শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে কান্ট-এর নৈতিক নিয়মের তুলনা করো

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে কান্ট-এর নৈতিক নিয়মের তুলনা করো

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে কান্ট-এর নৈতিক নিয়মের তুলনা করো
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে কান্ট-এর নৈতিক নিয়মের তুলনা করো

গীতার নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে কান্ট এর নৈতিক নিয়মের তুলনা

ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার নিষ্কাম কর্মের আদর্শ এবং পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্রে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট-এর নীতিতত্ত্ব উভয়ই নীতিদর্শনে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার আদর্শ হল নিষ্কাম কর্মের আদর্শ। আর জার্মান দার্শনিক কান্ট নীতিদর্শনে যে নীতিতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন তা ‘বিচারবাদ’ বা ‘কৃষ্ণতাবাদ’ নামে পরিচিত। গীতায় নির্দেশিত নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের নৈতিক মতবাদের মধ্যে এক অদ্ভূত মিল লক্ষ করা যায়।

গীতায় কর্মযোগ ও কান্টের নৈতিক মতবাদের সাদৃশ্য

গীতার কর্মযোগ ও কান্টের নৈতিক মতবাদের সাদৃশ্যগুলি হল নিম্নরূপ-

কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগগত মিল

গীতায় বলা হয়েছে বুদ্ধি, অনুভূতি ও ইচ্ছা যদি আত্মার দ্বারা চালিত হয় তাহলে মানুষ বিপথগামী হয় না। কিন্তু আত্মা যদি তাদের দ্বারা চালিত হয় তাহলে মানুষ নিম্নমুখী হয়। বুদ্ধি যদি স্থূল দৈহিক কামনায় নিয়োজিত থাকে তাহলে পরমার্থ লাভ হয় না। যদি আত্মজ্ঞানে নিয়োজিত থাকে তবেই পরমার্থ লাভ হয়, একে বলা হয় জ্ঞানযোগ। আবার আবেগ, অনুভূতি যদি আত্মার দ্বারা চালিত না হয়ে আত্মাকে আচ্ছন্ন করে তাহলে ‘আমি কর্তা, আমি ভোক্তা, আমি জ্ঞাতা’ ইত্যাদি আমিত্ববোধ জাগ্রত হয়। আবেগ, অনুভূতি আত্মার অন্তঃস্থ ঈশ্বরের অনুগত হলে আত্মার স্বরূপ ব্যক্ত হয়। তখন তার আর কোনো দুঃখ জন্মায় না। একে বলে ভক্তিযোগ। ইচ্ছা যদি অনিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে চলা অসম্ভব। আত্মার দ্বারা ইচ্ছা নিয়ন্ত্রিত হলে ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন করে নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন করা যায় যা মোক্ষ বা মুক্তির পথ প্রশস্ত করে। একেই বলে কর্মযোগ।

কান্টের নৈতিক কর্তব্যবাদে কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের উল্লেখ আছে।

কর্মের উদ্দেশ্যগত মিল

গীতায় বর্ণিত নিষ্কাম কর্ম ও কান্টের নৈতিক মতবাদ এই উভয়ক্ষেত্রেই ফলমুখী (Teleological) নৈতিকতা বর্জন করে কর্তব্যমুখী (Deontological) নৈতিকতাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গীতায় কর্মযোগের মূলকথা হল ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে, কর্তৃত্বাভিমান বর্জন করে কর্ম করা।

দার্শনিক কান্টের নৈতিক মতবাদে কোনো প্রকার ফলের চিন্তা না করে শুধুমাত্র সদিচ্ছার কথা উল্লেখ করে কর্ম সম্পাদন করার কথা বলা হয়েছে।

আত্মনিয়ন্ত্রণের গুরুত্বগত মিল

গীতায় নিষ্কাম কর্মে ও কান্ট তাঁর নৈতিক মতবাদের ক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণ বলতে বোঝায় নিজের দ্বারাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে দুই রকম সত্তা আছে নিম্নতর জীবসত্তা ও উচ্চতর দেবসত্তা। নিম্নতর সত্তা কামনা-বাসনার দ্বারা চালিত হয়। উচ্চতর সত্তা শুদ্ধ বুদ্ধির দ্বারা চালিত হয়।  কান্টও তাই তার নৈতিক মতবাদে জীবসত্তাকে বুদ্ধির উচ্চতর সত্তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করতে বলেছেন।

গীতায় কর্মাযাগ ও কান্টের নৈতিক মতবাদের বৈসাদৃশ্য

গীতার কর্মযোগ ও কান্টের নৈতিক মতবাদের বৈসাদৃশ্যগুলি হল নিম্নরূপ-

ঈশ্বরের অস্তিত্ব সংক্রান্ত অমিল

গীতায় নিষ্কাম কর্মযোগের তিনটি লক্ষণের উল্লেখ করা হয়েছে। ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন, কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ ও সকল প্রকার কর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ। গীতা জ্ঞান ও ভক্তির সংমিশ্রণ হলেও কর্মই এখানে মুখ্য। কারণ অর্জুনকে যুদ্ধে (কর্মে) প্রবৃত্ত করাই শ্রীকৃষ্ণের একমাত্র লক্ষ্য। তাই বলা যায় গীতায় যে নৈতিক মতবাদ তা ধর্মমিশ্রিত। আত্মজ্ঞান লাভ ও ঈশ্বরে ভক্তি-সহ সকল প্রকার কর্ম সমর্পণ করে, কর্ম নির্দেশই গীতার প্রধান উদ্দেশ্য। শ্রীকৃয় তাই অর্জুনকে জ্ঞান ও ভক্তির উপর নির্ভর করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে বলেছেন।

অপরদিকে কান্টের নৈতিক কর্তব্যবাদে ঈশ্বর, ঈশ্বর ভক্তি ইত্যাদির কোনো উল্লেখ নেই।

বাধ্যবাধকতাগত অমিল

গীতায় নিষ্কাম কর্মের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা লক্ষ করা যায় না। অন্তরের স্বতঃস্ফূর্ততা, নিজের স্বরূপ, জগতের স্বরূপ, ঈশ্বরের স্বরূপ ইত্যাদি নিষ্কাম নীতিতত্বের ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়। এই সকল বিষয়ের সংমিশ্রণের ফলেই গীতায় নিষ্কাম কর্মের বিষয়টি পরিস্ফুট হয়েছে। এই নিষ্কাম কর্মের দ্বারাই মানুষ ঈশ্বরের অনুভূতি লাভ করে। গীতায় এই নিষ্কাম কর্মের মতবাদটি তাই আনন্দদায়ক মতবাদ বলে অভিহিত করা হয়।

কিন্তু কান্টের নৈতিক মতবাদ এমনটা নয়। এই মতবাদের প্রধান উৎস হল বিবেকের বাণী। তাই এখানে বাধ্যবাধকতা লক্ষ করা যায়।

নীতিতত্ত্বগত অমিল

গীতার কর্মযোগে কর্তার অহংকার, ফলের প্রতি আকাঙ্ক্ষা, কঠোর অনুভূতি লক্ষ করা যায় না। এক্ষেত্রে নিষ্কাম কর্মযোগী সকল কর্তব্য বর্জন করে ভগবানে একাত্ম হয়ে থাকেন।

অপরদিকে কান্টের নীতিতত্ত্বের প্রধান বক্তব্য হল ‘কর্তব্যের জন্য কর্তব্য’। এই ক্ষেত্রে স্বার্থবোধের মনোভাব বর্তমান। কর্তব্যের জন্য কর্তব্য পালন করলে কর্তার অহংকার, ফলের প্রতি আকাঙ্ক্ষা, অনেক সময় কঠোর অনুভূতিও লক্ষ করা যায়।

আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ

পদ, বাক্য, বচন, পদের ব্যাপ্যতা, সত্যতা ও বৈধতা প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment