স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির লক্ষণ কী? ব্যাখ্যা করো
স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির লক্ষণ
যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুন যুদ্ধ পরিত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করলে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তিকে অনুসরণ করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে উপদেশ দেন। তখন শ্রীকৃয় স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন-
"দুঃখেম্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেযু বিগতস্পৃহঃ। বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীমুনিরুচ্যতে।।” (২/৫৬)
এর অর্থ হল, যিনি সর্বপ্রকার দুঃখে উদ্বেগহীন, কোনোপ্রকার সুখে যার স্পৃহা নেই, যিনি সর্বতোভাবে আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করেছেন, সেইরকম ব্যক্তিই স্থিতপ্রজ্ঞ বলে অভিহিত হন।
শ্রীকৃষ্ণের এই উপদেশবাণীতে স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির লক্ষণগুলি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে-
সমত্বভাব
স্থিতধী ব্যক্তি কখনও কর্মের সফলতায় বা বিফলতায় আনন্দিত বা বিষাদগ্রস্থ হন না। তার মনে একই ভাব বর্তমান থাকে। একে বলে সমত্বভাব। সকাম ব্যক্তির মনে দুঃখ উপস্থিত হলে বা দুঃখের আশঙ্কায় এক ধরনের উদ্বেগ হয় যে, সে কীভাবে আগত এই দুঃখকে দূর করবে বা অনাগত দুঃখকে প্রতিরোধ করবে। কিন্তু স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির এইরূপ কোনো উদ্বেগ হয় না। তিনি শুধু দুঃখে নিরুদ্বিগ্ন থাকেন তাই নয়, সুখেও তার কোনো স্পৃহা থাকে না। যদি সুখকর কোনো বিষয় উপস্থিত হয় তা ভোগ করার অথবা কোনো প্রত্যাশিত সুখকর বস্তু লাভ করার জন্য তার কোনো আকাঙ্ক্ষা জন্মায় না। সুখ ও দুঃখে তিনি সমভাবাপন্ন থাকেন।
বীতরাগবিশিষ্ট
স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি হন বীতরাগবিশিষ্ট। ‘রাগ’ কথাটির সাধারণ অর্থ হল অনুরাগ বা আকর্ষণ। সুখে ও দুঃখে অনুদ্বিগ্ন থাকায় কোনো বিষয়ই তাঁর মনে অনুরাগ বা আকর্ষণ নামক চিত্তবৃত্তি উৎপন্ন করতে পারে না। কোনো বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ বা আসক্তি না থাকায় স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির মনে রাগ উৎপন্ন হয় না।
মোহমুক্তভাব
স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি প্রিয় বা শুভ বস্তু লাভ করে যেমন সন্তোষ প্রকাশ করেন না, তেমনি অপ্রিয় বা অশুভ বস্তু লাভ করলেও কোনো অসন্তোষ প্রকাশ করেন না, তিনি সবকিছুকে মোহমুক্ত মনে সমভাবে গ্রহণ করেন।
সংসারের মায়াত্যাগ
স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি নিজেকে পরমসত্তা বা ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করে, আমিত্ব বা অহংবোধকে সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দিয়ে স্পৃহাহীন (বিগতস্পৃহ), মমত্বহীন ও অহংকারহীন হয়ে সংসারে বিচরণ করেন।
স্পৃহাহীন: স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তিকে সংসারে শান্তিলাভ করতে হলে সকল কামনা-বাসনা বর্জন করে সমস্ত ভোগ্য পদার্থে স্পৃহাশূন্য হতে হবে। কাম্য পদার্থ পাওয়ার জন্য যে তীব্র ইচ্ছা জন্মায় তাকে বলা হয় স্পৃহা। ‘আমার এই পদার্থটি প্রিয়’, ‘এটা আমাকে পেতে হবে’-এইরূপ বাসনাকে ত্যাগ করতে হবে।
মমত্বহীন: স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি হবে মমতাশূন্য। মমতা মানুষের মনে নানাভাবে, নানা আকারে প্রকাশ পায়। আমার স্ত্রী, আমার পুত্র, আমার বাড়ি এই প্রকারে মমত্ববুদ্ধি জন্মায়। এই যে মমত্ববুদ্ধি অর্থাৎ ‘আমার আমার বোধ’ এগুলি ত্যাগ করতে হবে।
অহংকারহীন: স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির অহংকারও বর্জনীয়। অনেক ব্যক্তি আমি ধনী, আমি বিদ্বান, আমি কত উচ্চপদে আসীন-এইরূপ বলে গর্ব অনুভব করেন। সেইরূপ ব্যক্তি মূর্খ ও দাম্ভিক হয়। কেউ কেউ মনে মনে গর্ব অনুভব করেন যে তিনি বড়ো, তিনি বিদ্বান-এই প্রকারে যে অনুভূতি তাই অহংকারের স্থূলরূপ। আবার আমি কর্তা, আমিই কর্ম করছি-এই প্রকারের অনুভূতি অহংকারের সূক্ষ্মরূপ। এই আমিত্ববোধকে বর্জন করতে হবে। সুতরাং সংসারে বিচরণ করেও স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি যোগস্থ হয়ে পরম শান্তিতে বিরাজ করেন।
আসক্তিরহিত
স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি যাবতীয় বিষয়ে আসক্তিরহিত থাকেন। কোনো বিষয়ের শুভ-অশুভ ফললাভে তিনি আনন্দিত বা দুঃখিত হন না। অর্থাৎ শুভাশুভ ফললাভে তিনি সমভাবাপন্ন থাকেন। তিনি নিজের সম্পর্কে যেমন অনভিস্নেহ থাকেন, তেমনি প্রিয়জন সম্পর্কেও অনভিস্নেহ থাকেন।
ব্রাহ্মিস্থিতি লাভ
সমস্ত কামনা-বাসনা বর্জন করে, কাম্যবস্তুতে স্পৃহা ত্যাগ করে, মমত্ব বুদ্ধি ও অহংকারশূন্য হয়ে পরমাত্মাতে নিবিষ্ট চিত্ত হওয়াকে ব্রাহ্মীস্থিতি বলে। ‘ব্রাহ্মীস্থিতি’ কথার অর্থ হল চিত্তে ব্রহ্মের স্থিতি বা অবস্থান। যে ব্যক্তি নিজের ক্ষুদ্র আমিত্বকে বিসর্জন দিয়ে বিরাট ব্রহ্মসত্তায় বিরাজমান, যে ব্যক্তি জীবনে কখনও মোহের অধীন হন না, একমাত্র সেই স্থিতপ্রজ্ঞ যোগী পুরুষই ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ করতে পারেন।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ