সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক আলোচনা করো
সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক
সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকে মনে করেন, সাম্য না থাকলে প্রকৃত ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। যে সমাজে অসাম্য আছে সেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বাস্তবায়িত করা প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব। সাম্যের পরিবেশ ছাড়া ন্যায় গড়ে উঠতে পারে না। অন্যদিকে, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা না গেলে অসাম্যের পরিবেশ তৈরি হয়। যে সমাজে ন্যায়বিচারের কোনো সুযোগ নেই, সেখানে সাম্য বিরাজ করতে পারে না। সাম্য প্রতিষ্ঠার একটি অন্যতম শর্ত হল ন্যায়বিচার। ন্যায়নীতিতে এ কথা বলা হয় যে, সব মানুষ সমান। কেউ কারও থেকে ছোটো বা বড়ো নয়।
[1] সাম্যের নীতি ও ন্যায়: সাম্যের নীতি যে সবক্ষেত্রে ন্যায়কে নিশ্চিত করে, তা নয়। তাই সাম্যের নীতি সবসময় ন্যায়ের চূড়ান্ত নীতি বলে গ্রাহ্য হয় না। যেমন, যে দেশে ধনী মানুষদের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক গরিব মানুষ কোনোরকমে জীবনযাপন করে, যেখানে সাম্য নীতির ভিত্তিতে সবার জন্য সমান সুযোগসুবিধা, সবার জন্য সমান অধিকার সমাজে ন্যায়ের বিধান করতে পারে না। এই কারণে সমাজের পিছিয়ে পড়া দুর্বল গরিব মানুষজনের জন্য কিছু বিশেষ সুযোগসুবিধা ও অধিকারের সংরক্ষণ করা হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে ভারতীয় সংবিধানে সংরক্ষিত তপশিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির বিশেষ সংবিধানিক ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা যায়।
[2] সাম্য ও ন্যায়নীতির পরিবর্তন: সমাজ ও সমাজের মূল্যবোধের পরিবর্তনের সঙ্গে সাম্য ও ন্যায়নীতির পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে সাম্য ও ন্যায়ের ধারণা বদলে যায়। যেমন, প্রাচীন গ্রিসে প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের যুগে ক্রীতদাস প্রথা ছিল ন্যায়সংগত। সেই যুগের মূল্যবোধ অনুসারে সমাজে একদল সহায়সম্বলহীন মানুষকে অভিজাত ধনী পরিবারের বাড়িতে ক্রীতদাস করে রেখে দেওয়ার বিষয়টিকে অন্যায় বলে ভাবা হত না। ক্রীতদাসরা সমস্ত রকম সুযোগসুবিধা ও অধিকার ভোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এতে যে সাম্য নীতি লঙ্ঘিত হচ্ছে তাও মনে করা হত না। পরে সমাজ ও যুগের পরিবর্তনের ফলে এই ধারণার বদল হয়। তখন থেকে ক্রীতদাস প্রথা সাম্য ও ন্যায়নীতি লঙ্ঘনকারী অমানবিক আচরণ হিসেবে গণ্য হতে থাকে। আধুনিক সভ্য সমাজে এটি একটি জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধ।
[3] ব্যক্তিজীবনে সাম্য ও ন্যায়: ব্যক্তিজীবনে সাম্য ও ন্যায়ের তাৎপর্য ভিন্নধরনের। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কি তাঁর এ ‘গ্রামার অব্ পলিটিক্স’ (A Grammar of Politics) গ্রন্থে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, সাম্য বলতে সব বিষয়ে সমতা বা অভিন্নতাকে বোঝায় না। ব্যক্তিজীবনে যোগ্যতা, গুণাবলি ও সামর্থ্যের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে পার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক। প্রকৃতিগতভাবে সব মানুষ সমান যোগ্যতার অধিকারী হয় না। তাই এক্ষেত্রে যদি জোর করে সাম্যনীতির প্রয়োগ করা হয়, তা ন্যায়নীতিকে লঙ্ঘন করে ফেলে। যেমন একজন রাজমিস্ত্রি কখনোই সমাজের কাছে একজন ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারের সমান মর্যাদা দাবি করতে পারে না। ল্যাস্কির মতে, রাষ্ট্র যদি উভয়কে সমান মর্যাদা ও সমান স্বীকৃতি দেয়, তাহলে যেমন প্রতিভার বিকাশ ঘটবে না, তেমনি সমাজের অগ্রগতিও বিঘ্নিত হবে। কাজেই যোগ্যতা, দক্ষতা ও ক্ষমতার দিক থেকে মানুষের পার্থক্যের কথা মনে না রাখলে ন্যায়নীতিকে সুনিশ্চিত করা যাবে না।
[4] পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক সমাজে সাম্য ও ন্যায়: পুঁজিবাদী সমাজে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে সমাজে যে অসাম্য সৃষ্টি হয়, তাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া হয়। এর ফলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান অনেক বেড়ে যায়। পুঁজিবাদী সমাজের এই আর্থিক অসাম্যের অবস্থাকে অন্যায় বলে ভাবা হয় না। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের আর্থিক বৈষম্য ন্যায়কে বিঘ্নিত করে বলে মনে করা হয়।
মন্তব্য: উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে একথা বলা যায় যে, সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক সময় ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হয়। যদিও ন্যায় প্রতিষ্ঠাই সাম্য নীতির মূল লক্ষ্য। তাই সাম্য ও ন্যায় পরস্পরবিরোধী ধারণা নয়, উভয়ের মধ্যে একধরনের পরিপূরক সম্পর্ক বর্তমান।
আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর