স্বামী বিবেকানন্দের রাজনৈতিক সংস্কার আলোচনা করো
স্বামী বিবেকানন্দের রাজনৈতিক সংস্কার
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও ভারতের জনজাগরণে, স্বামীজির রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা এবং রাজনৈতিক সংস্কারের গুরুত্ব অনেকখানি। এমনকি বর্তমান ভারত ও আগামীর ভারতকে দিশা দেখানোর জন্যও তা সমান প্রাসঙ্গিক। স্বামীজির রাজনৈতিক সংস্কারের প্রধান দিকগুলি হল-
[1] জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার: বিবেকানন্দ ব্রিটিশ ভারতের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ না নিলেও স্বাধীনতার একজন সমর্থক ছিলেন। ব্রিটিশদের অপশাসনকে তিনি কখনোই মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর রচিত ‘জ্ঞানযোগ’, ‘রাজযোগ’, ‘বর্তমান ভারত’ ‘পরিব্রাজক’ প্রভৃতি গ্রন্থ এবং পত্রাবলি ভারতীয় বিপ্লবীদের জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রেরণার একমাত্র উৎস ছিল। স্বামীজি পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য বেদান্তের নতুন ব্যাখ্যা দেন। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের মাধ্যমে ভারতবাসীকে জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে তিনি বিশেষ উদ্যোগী হন।
জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি জাতীয় ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের ডাক দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। তিনি মনে করতেন জাতি হিসেবে ভারতীয়দের যে সুমহান গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে তাকে জানতে হবে। জাতির এই অতীত গৌরব- গাথার সঙ্গে পরিচয় ঘটলে ভারতীয়রা জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে। ভারতবাসী হিসেবে এই গর্ববোধ সবাইকে একতাবদ্ধ হতে সাহায্য করবে।
[2] জনজাগরণের বাণী প্রচার: বিবেকানন্দ ভারতের জনজাগরণের জন্য যেসব অগ্নিদীপ্ত বাণী পরাধীন ভারতে নির্ভীক কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন তা জনমানসে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তখনও সে অর্থে কোনো ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন সংঘঠিত হয়নি, তখনও দেখা যায়নি কোনো জনজাগরণ। এমন পরিস্থিতিতে স্বামীজি যুবকদের উদ্দীপ্ত করতে ঘোষণা করেন, “ওঠো, জাগো, যতক্ষণ না লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছ থেমো না” (Arise, awake and stop not till the goal is reached.)।
ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতে, স্বামীজির এই অগ্নিগর্ভ বাণী শোনার পরেই জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল (‘All the mili- tant nationalist movement … were launched after Swami- gis-thundering roar, arise, awake’)। (Patriot Prophet, by Dr. Bhupendranath Dutta, PP. 212-13)
[3] দেশমাতৃকারূপে ভারতমাতার বন্দনা: বন্দেমাতরমের উদ্দ্গাতা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের মতো বিবেকানন্দও ভারতবর্ষকে দেশমাতৃকারূপে কল্পনা করার কথা বলেছিলেন। স্বামীজি ভারতের আরাধ্য দেবতা ভারতমাতাকে সবার উপরে তুলে ধরেছিলেন। তিনি মনে করতেন, আমাদের দেশকে যদি আমরা নিজের মাতৃরূপে ভক্তি ও সেবা করি তাহলে এই দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারবে। স্বামীজি ব্যর্থহীন ভাষায় দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, “আগামী পঞ্চাশ বৎসর আমাদের গরীয়সী ভারতমাতাই আমাদের আরাধ্য দেবতা হউন, অন্যান্য অকেজো দেবতাকে এই কয়েক বৎসর ভুলিলে কোন ক্ষতি নাই।”
[4] রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা ও সংগঠিত সমাজকল্যাণ: বিবেকানন্দের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের একটি গৌরবোজ্জ্বল দিক হল পরাধীন ভারতে সংগঠিত সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্যে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা। স্বামীজি 1900 খ্রিস্টাব্দের 21 ফেব্রুয়ারি এক চিঠিতে মিশনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে গিয়ে জানাচ্ছেন, “আমাদের কাজ হচ্ছে অনাথ, দরিদ্র, মূর্খ, চাষাভুসোর জন্য, আগে তাদের জন্য করে যদি সময় থাকে তো ভদ্রলোকের জন্য।” (পত্রাবলী/পৃ. 696)
[5] আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন ও আপামর জনগণের সার্বিক উন্নয়ন: স্বামীজি স্বপ্ন দেখতেন এক আদর্শ রাষ্ট্রের। এই আদর্শ রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণযুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ শক্তি ও শূদ্রের সমতার আদর্শ সবগুলিই ঠিকঠাক বজায় থাকবে অথচ এদের দোষগুলি থাকবে না।
মন্তব্য: স্বামীজি এটা বুঝেছিলেন যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের মূল কাজ হল আপামর জনগণের সার্বিক উন্নয়ন। যতদিন তা না করা যাচ্ছে ততদিন দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হতে পারে না।
আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর