), বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮ খ্রিঃ), বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ খ্রিঃ) , স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩ খ্রিঃ), জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯ খ্রিঃ), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ (১৮৭০ খ্রিঃ), ঋষি অরবিন্দ বসু প্রভৃতি মনীষীবৃন্দ। তাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছিলেন এক একজন উজ্জ্বল প্রদীপ। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
বিশিষ্ট চিকিৎসক গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে জুন জন্মগ্রহণ করেন হুগলির জিরাটে। তাঁর মায়ের নাম জগত্তারিণী দেবী। পরে আশুতোষের পিতা কলকাতার ভবানী পুরে বসবাস করতে থাকেন।
শিক্ষা
আশুতোষের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ভবনীপুরের চক্রবেড়িয়ার পাঠশালায়। তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্র এবং অসাধারণ তার স্মৃতিশক্তি। যেকোন বিষয় একবার শুনে মনে রাখতে পারতেন এবং কঠিন অঙ্ক অতি সহজে সমাধান করা তাঁর কাছে সাধারণ ব্যাপার ছিল। পড়াশোনায় তাঁর ছিল খুব অধ্যবসায়। তিনি মাত্র এগারো বছর বয়সে বিদ্যাসাগরের সান্নিধ্য লাভ করেন। বিদ্যাসাগরের অনুপ্রেরণা ছিল তাঁর জীবনের এগিয়ে চলার বিশেষ পাথেয়।
তিনি মাত্র পনেরো বছর বয়সে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে এন্টান্স পরীক্ষায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় স্থান লাভ করেন ও স্কলারশিপ পান। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রেসীডেন্সী কলেজে ভর্তি হন এবং বি.এ পরীক্ষায় তিনটি বিষয়ে প্রথম স্থান এবং অঙ্কশাস্ত্রে এম.এ প্রথম বিভাগে প্রথম হন। পরে পদার্থবিদ্যায় ও মাষ্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন এবং প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলারশিপ পান। আইন পরীক্ষায় ও ডিগ্রি লাভ করেন। চবিবশ বছর বয়সে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভ্য বা ফেলো নির্বাচিত হন।
কর্মজীবন
তিনি ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ গ্রহণ করেন এবং ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একই পদ অলঙ্কৃত করেন। ইংরেজ সরকার শিক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চ পদের দ্বায়িত্ব দিতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, সেসময় একই পদে ব্রিটিশদের বেশী মর্যাদা দেওয়া হত বলে। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর জীবনেও একই ঘটনা ঘটেছিল। তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন এবং শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার পরাজয় স্বীকার করে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর মাকে খুব ভক্তি করতেন এবং অনুমতি না পাওয়ার জন্য তিনি বিলেত যাওয়ার পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। তিনি হাইকোর্টে আইন প্রাকটিস শুরু করলে অল্পদিনের মধ্যে খ্যাতি অর্জন করেন এবং পরে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন।
শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা
শিক্ষাব্রতী হিসাবে তাঁর অবদান চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। উচ্চশিক্ষা বিস্তারে তিনি যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ে পরিণত করে। তাঁর ছিল প্রখর বুদ্ধি, সাহস ও দূরদর্শিতা। তিনি চালু করলেন স্নাতক স্তরে রসায়ণ বিদ্যা, প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস, সাহিত্য, ব্যবহারিক মনস্তত্ববিদ্যা, নৃতত্ববিদ্যা প্রভৃতি।
জাতি ধর্ম বর্ণের প্রভেদ তুলে দিয়ে সমস্তশ্রেণির ছাত্র- ছাত্রীর পড়াশোনার সুযোগ করে দিলেন। সংস্কৃত, হিন্দি, পার্সি প্রভৃতি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়াশোনার ও গবেষণার ব্যবস্থা শুরু করলেন। দক্ষিণ কলকাতায় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি যে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তা এখন আশুতোষ কলেজ নামে খ্যাত। তিনি ঔপনিবেশিক শিক্ষায় পরিবর্তনের সূত্রপাত করে শিক্ষার ক্ষেত্রে নবদিগন্তের সূচনা করেন। আশুতোষের ছিল গভীর স্বদেশপ্রেম, আত্মমর্যাদা বোধ ও অন্যায়ের কাছে তিনি কখনও মাথানত করেননি। তেজস্বীকতার জন্য জনগণ তাঁকে ‘বাংলার বাঘ’ নামে সম্মানে ভূষিত করেন। তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। বই ছিল তাঁর খুব প্রিয়। তাঁর গ্রন্থাগারে বই-এর সংখ্যা পঁয়তাল্লিশ হাজার।
উপসংহার
তাঁর বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় আশুতোষ মুখার্জী মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট। এই সংগ্রহশালায় আছে বহু মূল্যবান নথি, আলোকচিত্র, তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র প্রভৃতি। এই মহান ব্যক্তির প্রয়ান ঘটে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি অমর হয়ে আছেন কর্মের মাধ্যমে।