সুফিবাদের জন্ম বা উৎপত্তি কীভাবে হয়
অথবা, সুফিবাদের উত্থান সম্পর্কে লেখো
ইসলাম ধর্মের গোড়াপত্তন থেকেই এক শ্রেণির মুসলিম অতীন্দ্রিয়বাদী মানুষ ছিলেন, যাঁরা পরবর্তীতে তাসাউফ বা সুফি নামে খ্যাত হন। ঐতিহাসিক ইউসুফ হুসেনের লেখায়, ‘ইসলামের বক্ষদেশ থেকেই সুফিবাদের জন্ম’ (born in the bosom of Islam)। অধ্যাপক ফিলিপ হিট্টি উল্লেখ করেছেন, ‘ইসলামের অতীন্দ্রিয়বাদী রূপ হল সুফিবাদ।’
সুফিবাদের জন্ম বা উৎপত্তি
(1) ইসলামে গোঁড়া চিন্তাধারার আধিপত্য: খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী নাগাদ খলিফার আধিপত্য খর্ব করে তুর্কিদের ক্ষমতায়ন ঘটলে ইসলামীয় মতবাদের জগতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। মুতাজিলা বা যুক্তিবাদী দর্শনের পরিবর্তে গোঁড়া চিন্তাধারার আধিপত্য স্থাপিত হয়। এই গোঁড়া চিন্তাধারা মূলত ছিল কোরান শরিফ ও হাদিসের ব্যাখ্যাকেন্দ্রিক। এসবের ফলশ্রুতিতেই অতীন্দ্রিয় সুফিবাদের জন্ম হয়।
(2) ইসলামীয় আইনের চারটি মতবাদ: আসলে মুতাজিলা বা যুক্তিবাদী দর্শনের পতনের পর ঐতিহ্যপন্থীদের ক্ষমতার যে বৃদ্ধি ঘটেছিল, তার পরিণামে ইসলাম ধর্মকে কেন্দ্র করে এই ঐতিহ্যবাদীরা চারটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়। এই চারটি সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম হানাফি সম্প্রদায় ছিল তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে উদার। তুর্কিরা ছিলেন এই উদার হানাফি সম্প্রদায়েরই অন্তর্ভুক্ত। এরপর যখন তুর্কিরা ভারতে আসেন, তখন তাদের সঙ্গে হানাফি মতবাদও এদেশে প্রবেশ করে সুফি অতীন্দ্রিয়বাদীদের অগ্রসর হওয়ার পথ প্রশস্ত করে দেয়।
(3) ছুফি দর্শনের উদ্ভব: নবম শতক পর্যন্ত সুফিবাদ ছিল একটি অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক চেতনা। দশম শতকে সুফিসাধক হুসেন-বিন-মুনসুল-এর সময়ে সুফিদর্শন তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। কালক্রমে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে খিলাফত-এর বিশ্বব্যাপী প্রসার ঘটলে প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম ধর্মচর্চায় শৈথিল্য দেখা দেয়। বহু মুসলমান কোরানের মর্মবাণী ও পয়গম্বরের জীবনাদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে স্থূল আড়ম্বর ও নৈতিক অবনতির শিকার হন। এই বিচ্যুতি থেকে ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করার জন্য অতীন্দ্রিয়বাদী সাধকরা সুফিবাদের তত্ত্ব প্রচার করতে উদ্যোগী হন।
(4) আল-গজালির ভূমিকা: আরবের দার্শনিক আল-গজালি (১০৫৭- ১১১১/১১১২ খ্রিস্টাব্দ) ইসলাম ধর্মের গোঁড়া মতবাদ এবং সুফিবাদ উভয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি এই দুই মতাদর্শের মধ্যে সমন্বয়সাধন করার কাজে খানিকটা সফল হয়েছিলেন। আল-গজালি যুক্তিবাদকে নস্যাৎ করে প্রমাণ করেন যে, ঈশ্বরের মহিমা যুক্তিতর্ক দ্বারা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কোরান হল ঈশ্বরের বাণী, কাজেই রহস্যবাদীদের কাছে এই গ্রন্থ অপরিহার্য। অতীন্দ্রিয়বাদকে তিনি ইসলামসম্মত বলে প্রমাণ করেছিলেন। এই ব্যাখ্যার ফলে ইসলামের অন্যতম শাখারূপে সুফিবাদের অগ্রগতির পথ মসৃণ হয়ে উঠেছিল। সুতরাং সুফিবাদের উৎপত্তির ইতিহাসটা ছিল এইরকম। ইউসুফ হুসেন লিখেছেন, ‘সুফিবাদ ইসলাম ধর্মের একটা অংশ, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তফাৎ এই যে, গোঁড়া মুসলমানরা ধর্মাচরণের উপর জোর দেন, কিন্তু সুফিরা গুরুত্ব দেন অন্তরের শুদ্ধতাকে।’
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর