সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক স্বাধীনতা সম্পর্কে বর্ণনা করো
অথবা, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভারতীয় রাজনীতিতে অবদান উল্লেখ করো
রাজনৈতিক স্বাধীনতা
শৈশবকাল থেকেই তিনি স্বদেশী আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং জাতীয়তাবাদী দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, যা তাঁর মধ্যে একটু একটু করে বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল এবং ভারতের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। ভারতের রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা উল্লেখ্য-
- অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান: ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের আহবানে সুভাষচন্দ্র যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময় তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের কাছ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। তিনি ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে গান্ধি- ডারউইন চুক্তির বিরোধিতা করেন, কারণ গান্ধিজির আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহারকে তিনি মানতে পারেননি।
- করাচিতে অধিবেশন: ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে করাচিতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় নওজোয়ান কংগ্রেস’- এর অধিবেশনে সভাপতিত্বকালীন সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবরকম দাসত্ব-সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে এবং আমাদের সর্বতোভাবে এবং পূর্ণভাবে স্বাধীন হতে হবে।’
- কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে নির্বাচন: আন্দোলনের পদ্ধতিগত দিক নিয়ে মতান্তর হওয়া সত্ত্বেও গান্ধিজি উপলব্ধি করেছিলেন সুভাষচন্দ্র একজন প্রকৃতই জনপ্রিয় তরুণ দেশপ্রেমিক। তাই তিনি নিজেই ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে হরিপুরা কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্রের নাম প্রস্তাব করেছিলেন এবং ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে সুভাষচন্দ্র জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে ত্রিপুরী কংগ্রেসে অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু তার প্রতিদ্বন্দ্বী পট্টভি সিতারামাইয়াকে হারিয়ে জয়ী হন। তবে এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে অবিচল থাকার কারণে কংগ্রেসের উচ্চনেতৃত্বের সঙ্গে নেতাজির যে বিরোধ দেখা দেয়, তার জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়।
- ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন: ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতীয় কংগ্রেসের ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে একটি উপদল গঠন করেন। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য আপোসহীন সংগ্রাম করা এবং কংগ্রেসের আমূল সংস্কার করা।
- দেশ ত্যাগ বা মহানিষ্ক্রমণের পর : ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে শক্তিশালী এবং তীব্র করতে বিদেশি সাহায্যের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি গভীর রাতে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতভূমি ত্যাগ করে কাবুল থেকে রাশিয়া হয়ে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে পৌঁছান। যেখানে তিনি বন্দি প্রায় ৪০০ ভারতীয় সেনাদের নিয়ে ‘ফ্রি ইন্ডিয়ান লিজিয়ান’ নামে একটি সেনাদল গঠন করেন। এখানে সুভাষচন্দ্র ‘নেতাজি’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। তারপর তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোর সাহায্য কামনা করলে তোজো ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধে সবরকম সাহায্যের জন্য প্রতিশ্রুতি দেন। ইতিমধ্যে জাপান অধিকৃত সিঙ্গাপুরে প্রবাসী বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ও ক্যাপ্টেন মোহন সিং জাপানের হাতে বন্দি ভারতীয় সৈনিকদের নিয়ে একটি সেনাবাহিনী গঠন করেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসেই সুভাষচন্দ্র বসু এই বাহিনীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং তার নাম দেন আজাদ হিন্দ ফৌজ।
তিনি গেরিলা বাহিনী তৈরি করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি নারী সমাজকেও স্বাধীনতা আন্দোলনে এগিয়ে আসতে আহবান করেছিলেন। ফলে বহু মহিলারা সশস্ত্র সংগ্রামে সাহসিকতার সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন।
পরিশেষে বলা যায়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক স্বাধীনতার ধারণাটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়-
- সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্বাধীনতার ধারণাটি ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার ধারণার মধ্যে নিহিত ছিল। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি আক্রমণাত্মক ও সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপে বিশ্বাস করতেন।
- জাতীয় ঐক্যসাধন: নেতাজি জাতীয় ঐক্য গঠনের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় ও আঞ্চলিক বিভেদ অতিক্রম করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের (INA) সৈন্যদের মধ্যে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও মধ্যে সমন্বয় গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে ভারতকে মুক্ত করতে তিনি যে পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে দিয়েই নেতাজির রাজনৈতিক স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণাটির সন্ধান পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর