স্বাধীনতার সংজ্ঞা ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো
স্বাধীনতার সংজ্ঞা
স্বাধীনতা বা ‘Liberty’ শব্দটি লাতিন শব্দ ‘Liber’ থেকে গৃহীত হয়েছে। ‘Liber’ শব্দের অর্থ হল স্বাধীনতা। সাধারণভাবে স্বাধীনতা বলতে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করার অবাধ অধিকারকে বোঝায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কিন্তু স্বাধীনতা শব্দটি এই অর্থে ব্যবহৃত হয় না। বস্তুত অবাধ, অনিয়ন্ত্রিত ও সীমাহীন স্বাধীনতা হল স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তরমাত্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বাধীনতা সম্পর্কিত সংজ্ঞা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ল্যাস্কি প্রদত্ত সংজ্ঞা: স্বাধীনতা হল এমন এক পরিবেশের সংরক্ষণ যেখানে মানুষের অন্তর্নিহিত ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব।
বার্কার প্রদত্ত সংজ্ঞা: রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা বা আইনসংগত স্বাধীনতা হল সকলের জন্য শর্তসাপেক্ষ স্বাধীনতা।
মার্কসবাদী প্রদত্ত সংজ্ঞা: মানুষের যোগ্যতা ও সামর্থ্যের সর্বাঙ্গীণ বিকাশকে স্বাধীনতা বলে অভিহিত করা যায়।
স্বাধীনতার প্রকৃতি
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় স্বাধীনতার প্রকৃতিকে তিনটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। সেগুলি হল-[1] নেতিবাচক স্বাধীনতা, [2] ইতিবাচক স্বাধীনতা এবং [3] মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বাধীনতা।
[1] নেতিবাচক স্বাধীনতা: স্বাধীনতার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নেতিবাচক ও ইতিবাচক-এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। নেতিবাচক স্বাধীনতার প্রবক্তা হলেন জেরেমি বেন্থাম, অ্যাডাম স্মিথ, জন স্টুয়ার্ট মিল্, হারবার্ট স্পেনসার, হক্স, লক প্রমুখ। এ ছাড়া রয়েছেন বারলিন, হায়েক ও নোজিকের মতো একালের নয়া উদারনীতিবাদী তাত্ত্বিকরা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী উদারনৈতিক রাষ্ট্রদর্শনের প্রবক্তারা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে ন্যূনতম রাখার পক্ষে রায় দেন। তাঁদের মতে, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পেলে ব্যক্তির স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা দেখা যায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য কোনো বাইরের নির্দেশ বা হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, ব্যক্তি তার নিজের ওপরে, তার শরীর ও মনের ওপরে সার্বভৌম (“Over himself, over his own body and mind every individual is sovereign”)। এইভাবে নেতিবাচক অর্থে স্বাধীনতার প্রকৃতির বিশ্লেষণ করা হয়।
[2] ইতিবাচক স্বাধীনতা: স্বাধীনতার ইতিবাচক প্রকৃতিকে যাঁরা বিশ্লেষণ করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হেগেল, গ্রিন, হবহাউস, ল্যাস্কি, বার্কার প্রমুখ। ইতিবাচক স্বাধীনতার প্রবক্তারা ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বার্থে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তাঁদের মতে, ব্যক্তি যে স্বাধীনতা ভোগ করে তা একমাত্র রাষ্ট্রের সহায়তার মাধ্যমে সম্ভব। স্বাধীনতা ভোগ করার জন্য যে উপযুক্ত পরিবেশ দরকার তা একমাত্র রাষ্ট্রই গড়ে তুলতে পারে। হেগেলের মতে, রাষ্ট্র ছাড়া স্বাধীনতা কল্পনা করা যায় না। রাষ্ট্রের প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্য প্রদর্শন করে ব্যক্তি তার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। ফরাসি দার্শনিক রুশোর বক্তব্য হল, সমস্ত মানুষের প্রকৃত ইচ্ছা (Real will)-কে নিয়ে গঠিত ‘সাধারণ ইচ্ছা’ (General will)-র অনুগামী হলেই ব্যক্তি তার স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ পেতে পারে। এইভাবে রাষ্ট্রীয় সহায়তায় ব্যক্তি যে স্বাধীনতা ভোগ করে তাকে ইতিবাচক স্বাধীনতা বলে অভিহিত করা হয়।
[3] মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বাধীনতা: মার্কসীয় মতবাদে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বাধীনতার প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। স্বাধীনতার নেতিবাচক, অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণার বিরোধিতা করে মার্কসীয় মতবাদে বলা হয়, সমস্ত রকম আর্থিক শোষণের অবসান না ঘটলে মানুষের সামাজিক মুক্তি ঘটা সম্ভব নয়। একমাত্র পুঁজিবাদী শোষণব্যবস্থার অবসান ঘটলেই প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
মন্তব্য: স্বাধীনতার সংজ্ঞা ও প্রকৃতিকে কখনোই সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে সীমিত রাখা যায় না। তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, স্বাধীনতার ধারণা মানুষকে বহুযুগ ধরে অনুপ্রাণিত করেছে।
আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর