স্বাধীনতার ধারণার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ পর্যালোচনা করো
স্বাধীনতার ধারণার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
স্বাধীনতা বলতে নিজের অধীনতাকে বোঝায়। অর্থাৎ, নিজের ইচ্ছামতো কাজকরার সুযোগসুবিধা। কিন্তু এর অর্থ হল স্বেচ্ছাচারিতা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বাধীনতা এই অর্থে ব্যবহৃত হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বাধীনতা হল রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত সুযোগসুবিধার সমষ্টি যা ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের সহায়ক। স্বাধীনতার ধারণার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশকে এইভাবে বর্ণনা -করা যায়-
এথেন্সে স্বাধীনতা: স্বাধীনতার ধারণার প্রথম উদ্ভব ঘটে প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স নগরীতে। এথেন্সে দুই ধরনের স্বাধীনতা ছিল-সম্প্রদায়গত স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। সম্প্রদায়গত স্বাধীনতা বলতে সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণবিহীনতাকে বোঝাতো। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে স্বশাসন ও দৈনন্দিন অভাব অভিযোগ থেকে মুক্তিকে বোঝাত।
স্টোয়িক ও রোমানদের ধারণা: খ্রিস্টপূর্ব 300 অব্দে জেনো কর্তৃক প্রচারিত দার্শনিক মতবাদ স্টোয়িকবাদ হিসেবে পরিচিত। স্টোয়িকদের মতে, ব্যক্তিজীবনের পূর্ণতা মানব নিয়ন্ত্রণমুক্ত পরিবেশের মধ্যেই হতে পারে। স্টোয়িক দার্শনিকগণ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের পরিবর্তে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই স্বাধীনতার ধারণাটিকে পর্যালোচনা করার পক্ষপাতী। তবে রোমান চিন্তায় স্বাধীনতা থেকে আইন, সার্বভৌমিকতা, শৃঙ্খলা প্রভৃতি বিষয় অধিক গুরুত্ব পেয়েছে।
মধ্যযুগে স্বাধীনতা: মধ্যযুগে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের কারণে মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতাকে বিসর্জন দেওয়া হয়। মধ্যযুগে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণা তেমন গুরুত্ব পায়নি। তবে ধর্মসংস্কার আন্দোলন ও নবজাগরণের মাধ্যমে বিবেকের স্বাধীনতা গুরুত্ব পায়।
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে স্বাধীনতা: সপ্তদশ শতকে ম্যুর সাম্যবাদের আদর্শ প্রচার করেন। কবি মিলটনের মতে, স্বাধীনতা হল ব্যক্তি ও জাতির জন্মগত অধিকার। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের চুক্তিবাদী দার্শনিক-হক্স, লক ও রুশোর মতবাদেও স্বাধীনতার ধারণা বিকশিত হয়। হক্সের মতে, আইন দ্বারা নিষিদ্ধ নয় এমন সকল ক্ষেত্রেই মানুষ স্বাধীন। লক স্বাধীনতার অধিকারকে স্বাভাবিক অধিকার বলেছেন। রুশোর মতে, প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষ ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ফরাসি বিপ্লবের মূল মন্ত্রই ছিল স্বাধীনতা।
সার্বভৌমিকতা ও স্বাধীনতা: রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণা বিকশিত হওয়ার ফলে স্বাধীনতার ধারণার সাথে সার্বভৌমিকতার বিরোধ বাধে। সার্বভৌমিকতা বলতে রাষ্ট্রের চরম, চূড়ান্ত ও অপ্রতিহত ক্ষমতাকে বোঝায়। অন্যদিকে, স্বাধীনতা হল নিয়ন্ত্রণহীনতা। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বাধীনতার ধারণা পরিবর্তিত হতে থাকে। মিলের মতে, ব্যক্তির আত্মকেন্দ্রিক কাজে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ অকাম্য। বার্কার বলেছেন, কোনো ব্যক্তিই অবাধভাবে স্বাধীন হতে পরেন না।
আদর্শবাদীদের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা: আদর্শবাদীরা স্বাধীনতাকে অন্য দৃষ্টি থেকে বিচার করেছেন। তাঁদের মতে, ব্যক্তির আত্মোপলব্ধির সুযোগ- সুবিধাই হল স্বাধীনতা। হেগেলের মতে, রাষ্ট্র ব্যতিরেকে স্বাধীনতা বাস্তবে পরিণত হয় না। গ্রিনের মতে, জীবন ও মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদনের ক্ষমতাই হল স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা সম্পর্কে আধুনিক ধারণা: স্বাধীনতা সম্পর্কে অধ্যাপক ল্যাস্কি এমন এক পরিবেশকে বুঝিয়েছেন যেখানে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করতে পারে। ব্যক্তিত্ব বিকাশের এই সুযোগ- সুবিধাগুলিকেই অধিকার বলে। আধুনিক ধারণা অনুসারে অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণের দ্বারা ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের ব্যবস্থা করাই রাষ্ট্রের কর্তব্য।
মার্কসীয় দৃষ্টিতে স্বাধীনতা: মার্কসীয় ধারণা অনুসারে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা একে অপরের সাথে অঙ্গাগীভাবে যুক্ত। মার্কসীয় স্বাধীনতার ধারণা একটি সামগ্রিকতত্ত্ব। মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী স্বাধীনতা কখনও সমাজ নিরপেক্ষ হতে পারে না। শ্রেণিভিত্তিক সমাজে স্বাধীনতা অসম্ভব। এই ধারণা অনুসারে একমাত্র শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজেই প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতার উপলব্ধি সম্ভব।
মন্তব্য: স্বাধীনতার ধারণা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। একটা সময় স্বাধীনতা বলতে সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রণহীনতাকে বোঝাত। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় আইনের সাথে স্বাধীনতার সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা হয়। স্বাধীনতা ছাড়া নাগরিক জীবনের কল্পনাই করা যায় না। তবে ব্যক্তিস্বাধীনতা কীভাবে নাগরিকদের কাছে অর্থবহ হয়ে ওঠে সে সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিকগণ একমত হতে পারেননি।
আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর