শহীদ মাতঙ্গিনী হাজরা প্রবন্ধ রচনা
শহীদ মাতঙ্গিনী হাজরা প্রবন্ধ রচনা
সূচনা
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ভারতের শাসন ক্ষমতা চলে এল ব্রিটিশের হাতে। তারপর থেকে ভারতবাসীর ভাগ্যাকাশে ঘনিয়ে এল যুগান্তকারী ক্রান্তিকাল। শুরু হল ইংরেজের শোষন ও অত্যাচার। ভারতবাসীও চুপ করে থাকলেন না। তাঁরা এগিয়ে এলেন বিদেশী শাসক ইংরেজের বিরুদ্ধে চরম আঘাত হেনে দেশকে স্বাধীন করতে। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে একদিকে যেমন চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলন তেমনি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, হেমচন্দ্র কানুনগো, অরবিন্দ ঘোষ প্রভৃতি চরম পন্থীরাও বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করার শপথ গ্রহণ করেন। সেসময় মেদিনীপুর ছিল বিপ্লবের অন্যতম কেন্দ্র।
দেশপ্রান বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের অপ্রতিরোধ্য সংগ্রাম মেদিনীপুরের মাটিতে বপন করেছিল প্রতিরোধের বীজ। এই জেলায় এমন বাড়ি ছিল না যে বাড়িতে বিপ্লবী-স্বাধীনতা সংগ্রামী নেই। অর্থাৎ জেলার প্রায় প্রত্যেক মানুষ যোগ দিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলের মুখে উচ্চারিত হল, ‘ইংরেজ তুমি ভারত ছাড়ো’। ক্ষুদিরাম বসু, প্রদ্যোৎ কুমার ভট্টাচার্য, জ্যোতিজীবন ঘোষ, নির্মলজীবন ঘোষ, অনাথবন্ধু পাঁজা প্রভৃতি মেদিনীপুরের তরুণেরা ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে বুঝিয়ে দিলেন মেদিনীপুরের মাটিতে যে বিপ্লব- বিদ্রোহের আগুন আকাশ স্পর্শ করেছে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে তা থামবে না, থামতে পারে না। তরুণ-যুবকেরা শুধু নয়, তিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা ও শহীদ হয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পথকে ত্বরান্বিত করেছিলেন।
জন্ম-বংশপরিচয়-বাল্যকাল
মাতঙ্গিনী হাজরার জন্ম দক্ষিণ পূর্ব রেলপথে মেছেদা স্টেশনের নিকট অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার হোগলা গ্রামে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে। পিতার নাম ঠাকুরদাস মাইতি ও মাতার নাম ভগবতী দেবী। তাঁদের তিন কন্যার মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ। সে সময় নারীশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না, ছোটোবেলায় তিনি ছিলেন খুব চঞ্চল, জেদী, পরোপকারী। তিনি ভালবাসতেন রামায়ণ মহাভারতের বীরদের বীরত্বের কাহিনী শুনতে।
মাতঙ্গিনী ও জোয়ান অব আর্ক
মাতঙ্গিনীর ছেলেবেলার সাথে ফরাসী বীরাঙ্গনা জোয়ান অব আর্কের ছেলেবেলার অনেকটা মিল আছে। জোয়ান অব আর্ক জন্মেছিলেন কৃষক পরিবারে। তিনি ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতেন তাঁর দেশ ফ্রান্সকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করবেন। যা ভালো মনে করতেন শত বাধা এলেও করবেনই। মাতঙ্গিনীকেও দেখা যেত পাড়াপ্রতিবেশী কেউ অসুস্থ হলে ছুটে যেতেন সেবা করতে জোয়ান অব আর্কের মতো। তিনিও স্বপ্ন দেখতেন পরাধীন ভারতবাসীকে স্বাধীন করার এবং খোঁজ নিতেন বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাজকর্মের। তাঁরা কোনো বীরত্বপূর্ণ কাজ করলে খুশি হতেন।
কর্মজীবন
তৎকালীন সময়ে ছিল বাল্যবিবাহ প্রথার প্রচলন। খুব কম বয়সে তাঁর বিবাহ হয় হোগলা গ্রাম থেকে প্রায় আট মাইল দূরে, তমলুক থেকে দূরত্ব প্রায় সাত মাইল, রূপনারায়ণ নদী তীরবর্তী আলিনান গ্রামে ষাট বছরের বৃদ্ধ-বিপত্নীক ত্রিলোচন হাজরার সাথে। তাঁর যখন বয়স আঠারো বছর তখন মৃত্যু হয় ত্রিলোচন হাজরার। মাতঙ্গিনী ছিলেন নিঃসন্তান। শ্বশুরবাড়িতে এসেও মাতঙ্গিনীর শিশুসুলভ স্বভাবের পরিবর্তন ঘটেনি। সমাজের বেড়া ডিঙিয়ে ঘরের বাইরে এসে কাউকে সেবা দিয়ে কাউকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন। তেজস্বীকতা, সাহসিকতা, পরোপকারিতা ও সরলতা গুনগুলি পিতা মাতার থেকে প্রাপ্ত। বিধবা হওয়ার পরে মাথার চুল ছোটো করে কেটে রাখতেন। তিনি স্বপাকের রান্না আহার করে চরকায় সুতো কাটতেন। পরতেন সেই সুতোয় প্রস্তুত বস্ত্র। ন্যায়, সত্য, পবিত্রতার মন্ত্রে তিনি ছিলেন দীক্ষিত। গান্ধীজীকে মনে করতেন ন্যায় সত্যের পূজারী।
বিশেষ করে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর বক্তৃতা শুনে তাঁর মধ্যে স্বদেশীকতার জোয়ার আসে। অগ্নিশিশু ক্ষুদিরাম বসুর আত্মত্যাগ তার মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে, তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন পাড়ায় পাড়ায় স্বদেশী বস্ত্র বিক্রি করতে। দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের ইউনিয়ন বোর্ড আন্দোলনের সময় তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে বুঝিয়ে বলতেন ইউনিয়ন বোর্ডের ট্যাক্স না দেওয়ার জন্য। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে লবন আন্দোলনে যখন সক্রিয়ভাবে যোগ দেন তখন তাঁর বয়স প্রায় ষাট বছর। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জানুয়ারী আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে তমলুক আদালতে কংগ্রেসের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে গেলে পুলিশ তাঁর উপর পাশবিক অত্যাচার করে এবং বিচারে ছ’মাস কারাদন্ড হয়।
তমলুকের লাইব্রেরীর সামনে বিশাল প্যান্ডেলে জন হাবার্ট দমনমূলক কর্মপদ্ধতির বিবরণ দিতে এলে কংগ্রেস নেতা অজয়কুমার মুখোপাধ্যয়ের নির্দেশে বগলে জাতীয় পতাকা ও লাঠির উপর ভর দিয়ে এসে জাতীয় পতাকা দেখিয়ে জন হাবার্টকে ‘গো ব্যাক’ ধবনি দেন। জন হাবার্ট একজন বৃদ্ধার দেশপ্রেম দেখে বিস্মিত হন এবং কোনো শাস্তি না দিতে বলেন। একই দিনে তমলুকের বর্গভীমা মন্দিরের সামনেও তাঁকে পতাকা দেখিয়ে প্রতিবাদ করেন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে তমলুকের মহকুমা কংগ্রেসকে অবৈধ ঘোষণা করলে বিভিন্ন জনসভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে মানুষের দৃষ্টি আর্কষণ করেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মেদিনীপুর কংগ্রেস সম্মেলনের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। এইভাবে তিনি ত্যাগ- তিতিক্ষার দ্বারা নিজেকে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর গান্ধীজীর প্রতি নিষ্ঠা দেখে সকলে ‘গান্ধীবুড়ি’ বলে ডাকতেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগদান: শুরু হল ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলন। ২৯ শে সেপ্টেম্বর অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিশাল মিছিল তমলুক থানা দখলের জন্য বের হলে মাতঙ্গিনী হাতে শঙ্খ ও জাতীয় পতাকা নিয়ে সেই মিছিলে যোগ দেন। পৌরসভার জলাশয় ‘বানপুকুর’ পাড়ে মিছিল এলে পুলিশের গুলিকে উপেক্ষা করে তিনি এগিয়ে গেলেন। তখন তাঁর বয়স প্রায় তিয়াত্তর বছর। পর পর তিনটি গুলি তাঁর শরীরে আঘাত করে এবং তিনি শহীদ হন। তাঁর সাথে ছিলেন কিশোর লক্ষ্মীনারায়ণ দাস। তিনিও শহীদ হলেন।
উপসংহার
শহীদের রক্ত কখনও বিফল হয়না। মাতঙ্গিনী হাজরার মত স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবীদের প্রাণ ও ত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই আগষ্ট দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ ন্যায়, সত্য ও অহিংসভাবে দেশকে গড়ে তুলে তাঁদের মহান আদর্শকে সম্মান জানানো।
আরও পড়ুন – নেলসন ম্যান্ডেলা প্রবন্ধ রচনা