স্বাধীনতা বলতে কী বোঝ? স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো

স্বাধীনতা বলতে কী বোঝ? স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো

স্বাধীনতা বলতে কী বোঝ? স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো
স্বাধীনতা বলতে কী বোঝ? স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো

স্বাধীনতা

অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, স্বাধীনতা বলতে এমন এক পরিবেশের সযত্নে সংরক্ষণকে বোঝায় যে পরিবেশে মানুষ তার ব্যক্তিসত্তাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারে। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে এই পরিবেশকে সংরক্ষণ করে। সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনে স্বাধীনতা বলতে কখনও অবাধ বা অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতাকে বোঝায় না। রাষ্ট্র মানুষের অবাধ স্বাধীনতাকে আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে সমাজকল্যাণের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলে।

স্বাধীনতার রক্ষাকবচ

আইন হল স্বাধীনতার প্রথম রক্ষাকবচ। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার সংরক্ষণে বিভিন্ন রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা হয়। এই রক্ষাকবচগুলি হল-

[1] মৌলিক অধিকার: সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারগুলিকে স্বাধীনতার প্রধান রক্ষাকবচ বলে গণ্য করা হয়। সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ থাকলে জনগণ সেগুলি সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায়। সরকার যদি জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে তাহলে জনগণ সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে।

[2] ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ: মঁতেস্কু, ম্যাডিসন, ব্ল‍্যাকস্টোন প্রমুখ ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণকে স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে, সরকারের সমস্ত ক্ষমতা একই ব্যক্তি বা বিভাগের হাতে ন্যস্ত হলে স্বৈরাচারের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এর ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। সেজন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ প্রয়োজন। ক্ষমতা- স্বতন্ত্রীকরণের ফলে সরকারের কোনো বিভাগই ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারে না, ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে।

[3] আইনের অনুশাসন: অধ্যাপক ডাইসি আইনের অনুশাসন বা ‘Rule of law’-কে স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ডাইসির মতে, আইনের অনুশাসন বলতে-(i) সাধারণ আইনের সর্বাত্মক প্রাধান্য, (ii) আইনের চোখে সমতার নীতি অনুসরণ, (iii) সাধারণ আইন দ্বারা নাগরিক অধিকারগুলির সংক্ষরণকে বোঝায়। ফলে সরকারের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে না, ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে। তা ছাড়া, সবার জন্য একই আইনের অস্তিত্ব থাকায় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত কেউই বাড়তি সুবিধা ভোগ করতে পারে না।

[4] দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা: দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা হল স্বাধীনতার আর-একটি রক্ষাকবচ। দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থায় সরকার আইনসভায় জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। তা ছাড়া, আইনসভার ভিতরে ও বাইরে বিরোধীপক্ষের সমালোচনার ভয়ে সরকার জনগণের স্বাধীনতার পরিপন্থী কোনো কাজ করতে সাহস পায় না। কারণ সুসংবদ্ধ বিরোধী দল জনমতকে সজাগ রাখতে সাহায্য করে।

[5] প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি: গণভোট, গণ-উদ্যোগ, পদচ্যুতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ বলে গণ্য করা হয়। সরকার নাগরিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে জনগণ প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এমনকি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করাও সম্ভব হয়। অবশ্য বৃহদায়তন জনবহুল দেশগুলিতে এইসব পদ্ধতি অনুসরণ করা অসম্ভব। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, সুইটজারল্যান্ডের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলি বর্তমানে আংশিকভাবে চালু রয়েছে।

[ 6] ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ: ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে স্বীকৃত। বলা হয় যে, প্রশাসনিক ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়লে শাসনবিভাগের স্বৈরাচারী হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়, যার ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, যে রাষ্ট্রে কেন্দ্রের হাতে অতিমাত্রায় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে না।

[7] সদাজাগ্রত জনমত: স্বাধীনতার সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হিসেবে সদাজাগ্রত জনমতের কথা উল্লেখ করা হয়। স্বাধীনতার জন্য নাগরিকদের অদম্য আকাঙ্ক্ষা এবং সবরকম ত্যাগ স্বীকারের ইচ্ছা ছাড়া স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। স্বাধীনতার ওপর যে-কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নাগরিকদের সর্বদা সচেতন থাকা প্রয়োজন। গ্রিক দার্শনিক পেরিক্লিস বলেছিলেন যে, চিরন্তন সতর্কতা হল স্বাধীনতার মূল্য এবং সাহসিকতা হল স্বাধীনতার মূলমন্ত্র।

[৪] স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা: স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারবিভাগের অস্তিত্ব ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। বিচারবিভাগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তার ভূমিকা পালন করতে পারলে নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত করা সম্ভব হয়। নিরপেক্ষ বিচারবিভাগ ন্যায়বিচারকে সুনিশ্চিত করে। এর ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে।

মন্তব্য: পরিশেষে বলা যায়, স্বাধীনতা কখনও খণ্ডিতভাবে উপলব্ধি করা যায় না। সমাজের কোনো অংশের স্বাধীনতা অস্বীকার করে প্রকৃত স্বাধীনতার পরিবেশ গড়ে তোলা যায় না। তাই নিছক আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির মাধ্যমে স্বাধীনতা সংরক্ষণ সম্ভব নয়। এজন্য জনগণকে সদা সচেষ্ট থাকতে হবে।

আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment