সত্যাগ্রহের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো
সত্যাগ্রহের বৈশিষ্ট্যসমূহ: মহাত্মার সত্যাগ্রহ তত্ত্ব বিশদে জানতে হলে এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হওয়া দরকার। যা হল—
[1] আত্মিক শক্তির সংগ্রাম: গান্ধিজির মতে, সত্যাগ্রহ হল এক আত্মিক শক্তির সংগ্রাম। যেখানে প্রচলিত অর্থে জয়-পরাজয় বলে কিছু নেই। সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করাই হল এই সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য। সত্যাগ্রহীদের মধ্যে বিদ্বেষমূলক মনোভাবের পরিবর্তে প্রেম-ভালোবাসা, সৌভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমে হৃদয় পরিবর্তনের উপর আলোকপাত করা হয়। যার মধ্য দিয়ে বিপক্ষ শক্তির বিবেক বা শুভ বুদ্ধির উদয় হতে পারে।
[2] নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নয়, সর্বশস্ত্রি দিয়ে অন্যায়কে অস্বীকার: গান্ধিজি তাঁর Satyagraha in South Africa গ্রন্থে বলেছেন কোনো নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নয়, এ হল সর্বশক্তি দিয়ে অন্যায়কে অস্বীকার করার সংগ্রাম। নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ হল দুর্বল, ভীরু ও কাপুরুষের অস্ত্র, এক্ষেত্রে বিপক্ষের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ থাকতে পারে, কিন্তু সত্যাগ্রহে এগুলির কোনো স্থান নেই।
[3] জন্মগত অধিকার: গান্ধিজির মতে, সত্যাগ্রহ হল মানুষের সহজাত জন্মগত অধিকার। এই কারণে গান্ধিজি একে পবিত্র অধিকার ও পবিত্র কর্তব্য বলে অভিহিত করেছেন।
[4] সত্যাগ্রহ ও প্রতিপক্ষ: প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানো বা তার উপরে চরম আঘাত হানা সত্যাগ্রহের কাজ নয়। অহিংসা, প্রেম ও ভালোবাসার সাহায্যে প্রতিপক্ষের হৃদয় জয় করাই হল সত্যাগ্রহের মূল উদ্দেশ্য।
[5] একটি সৃজনশীল পদ্ধতি: গান্ধিজির মতে, আপাতদৃষ্টিতে সত্যাগ্রহী মূল উদ্দেশ্য হল প্রতিপক্ষের মনে শুভবোধ জাগ্রত করে তার হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটানো। এই কারণে সত্যাগ্রহকে একটি সৃজনশীল পদ্ধতি বলে অভিহিত করা হয়। এটি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয় বরং এটি হল ব্যক্তির নীতি, কর্মপদ্ধতি ও কাজের বিরুদ্ধে এক সংগ্রাম।
[6] সত্যাগ্রহ দুর্বলের জন্য নয়: সত্যাগ্রহে দুর্বলতা, ভীরুতা ও কাপুরুষতার কোনো জায়গা নেই। সত্যাগ্রহ মানে সত্যকে জয় না করা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য। এ কাজ দুর্বল চিত্ত মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
[7] সত্যাগ্রহ ও অহিংসা: সত্যাগ্রহের সঙ্গে অহিংসার একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। সত্যাগ্রহী কখনো হিংসাকে প্রশ্রয় দেয় না। প্রতিপক্ষকে সে যেমন ঘৃণা করবে না, তেমনি সে তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধও হারাবে না। এ ছাড়া গান্ধিজি মনে করতেন, অন্যায়ের প্রতিরোধ করার জন্য সত্যাগ্রহী আত্মবিসর্জন দিতেও বিন্দুমাত্র ভয় পাবে না।
[8] সত্যাগ্রহের বিধি: গান্ধিজি তাঁর রচনায় সত্যাগ্রহের বিধি সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ভয় কাকে বলে সত্যাগ্রহী জানে না’। অতএব প্রতিপক্ষকে বিশ্বাস করতে সে কখনোই শঙ্কিত হবে না। প্রতিপক্ষ তাকে যদি কুড়িবারও ঠকায়, তবুও একুশবারের বার সত্যাগ্রহী তাকে বিশ্বাস করার জন্য প্রস্তুত থাকবে। কারণ সত্যাগ্রহের আদর্শের মূল কথা হল মানুষের প্রকৃতিতে নিয়মিত আস্থা রাখা।
[9] সত্যাগ্রহের কলাকৌশল: গান্ধিজির সত্যাগ্রহের উল্লেখযোগ্য কতকগুলি কৌশল হল বিবেকের বিরুদ্ধে কোনো কিছু না করা। প্রলোভনের ফাঁদে পা না দেওয়া। বিজয়ীর আধিপত্যের সামনে মাথা নত না করা। জনগণের কাছে যে ব্যাপারগুলি মৌলিক গুরুত্বের, সেগুলিকে কষ্ট স্বীকারের মধ্য দিয়ে অর্জনের চেষ্টা করা সত্যাগ্রহে উচ্ছৃঙ্খলতার কোনো জায়গা নেই। সত্যাগ্রহের জন্য চরম ত্যাগ স্বীকার করতে এমনকী মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা হিংসাত্মক পদ্ধতিতে নয়। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন যে, ব্রিটিশ সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার সক্ষমতা ভারতের মানুষের মধ্যে নেই। তারা হিংসাত্মক উপায়ে সংগ্রামে লিপ্ত হলে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে পারে।
[10] সত্যাগ্রহের চরিত্র: গান্ধিজি বলেছেন, সত্যাগ্রহের সারমর্ম হল, জাতীয় জীবনে সত্য ও নম্রতার প্রাথমিক প্রয়োগ। নিরন্তর সত্যসন্ধান ও সত্যে উপনীত হওয়ার দৃঢ় নামই সত্যাগ্রহ। এ প্রসঙ্গে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ তার সম্পাদিত ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লিখেছেন, “আমাদের অপরকে বাধ্য করার মনোভাব থাকলে চলবে না, সত্যাগ্রহীর অধীর উচিত নয়-নিজের পদ্ধতির উপর অখন্ড বিশ্বাস ও ধৈর্য্য নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।”
আরও পড়ুন – সরকারের বিভিন্ন রূপ বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর