স্বামী বিবেকানন্দের রাজনৈতিক সংস্কার সমূহ আলোচনা করো

স্বামী বিবেকানন্দের রাজনৈতিক সংস্কার সমূহ আলোচনা করো

অথবা, রাজনৈতিক সংস্কার সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাভাবনা গুলি আলোচান করো

অথবা, স্বামী বিবেকানন্দ কি প্রত্যক্ষ রাজনীতি করতেন? তার রাজনৈতিক সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করো

স্বামী বিবেকানন্দের রাজনৈতিক সংস্কার সমূহ আলোচনা করো
স্বামী বিবেকানন্দের রাজনৈতিক সংস্কার সমূহ আলোচনা করো

বিবেকানন্দ এর রাজনৈতিক সংস্কার সমূহ

সমাজসংস্কারের পাশাপাশি বিবেকানন্দের রাজনৈতিক সংস্কার ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বামীজি কখনো রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেননি। তবে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও এটা বিশ্বাস করতেন যে, ভারতবর্ষকে কালিমালিপ্ত করেছে পাশ্চাত্য রাজনৈতিক শক্তি।

স্বামীজির রাজনৈতিক সংস্কারের প্রধান দিকগুলি হল-

[1] জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার: বিবেকানন্দ ব্রিটিশদের অপশাসনকে কখনোই মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। জাতীয়তাবাদকে গুরুত্ব দিলেও, তিনি ছিলেন বিশ্বমানবতা তথা বিশ্বজনীনতার পূজারি। জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি জাতীয় ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারেও ডাক দিয়েছিলেন তিনি। বিবেকানন্দ মনে করতেন, জাতি হিসেবে ভারতীয়দের যে সুমহান গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে, তাকে জানতে হবে। জাতির এই অতীত গৌরবময় -ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটলে ভারতীয়রা জাতীয় চেতনায় উদ্‌বুদ্ধ হবে।

[2] জাতীয় পুনরুজ্জীবন: বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন যে, ভারতবর্ষের জাতীয় পুনরুজ্জীবনের জন্য আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটানো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ভারতের জাতীয় জীবনের প্রধান নির্ধারক হল ধর্ম। তাঁর কাছে ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতার অর্থ ছিল ভারতের শাশ্বত আদর্শকে অনুধাবন ও অনুসরণ করা।

[3] জনজাগরণের বানী: পরাধীন ভারতের জনজাগরণের জন্য বিবেকানন্দ যেসব অগ্নিদীপ্তবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, তা জনমানসে এক ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তৎকালীন সমাজে যুবকদের উদ্দীপ্ত করতে তিনি ঘোষণা করেন ‘ওঠো, জাগো এবং যতক্ষণ না লক্ষ্যে পৌছাঁতে পারছো থেমো না।’ এছাড়া তিনি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ও নারীজাতির উন্নতির লক্ষ্যে বাণী প্রচার করেছিলেন।

[4] আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন: স্বামীজি স্বপ্ন দেখতেন এক আদর্শ রাষ্ট্রের। এই আদর্শ রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণযুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ শক্তি ও শূদ্রের সমতার আদর্শ সবগুলিই সঠিকভাবে বজায় থাকবে। স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ রাষ্ট্রের ভাবনা তার আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিশ্বাসের গভীরে নিহিত ছিল। তিনি এমন একটি সমাজের কল্পনা করেছিলেন যা আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সমাজের অগ্রগতি ঘটায়। *2

[5] রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব: বিবেকানন্দ কখনোই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের সমর্থক ছিলেন না। কিন্তু তিনি নৈতিকতা ও ন্যায়নীতির আধারে রাজনীতিকে পরিচালনা করায় বিশ্বাসী ছিলেন, যা হবে ধর্মনিরপেক্ষ। তিনি ধর্মকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক রূপান্তর অর্জনের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখেছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে করুণা, নিঃস্বার্থতা এবং সেবার আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলিকে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ও নীতির সঙ্গে সংযুক্ত করা উচিত।

[6] আপামর জনগণের সার্বিক উন্নয়ন: দেশের দরিদ্র্য, নিপীড়িত আপামর জনসাধারণের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। তিনি দীন-দুঃখী ভারতবাসীর ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর কাছে হতাশাগ্রস্ত, দুর্দশাময়, হতদরিদ্র দেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ছিল অলীক স্বপ্ন। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশবাসীর সার্বিক উন্নয়ন ব্যতিরেকে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা কখনোই সম্ভব নয়। বিবেকানন্দ দৃঢ় এবং বলিষ্ঠ কণ্ঠে সমাজের দরিদ্র্য ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের ক্ষমতায়নের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিলেন।

[7] আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ: বিবেকানন্দের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তার আধ্যাত্মিক মানবতাবাদের ধারণার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকলাপের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে আধ্যাত্মিক, ঐশ্বরিক উপলব্ধির সম্ভাবনাকে জাগ্রত করা। তিনি এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন যা মানুষের মর্যাদা এবং স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দেয়। বিবেকানন্দ সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের ধারণার উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন ধর্ম বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও বোঝাপড়াকে উৎসাহিত করবে, যা সামাজিক ভেদাভেদকে দূর করতে সাহায্য করবে।

[8] আরাধ্য দেবতা ভারতমাতা: বঙ্কিমচন্দ্রের মতো বিবেকানন্দ ভারতবর্ষকে দেশমাতৃকারূপে কল্পনা করার কথা বলেছিলেন। স্বামীজি ভারতের আরাধ্য দেবতা ভারতমাতাকে সবার উপরে তুলে ধরেছিলেন। তিনি মনে করতেন, আমাদের দেশকে যদি আমরা নিজের মাতৃরূপে ভক্তি ও সেবা করি তাহলে ভারতীয়দের মধ্যে দেশপ্রেম, অধ্যাত্মিক শ্রদ্ধা ও ঐক্যবোধ গড়ে উঠবে, যার ফলে এই দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারবে।

পরিশেষে বলা যায়, যদিও স্বামীজি প্রচলিত অর্থে রাজনৈতিক সংস্কারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না, কিন্তু তার ধ্যান-ধারণা, আধ্যাত্মিক জাগরনের মাধ্যমে জাতীয় পুনরুজ্জীবন এবং শিক্ষা ভারতে রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment