সুর সম্রাট মান্না দে প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা
হেমন্তের রাত্রি শেষের আলো আঁধারি ছায়ার জলসাঘরে ঝাড়বাতির পতন ঘটল, সুর সম্রাট মান্না দে চিরকালের জন্য চলে গেলেন চুরানববই বছর বয়সে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ২৪ অক্টোবর রাত তিনটে পঞ্চাশ মিনিটে বেঙ্গালুরুর হাসপাতালে। তাঁর বিদায় আকস্মিক নয় বা অকাল প্রয়াণ নয়। সুরের মায়াজালে আবিষ্ট করেছিলেন সমগ্র সংগীত জগৎকে। ভারসেটাইল সুরের আমেজে তিনি চিরন্তন হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে।
জন্ম, বংশপরিচয় ও শিক্ষাজীবন
আসল নাম প্রবোধ চন্দ্র দে। তাঁর জন্ম ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১ মে উত্তর কলকাতায়। তাঁর মায়ের নাম মহামায়া, পিতার নাম পূর্ণচন্দ্র দে। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ইন্দুবাবুর পাঠশালায়। এরপরে স্কটিশ চার্চ স্কুল ও কলেজে এবং বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বি.এ.। তাঁর বাবা ছিলেন চার্টার্ড অ্যাকাউটেন্ট। তাঁর ইচ্ছা ছিল প্রবোধ চন্দ্র লেখাপড়া শিখে নিজেকে যাতে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। পিতার ইচ্ছেকেই শিরোধার্য করে ল কলেজে ভর্তি হতে মনস্থ করলেন। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন তাঁর প্রবাদপ্রতিম গায়ক কাকা, তিনি কি বাবার ইচ্ছা পূরণ করে ব্যারিষ্টার হতে পারেন?
উত্তর কলকাতার সিমলে পাড়ার ডানপিটে ছেলে। ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ি। আবার খুব দূরে নয়, হেদোর কাছে বিখ্যাত বাঙালি ‘গোবর গোহ’র কুস্তির আখড়া। সে সময় ‘গোবর গোহ’র বিরাট প্রভাব ছিল। প্রভাবিত হয়ে ডানপিটে ছেলেটি কুস্তিগীর হতেও চেয়েছিলেন। কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র প্রভাবেই বাবার ইচ্ছেকে ছাপিয়ে প্রবোধচন্দ্র দে হয়ে উঠলেন গায়ক। গুরু কৃষ্ণচন্দ্র। ‘মান্না’ নামটিও কাকার দেওয়া। ছোটোবেলা থেকে তাঁর সংগীতের প্রতি ছিল মোহ।
কর্মজীবন
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে মান্না দে কাকার হাত ধরেই মুম্বাইতে গেলেন এবং শচীন দেব বর্মনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি গানের তালিম নিলেন ওস্তাদ আমান আখি খান ও ওস্তাদ আব্দুল রহমান খানের কাছে। তাঁর সংগীত জীবন শুরু হয় প্রথমে অ্যাসিটেন্ট মিউজিক ডাইরেকটর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র এবং পরে শচীন দেব বর্মনের নিকট। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ‘তামান্না’ ছবিতে প্রথম তিনি প্লে ব্যাক করেন। তারপর চলতে থাকল সুরেলা সংগীত নায়কের অপ্রতিরোধ্য বিচরণ সংগীত জগতে।
গুরু কৃষ্ণচন্দ্র দে, যে গুরুর জন্য বলা যায়, ‘গুরুকে বিনা জীবন সুনা….’। বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করে এবং ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে কী সংগীত ভেসে আসে’, ‘অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রুবাদল ঝরে’ এবং স্বপন যদি মধুর হয় এমন, হোক সে মিছে কল্পনার মতো বহু অসাধারণ গান গেয়ে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র জীবিতকালেই হয়ে উঠলেন তিনি কিংবদন্তি। ভাইপো মান্না দে যে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠবেন, তাতে আর বিস্ময়ের কী বা আছে? তৎকালীন বিখ্যাত সুরকার অনিল বিশ্বাস বলেছিলেন, “মহম্মদ রফি, তালাত মামুদ, কিশোরকুমার বা মুকেশ যত ভালোই গাক না কেন, কেউ মান্নার মতো গাইতে পারে না।’ অনিল বিশ্বাস যে কতটা সত্যি কথা বলেছিলেন তার প্রমাণ মান্না দে-র কন্ঠে বহু গান অবিস্মরণীয় হয়েছে।
গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় মান্না দে-র জন্য অসাধারণ গান রচনা করেন।’….জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই, পাছে ভালোবেসে ফেল তাই’, ‘দরদী গো কী যে পেলাম, সাধের প্রদীপ জ্বালতে গিয়ে’, বা ‘রাত জাগা দুটি চোখ যেন কবিতা, লিখেছিল যাবার বেলায়’, অভিমানে চলে যেও না, এখনই শেষের গান গেও না’, আমার না যদি থাকে সুর, তোমার আছে তুমি তা দেবে’ কিংবা ‘আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো’- গানগুলি খুবই জনপ্রিয় হয়।
প্রতিটি গানকে সহজাত দরদ ও রাগের সূক্ষ্ম মোচড়ে অসাধারণ করে তুলতেন তিনি, তিনি গান শিখেছিলেন হৃদয় দিয়ে, সিমলে পাড়ার মদন ঘোষ লেনের বিশাল বাড়ি ঘিরে ছিল কৃষ্ণচন্দ্রের গানের মায়াজাল। ‘তমান্না’ ছবির সুরকার কৃষ্ণচন্দ্র এগারো বছর বয়সের ভাইপোকে সুরাইয়ার সঙ্গে গাওয়ালেন মান্না দেকে। তিনি তালিম নিলেন বাউল, রবীন্দ্রসংগীত, খেয়াল, টপ্পা, ঠুংরি, ভজন, কাওয়ালি প্রভৃতি গানের। তাই গানের সমস্ত ক্ষেত্রেই তাঁর অবাধ বিচরণ।
তিনি শুধু গায়ক ছিলেন না, ছিলেন সুরকারও। তাঁর সুরে হৈমন্তী শুক্লা গাইলেন ‘আমার বলার কিছু ছিল না, চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে গেলে’, বা ‘কেন নয়নে আবির ছড়ালে’ প্রভৃতি গান আজও মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। দুবিঘা জমিতে (১৯৫৩) সলিল চৌধুরীর দুটো গান মান্না দের গলায় গাওয়া তাঁকে প্রথম জীবনে সাফল্যের শেখরে পৌঁছে দেয়। তিনি সলিল চৌধুরীর গানের সাথে যুক্ত থেকেছেন ১৯৫৩ থেকে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
তিনি প্রথম ডুয়েট বা যুগ্ম গলায় গান করেন লতা মঙ্গেশকরের সাথে। অজস্র হিন্দী ফিল্ম, এমন কি বিভিন্ন ভাষায় গান গেয়ে তিনি দখল করেন গায়কের শীর্ষ স্থান। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি ৭৫৮টি হিন্দি গান রেকর্ড করেন। বাংলা গান রেকর্ডের সংখ্যা প্রায় ১২৬২। তিনি ভোজপুরীতে ৩৫টি, পাঞ্জাবি ১৩টি, আসামী ২টি, ওড়িয়া ৭টি, গুজরাটি ৮৫টি, মারাঠি ৫৫টি, কানাড়া ৫টি, মালয়ালম ২টি, নেপালি ১টি ফিল্মে প্লে ব্যাক করেন। তিনি ২০১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার গান রেকর্ড করেন।
সম্মান
নিজের গানের সাথে প্রশংসা করতেন অন্যদের গানও। তাঁর প্রিয় ছিল সোনু নিগমের গান। কবিতা কৃষ্ণমূর্তির মতো অনেক খ্যাতিমান সংগীত শিল্পী তাঁর কাছে গান শিখে গানের জলসা ঘরে খ্যাতি লাভ করেছেন। তাঁর গানের গলার এমন যাদু ছিল যে তাঁকে সংগীত জীবনের ষাট বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে তিন ঘন্টা গান করার পরও বলতে হয়েছে, “আপনাদের বাড়ি ফিরতে হবে না?” ভারত সরকার তাঁকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পদ্মশ্রী, ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে পদ্মভূষণ ও ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে সম্মানিত করে।
উপসংহার
সুর সম্রাট মান্না দে পরলোক গমন করেছেন ঠিকই, তিনি যে অমর, চির ভাস্বর। শিল্পীর মৃত্যু নেই, মরতে পারেন না, তিনি আছেন তাঁর গানের মধ্যে বেঁচে মানুষের অন্তরে।
আরও পড়ুন – মিড-ডে মিলের প্রয়োজনীয়তা প্রবন্ধ রচনা