স্বামী বিবেকানন্দ প্রবন্ধ রচনা 600+ শব্দে

স্বামী বিবেকানন্দ প্রবন্ধ রচনা

স্বামী বিবেকানন্দ প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা

কে পরাধীনতার নীরন্ধ্র অন্ধকারে নিমগ্ন জাতির হৃদয়কে বজ্র-গর্ভ অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন? কে এই জড়তাগ্রস্ত, তন্দ্রাচ্ছন্ন, পারামাণুকরণমত্ত জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন প্রকৃত ভারত-সন্ধানে? কে এই মৃত্যু-দুর্বল, অন্ধ-তামসিকতায় নিমগ্ন, চিন্তায় দেউলিয়া, বিরাট মহাদেশকে আলোকিত চিন্তার মৃত্যুঞ্জয়ী বানী শুনিয়ে তাকে যৌবধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন?-তিনি মহাসন্ন্যাসী বীরেশ্বর স্বামী বিবেকানন্দ।

আবির্ভাব

উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হতে থাকে। শিক্ষিত মানুষের মধ্যে বিদেশী শাসকদের সম্বন্ধে ধারণার পরিবর্তন হতে লাগল। এরূপ পরিস্থিতিতে খুবই প্রয়োজন অনুভূত হতে লাগল একজন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের। পৃথিবীতে কোন কিছুই অপুরণ থাকে না। সময়ই কালের অভাব পূরণ করে। এই অলিখিত সত্য যুগ যুগ ধরে প্রমাণিত হয়েছে। সমস্ত ভারতবাসীর মনে বৈষম্যের মধ্যে সমন্বয়ের মন্ত্র বিলাতে যেন ঈশ্বর প্রেরিত দূত হিসাবে আবিভূর্ত হলেন স্বামী বিবেকানন্দ ১২ই জানুয়ারি ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সিমুলিয়া পাড়ায় বিখ্যাত দত্ত পরিবারে। তিনি যেন নবযুগের জিয়ন কাঠি, যাঁর স্পর্শে মোহমুগ্ধ, আত্মবিস্মৃত জাতির অনড় দেহে সঞ্চারিত হল অভূতপূর্ব প্রাণের স্পন্দন। তবে স্বামী বিবেকানন্দের আগমনের বার্তা যেন পূর্বনির্ধারিত ছিল। দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিনীর মন্দিরকে ঘিরে তাঁর আর্বিভাবের পথ প্রশস্ত করেন রানি রাসমনি ও শ্রীরামকৃষ্ণ।

বংশপরিচয়-শিক্ষা-ভারতসাধনা

বিশ্বনাথ দত্ত ও ভুবনেশ্বরী দেবীর দুরন্ত সন্তান নরেন্দ্রনাথ, তাঁকে আদর করে ‘বিলে’ নামে ডাকতেন মা-বাবা পাড়া-প্রতিবেশী। মেট্রোপলিটন স্কুলের পড়া শেষ করে মেধাবী ছাত্র হিসাবে জেনারেল এসেমব্লিজ থেকে স্নাতক হয়ে নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের জ্যোতির্ময় স্পর্শে পরিণত হলেন স্বামী বিবেকানন্দে। সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ, পরিব্রাজকরূপে সমগ্র ভারত-ভ্রমণ, অজ্ঞ-দরিদ্র-আত্মজ্ঞানহীন, জাতপাতের সংকীর্ণতায় বহুধা-বিচ্ছিন্ন ভারতবাসীকে ‘অভী’: মন্ত্রে দীক্ষা-দান তাঁর ভারত-সাধনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চিকাগো ধর্ম-সভায় তাঁর অবিস্মরণীয় ভাষণও বিশ্ব-হৃদয় বিজয়, সে এক নজিরবিহীন ঘটনা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘আমিই ভারতবর্ষ’। তিনি ধ্যানের গভীরে উপলব্ধি করেছিলেন বিশ্বাত্মার জাগরণের মহান ভূমি হবে ভারতবর্ষ।

বেদান্তের আলোকে নতুন পথের সন্ধান

তিনি প্রচার করলেন বেদান্তের সাম্যের বাণী। তিনি বললেন, ভারতের বেদান্তে আছে ‘ব্রহ্মময় জগৎ’। সুতরাং জগৎ যখন ব্রহ্মময়, সকল জীবও ব্রহ্মময়। মানুষ সৃষ্ট ভেদা-ভেদ ও বৈষম্য, শ্রেনীভেদ মিথ্যা, একমাত্র সত্য মানুষে মানুষে সাম্য। তিনি ধিক্কার জানালেন জাতিভেদে দীর্ণ, মূঢ় রক্ষণশীলতায় শীর্ন ভারতবর্ষকে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা হিন্দুও নয়, বৈদান্তিকও নয়, আমরা সব ছুৎমার্গগামীর দল। আমাদের মন্দির হচ্ছে রান্নাঘর, আমাদের দেবতা ভাতের হাঁড়ি, আর ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা-এই হচ্ছে বেদমন্ত্র’। তিনি প্রচার করলেন জাতপাত বৈষম্যহীন, বর্ণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সাম্যের বাণী।

তিনি সূচিত করলেন এমন এক ভারতবর্ষকে যেখানে ব্রাহ্মণ শূদ্রে অবনমিত হবে না, শূদ্র বাহ্মনে উন্নীত হবে। সেখানে থাকবে না অশিক্ষা, দারিদ্র্য, কুসংস্কার বা কোনোরূপ সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতা। তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন, ভারতের কোটি কোটি নর-নারী শুষ্ক কন্ঠে কেবল দুটি অন্ন চাইছে। তারা চাইছে, আর আমরা তাদেরকে প্রস্তর খন্ড দিচ্ছি। ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মকথা শোনানো বা দর্শন-শাস্ত্র শেখানো তাকে অপমান করা। তিনি মনে করতেন, খালিপেটে ধর্ম হয় না। তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি আদর্শ সমাজ যেখানে থাকবে না শোষণ, নিপীড়ন, ক্ষুধার্তের আর্তনাদ। তাঁর কল্পনায় আদর্শ রাষ্ট্র হল, ‘যাতে ব্রহ্মণ্য যুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ-শক্তি এবং শুদ্রের সাম্যের আদর্শ মিলিত হবে’।

রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা

১৮৯৩ সালে স্বামী বিবেকানন্দ চিকাগো বিশ্বধর্ম-মহসেম্মেলনে বক্তৃতা প্রদানের পর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং মানব-জাতিকে সংগঠিত করার মহান ব্রত নিয়ে এক আদর্শ সংঘ ১৮৯৭ সালে গঠন করলেন যা রামকৃষ্ণ মিশন নামে পরিচিত। ১৮৯৯ সালে গঙ্গার পশ্চিম তীরে প্রতিষ্ঠিত হয় মঠ। তিনি ১৯০০ সালে প্যারিসে বিশ্ব-ধর্ম সম্মেলনে যোগদান করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে তাঁর স্বাস্থ্য দ্রুত ভগ্ন হয়।

মহাপ্রয়াণ

স্বাস্থ্য ভগ্ন হওয়া সত্ত্বেও তিনি ক্ষান্ত হলেন না। কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্যের আরও ক্ষতি হল। ১৯০২ সালের ৮ঠা জুলাই যুগ পথিক বিবেকানন্দের মাত্র ঊনচল্লিশ বছর বয়সে মহাসমাধিস্থ অবস্থায় এই মহাজীবনের মহাপ্রয়ান ঘটে। নতুন ভারত গড়ার স্বপ্ন: স্বামী বিবেকানন্দের আর্বিভাব সূচিত করল সংস্কার জর্জরিত ভারতে নতুন ভোরের সূর্যোদয়। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন জাতিভেদই ভারতের অগ্রগতির প্রধান প্রতিবন্ধক। তার সাথে যুক্ত হয়েছে নানা অবাঞ্ছিত সংস্কার। ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে, পরাধীন ভারতমাকে শৃঙ্খল-মুক্ত করতে হলে মানুষের মধ্যে চাই সাম্য-সৌভ্রাতৃত্ব যা ভারতকে পরিণত করবে শক্তিশালী জাতিতে। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান করলেন, ‘বল, মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, চন্ডাল ভারতবাসী আমার রক্ত, আমার ভাই…..।’ তিনি ছিলেন মানবতার মূর্ত প্রতীক। তিনি জিবকে শিবজ্ঞানে সম্মান করতেন। তিনি তাইতো বলেছেন

‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’

উপসংহার

স্বামী বিবেকানন্দ ভারতাত্মার মূর্ত প্রতীক। সমাজও স্বদেশকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন মানবতার পূণ্য পীঠস্থানে। তিনি ভারতকে কর্মের মাধ্যমে যে অগ্রসরের ও পথের সন্ধান দিয়েছেন তা বিস্মৃত জাতিকে জাগার এক অমৃত বাণী। তাই আজ খুবই প্রয়োজন যুগ-পথিক স্বামী বিবেকানন্দের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করা।

আরও পড়ুন – রাজা রামমোহন রায় প্রবন্ধ রচনা

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment