সাম্প্রতিক কালে কাব্যসাহিত্যের ধারাটি আলোচনা করো

সাম্প্রতিক কালে কাব্যসাহিত্যের ধারাটি আলোচনা করো

সাম্প্রতিক কালে কাব্যসাহিত্যের ধারাটি আলোচনা করো
সাম্প্রতিক কালে কাব্যসাহিত্যের ধারাটি আলোচনা করো

কাব্যসাহিত্যের ধারা: প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় গীতিকাব্যের দেবমহিমা উনিশ শতকীয় নবজাগরণের স্পর্শে যখন মানুষের দুঃখ-সুখের অনুভূতি নিয়ে বহুবিধ শাখায় ছড়িয়ে পড়ছিল, বাংলা কাব্যসাহিত্যের সেই বাঁক বদলের ইতিহাস লিখলেন মধুসূদন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহী নজরুলেরা। বিশ শতকে এসে সেই কাব্যসাহিত্যের বিনির্মাণ ঘটল পুঁজিবাদ বিরোধিতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, সমাজতাত্ত্বিক চিন্তার মধ্য দিয়ে। কবিতার মুখ্য বিষয় হয়ে উঠল যন্ত্রসভ্যতাক্লিষ্ট নাগরিক মনোভাব। প্রেম, সৌন্দর্যবোধের বদলে এল ক্লান্তি আর হতাশা।

বিশ্বযুদ্ধ, রাজনৈতিক আলোড়ন, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, অখণ্ড ভারতবর্ষের খণ্ড স্বাধীনতালাভ, দেশভাগ, বেকারত্ব, প্রাত্যহিক জীবনচর্যাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিল। এই সমাজপটই জন্ম দিল ‘একালের কবি’-দের। ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’, ‘প্রগতি’ প্রভৃতি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে বাংলা কবিতার আঙিনায় ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে আবির্ভূত হলেন অজিত দত্ত, বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, মণীন্দ্র রায়রা।

পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত সুদীর্ঘ ‘অস্থির সময়’-কে যেসব কবি তাঁদের কাব্যে চিত্রিত করেছেন তাঁরা হলেন ‘কাস্তের কবি’ দিনেশ দাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ।

এই পূর্বসূরিদের হাত ধরেই বাংলা কাব্যসাহিত্যে এলেন পূর্ণেন্দু পত্রী, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার প্রমুখ কবিরা। শঙ্খ ঘোষের ‘এখন সময় নয়’, ‘বাবরের প্রার্থনা’; শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?’; সুনীল গাঙ্গুলীর ‘বন্দি জেগে আছো’: বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো, চাকা’ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া, এ যুগের অন্যতম কাব্যশিল্পী হলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, ‘উলঙ্গ রাজা’-র কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

কবিতায় আত্মলিপি খোদিত হল ভাস্কর চক্রবর্তীর কাব্যে। তাঁর ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’-য় চিত্রিত হল নাগরিক জীবনযন্ত্রণা।

সাম্প্রতিকতম কবিদের মধ্যে সত্তর পরবর্তী কাল থেকে জয় গোস্বামী, মৃদুল দাশগুপ্ত, সুবোধ সরকার, শুভ দাশগুপ্ত, জয়দেব বসু বা ব্রত চক্রবর্তী, শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়রা বহুলচর্চিত। জয় গোস্বামীর ‘পাগলি, তোমার সঙ্গে’, ‘পাতার পোশাক’; মৃদুল দাশগুপ্ত-র ‘সোনার বুদবুদ’; সুবোধ সরকারের ‘দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে’: শ্রীজাত-র ‘উড়ন্ত সব জোকার’ উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।

নারীমুক্তির ইতিহাস কাব্যের জগতে ছাড়পত্র পেয়েছিল বহু প্রাচীন কাল থেকে। সামাজিক বিধিনিষেধ পেরিয়ে তার লেখনী কথা বলেছে বারবার। সাম্প্রতিক কালেও সেই ধারা বহমান। একালের উপকণ্ঠে বিখ্যাত কয়েকজন মহিলা কবি হলেন নবনীতা দেবসেন, যাঁর অন্যতম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম প্রত্যয়’। এ ছাড়া, কবিতা সিংহের ‘সহজ সুন্দরী’, ‘হরিণা বৈরী’; কৃষ্ণা বসুর ‘শব্দের শরীর’; মল্লিকা সেনগুপ্তের ‘আমি সিধুর মেয়ে’; মন্দাক্রান্তা সেনের ‘হৃদয় অবাধ্য মেয়ে’ উল্লেখযোগ্য।

পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০২২ সালে তাঁর ‘কবিতাবিতান’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

আসলে বাংলার জলবায়ু, সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান বাঙালির মনোগঠনকে কবিসুলভ করে তুলেছে। সেই কারণেই বাংলা সাহিত্যের কাব্যপ্রবাহ প্রতিনিয়তই বিবর্তিত এবং বিবর্ধিত হয়ে চলেছে।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার নামকরণের সার্থকতা

Leave a Comment