লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক (Marks 2, 3, 5) | একাদশ শ্রেণি 2nd Semester WBCHSE
লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক (Marks 2)
১. লোকসংস্কৃতি বলতে কী বোঝায় লেখো।
উত্তর: ‘লোক’ শব্দটির সাহায্যে বোঝায় নিবিড়ভাবে সন্নিবিষ্ট দীর্ঘ ঐতিহ্যের অধিকারী কোনো জনগোষ্ঠীকে। আর সেই জনগোষ্ঠীর যে সমষ্টিগত সৃষ্টিশীলতা, তাকেই বলা যায় লোকসংস্কৃতি।
২. লোকসংস্কৃতির দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
উত্তর: লোকসংস্কৃতির দুটি বৈশিষ্ট্য হল-(ক) নামহীনতা, অর্থাৎ অধিকাংশ সময়ে রচয়িতার নাম জানা যায় না। (খ) লোকসংস্কৃতি অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটায়।
৩. লোককথা বলতে কী বোঝ? লোককথার বিভিন্ন প্রকারগুলির উল্লেখ করো।
উত্তর: একটা জাতির আত্মানুসন্ধান, গৌরববোধ, স্বদেশচেতনা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস যখন অভিজ্ঞতা ও কল্পনা, স্মৃতি ও স্বপ্নের মধ্য দিয়ে কাহিনিভিত্তিক নির্মাণরূপ লাভ করে, তখন তাকে বলে লোককথা।
• লোককথার বিভিন্ন প্রকারগুলি হল-রূপকথা, উপকথা, নীতিকথা, ব্রতকথা, পশুকথা, লোকশ্রুতি, কিংবদন্তি ইত্যাদি।
৪. রূপকথা কাকে বলে?
উত্তর: লোককথার এক প্রচীন শাখা রূপকথা, যেখানে বিভিন্ন শাখাকাহিনির সমন্বয়ে এক জটিল বুননে অবাস্তব পরিবেশে, কাল্পনিক চরিত্র অবলম্বনে, অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য সব কাহিনিকে ফুটিয়ে তোলা হয়।
৫. রূপকথাকে কেন লোকসাহিত্যের আদিম রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়?
উত্তর: সমস্ত লোকসাহিত্যের মধ্যে একমাত্র রূপকথাতেই নরবলি, রাক্ষস দ্বারা নরমাংস ভক্ষণ ইত্যাদির উল্লেখ থাকে। সেকারণে একে প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম সমাজের রসসৃষ্টির প্রয়াস বলে মনে করা হয়।
৬. ব্রতকথা বলতে কী বোঝ?
উত্তর। প্রবল অনিষ্টকারী দেবতাকে সন্তুষ্ট করে তাকে মানবকল্যাণে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে যে লোককথাগুলি রচিত হয়, সেই লোককথাগুলিই ব্রতকথা নামে পরিচিত।
৭. উপকথার সঙ্গে ব্রতকথার সাদৃশ্য কী? ব্রতকথাকে ভিত্তি করে পরবর্তীকালে কোন্ সাহিত্যশাখার সৃষ্টি হয়?
উত্তর: উপকথার সঙ্গে ব্রতকথার সাদৃশ্য হল-উপকথার যেমন পশুপাখির উপরে মানবতা আরোপ করা হয়, ব্রতকথাতেও সেরকম নানা দোষগুণের আধার হিসেবে দেবতাদের ভাবা হয়।
• ব্রতকথাকে ভিত্তি করে পরবর্তীকালে মঙ্গলকাব্য ধারার সৃষ্টি হয়।
৮. রোমাঞ্চকথা বা novella কাকে বলা হয়? বাংলায় এরকম রোমাঞ্চকথার দৃষ্টান্ত দাও।
উত্তর: রোমাঞ্চকথা বা novella এমন এক সাহিত্যশাখা যেখানে ঘটনাগুলি বাস্তব জগতের নির্দিষ্ট স্থানকালে ঘটে কিন্তু চরিত্রগতভাবে অদ্ভুত হয়। আবার তা বিশ্বাসের সীমারেখাকে অতিক্রম করে না।
• বাংলায় সয়ফুলফুলমুলক বদিউজ্জামাল-এর কাহিনি রোমাঞ্চকথার দৃষ্টান্ত।
১. বীরকথা বা Hero tale-এর বৈশিষ্ট্য কী? একটি বীরকথার উদাহরণ দাও।
উত্তর: বীরকথায় একটিমাত্র চরিত্রকে কেন্দ্র করে নানা অলৌকিক ও দুঃসাহসিক কাহিনি তৈরি করা হয়।
• বেতাল পঞ্চবিংশতির বিক্রমাদিত্যের কাহিনি বীরকথার উদাহরণ।
১০. প্রবাদের সঙ্গে পুরাণের কী সাদৃশ্য আছে তা আলোচনা করো।
উত্তর: পুরাণে যেমন একটা কালপর্বে একটা দেশ বা জাতির অস্তিত্বের প্রতিফলন ঘটে, প্রবাদের একটি বাক্য বা বাক্যাংশে ঠিক সেভাবেই প্রতিফলিত হয় একটা জাতির ভাবনা ও অভিজ্ঞতার নির্যাস।
১১. ‘প্রত্যেকটি প্রবাদই সত্যি।’-মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো।
উত্তর: প্রবাদের মধ্যে যেহেতু একটা সময়ে একটা জাতির অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয় এবং প্রবাদ কোনো ব্যক্তি-বিশেষের রচনা নয়, সমাজজীবন থেকে উঠে আসে, তাই প্রবাদকে ‘সত্যি’ বলে মনে করা হয়।
১২. প্রবাদ কীভাবে সর্বজনীন এবং চিরকালীন হয়ে ওঠে?
উত্তর: কোনো নতুন পরিস্থিতিতে নতুন প্রজন্মের মানুষের ভাষা ব্যবহারে যখন একটি প্রবাদের ব্যবহার হয়, তখন তা সর্বজনীন ও চিরকালীন হয়ে ওঠে।
১৩. একটি মানবদেহ বিষয়ক এবং একটি নিসর্গ বিষয়ক প্রবাদের উল্লেখ করো।
উত্তর: মানবদেহ বিষয়ক একটি প্রবাদ হল-কান টানলে মাথা আসে। নিসর্গ বিষয়ক একটি প্রবাদ হল-মেঘ না চাইতেই জল।
১৪. একটি খাদ্যবন্ধু সংক্রান্ত এবং একটি পশুপাখি বিষয়ক প্রবাদের উল্লেখ করো।
উত্তর: একটি খাদ্যবস্তু সংক্রান্ত প্রবাদ হল-দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। একটি পশুপাখি বিষয়ক প্রবাদ হল-শকুনের নজর ভাগাড়ের দিকে।
১৫. ছড়ার মূল বৈশিষ্ট্য কী?
উত্তর: ছড়া কবিতার আদিরূপ। কোনো বিশেষ বার্তা বা মনোভাব প্রকাশের জন্য তা রচিত নয়। তা টুকরো টুকরো বেশ কিছু ছবির সমাহার। তেমনভাবে কোনো যুক্তিবোধ সেখানে থাকে না। অবশ্যই যা থাকে তা হল অন্তর্লীন ধ্বনি-মাধুর্য।
১৬. খেলার ছড়ার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো। একটি খেলার ছড়ার উদাহরণ দাও।
উত্তর: খেলার ছড়াগুলি খেলাধুলোর সঙ্গে যুক্ত। শৈশব-কৈশোরের অকারণ আনন্দ, অপার বিস্ময়, এলোমেলো স্বাধীনতা এইসব ছড়ায় জীবন্ত হয়ে ওঠে।
একটি খেলার ছড়ার উদাহরণ হল-“আইগন বাইগন তাড়াতাড়ি/যদু মাস্টার শ্বশুরবাড়ি…”।
১৭. মেয়েলি ছড়া বলতে কী বোঝ? একটি মেয়েলি ছড়ার উদাহরণ দাও।
উত্তর: কিছু ছড়া আছে যেগুলো মেয়েদের নিজস্ব পৃথিবী থেকে উঠে আসে।
অবদমিত নারীহৃদয়ের অকুণ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে মেয়েলি ছড়ায়।
একটি মেয়েলি ছড়ার উদাহরণ হল- “এলাডিং বেলাডিং সইলো/একটি খবর আইলো…।”
১৮. ধাঁধা বলতে কী বোঝ?
উত্তর: ধাঁধার ইংরেজি প্রতিশব্দ riddle বা enigma। এর ব্যুৎপত্তি বিশ্লেষণ করলে সমস্ত ক্ষেত্রেই যে অর্থটি প্রকাশ পায় সেটি হল উপদেশ প্রদান। আদিমকাল থেকে গোটা পৃথিবীতে ধাঁধার সঙ্গে মন্ত্র বা ম্যাজিকের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে।
১৯. প্রাচীনকালে ধাঁধার প্রয়োগ কীভাবে ঘটত?
উত্তর: ধাঁধা ছিল দৈব-দুর্বিপাককে দূর করার এক ধরনের কৌশল। বৃষ্টির আবাহনে বীজ রোপণ বা ফসলের মরশুমে, বন্যায়-দুর্ভিক্ষে-বিবাহে প্রিয়জনের মৃত্যুতে এই ধাঁধা জিজ্ঞাসা করা এবং উত্তর দেওয়ার প্রথা ছিল এবং এখনও কোথাও কোথাও আছে। বিশ্বাস করা হয় যে, ধাঁধার উত্তর দিতে পারলে সমস্ত বিপদ দূর হবে এবং জীবন সুখ-সমৃদ্ধিময় হয়ে উঠবে।
২০. খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার বছরের প্রাচীন ধাঁধার কিছু নিদর্শনের উল্লেখ করো।
উত্তর: ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচিত ঋগ্বেদে ধাঁধার নিদর্শন আছে। সেখানে বৎসরকে ‘দ্বাদশ শলাকা বিশিষ্ট চক্র’ বলা হয়েছে। পারস্যের কবি ফেরদৌসের ‘শাহনামা’ গ্রন্থেও ধাঁধার উল্লেখ আছে।
২১. প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে কোথায় ধাঁধার উল্লেখ আছে?
উত্তর: প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের চর্যাপদ, মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল, ঘনরামের ধর্মমঙ্গল, সহদেব চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল গ্রন্থে প্রচুর ধাঁধার উল্লেখ আছে।
২২. দুটি ধাঁধার উদাহরণ দাও।
উত্তর: দুটি ধাঁধার উদাহরণ হল-
(১) “মামারাই রাঁধে, মামারাই খায়,/আমরা গেলে পরে দুয়ার দেয়।” উত্তর-শামুক।
(২) “একটুখানি গাছে/কেষ্ট ঠাকুর নাচে।” উত্তর-বেগুন।
লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক (Marks 3)
১. বিভিন্ন প্রকার লোককথার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উত্তর: লোককথার একটি ধারা পশুকথা। জীবজন্তুর সঙ্গে মানবপ্রকৃতিকে মেলানো হয়েছে এই সব গল্পে। রূপকথায় সম্পূর্ণ অবাস্তব পরিবেশে কল্পিত চরিত্রের সমাবেশে কাহিনিকে ফুটিয়ে তোলা হয়। লোককথার বিশিষ্ট শাখা ব্রতকথা। অনিষ্টকারী দেবতাকে খুশি করে তাঁর আশীর্বাদে কল্যাণ লাভের বিশ্বাস থেকেই এই ব্রতকথাগুলির জন্ম। লোককথার আর-একটি শাখা রোমাঞ্চকথা (novella)। এখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সীমা পেরোনো নানা অসম্ভব ঘটনার সমাবেশ ঘটে। পুরাণকথা পুরাণ নয়, আদ্যন্ত লোককথা। যদিও এখানে সৃষ্টিতত্ত্ব, মানুষের বিবর্তন, ধর্মের আবির্ভাব, লোকাচার ইত্যাদিই মূল বিষয় হয়ে উঠেছে। লোককথার আর-একটি ধারা স্থানিক কথা (sage)। কোনো একটি স্থানের উপর ভিত্তি করে রচিত এই জাতীয় কাহিনিতেও নানা অবাস্তব বিষয়ের মিশ্রণ ঘটে।
২. লোককথার অন্যতম শাখা রূপকথা সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: বাংলা শব্দ ‘রূপকথা’র ইংরেজি প্রতিশব্দ অনেকে fairy tale করলেও তা যথাযথ নয়, কারণ ‘fairy’ কথাটির অর্থ ‘পরি’। আর বাংলা রূপকথায় পরির জায়গা নেই। রূপকথায় থাকে রাক্ষস- খোক্কস, আর রাজপুত্র। এদেরকে বধ করে রাজকন্যা অর্ধেক রাজত্ব অধিকার করে। অবাস্তব এবং অদ্ভুত পরিবেশসৃজন, চরিত্রসমূহের অস্পষ্টতা, আয়তনের দীর্ঘতা এবং কাহিনির জটিলতা রূপকথার বৈশিষ্ট্য। রূপকথার কোনো চরিত্রেরই কোনো নাম নেই, কেবল রাজা, রাজপুত্র, রানি ইত্যাদি হল তাদের পরিচয়।
কোনো রাজ্যেরও নাম নেই, কেবল থাকে কোনো-এক দেশের রাজার উল্লেখ। ঘুরে- ফিরে আসে তেপান্তরের মাঠ আর তিরপনির ঘাট। কিন্তু সেগুলি কোথায় তা কেউ জানে না। এই অনির্দিষ্টতাই রূপকথাকে সর্বজনীন করে তোলে। নিয়তি বা ভাগ্য বাংলা রূপকথায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা অধিকার করে থাকে। যেমন-কাজলরেখার কাহিনি। আবার প্রেমও বাংলা রূপকথায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে অনেকক্ষেত্রে। যেমন-মধুমালা বা শঙ্খমালার কাহিনি।
৩. লোককথার অন্যতম শাখা ব্রতকথা বিষয়ে আলোচনা করো।
উত্তর: বাংলার ব্রতকথাগুলি বাংলার লৌকিক দেবদেবীদের অবলম্বন করে লেখা হয়েছে। অনিষ্টকারী কোনো দেবতাকে সন্তুষ্ট করে তাঁর দ্বারা কল্যাণ সাধন করাই বাংলার ব্রতকথাগুলির উদ্দেশ্য। ব্রতকথায় দোষগুণ-সমন্বিত মানবরূপেই দেবতাদের আবির্ভাব ঘটে। ব্রতকথার দেবতাদের সঙ্গে মঙ্গলকাব্যের দেবতাদের ভাবগত অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গার্হস্থ্য সুখসমৃদ্ধির সন্ধানই ব্রতকথার লক্ষ্য। কখনো-কখনো রূপকথাকে কিছুটা পরিবর্তিত করে ব্রতকথার আকার দেওয়ার চেষ্টাও করা যায়। যেমন-সঙ্কটার ব্রতকথা। ব্রতকথায় চরিত্র ভাবনায় অভিনবত্ব পাওয়া যায় না। সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে আসেন রাজা কিংবা সওদাগর। আর দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে আসেন বামুন, যিনি হয় দরিদ্র, না-হয় ভিক্ষুক। স্বামীর সৌভাগ্য, সন্তানসুখ-নারীর এই কামনাই ব্রতকথার মধ্যে প্রকাশ পায়। বাংলার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্রত হল- ‘পুণ্যিপুকুর ব্রত’, ‘বসুধারা ব্রত’, ‘সেঁজুতি ব্রত’, ‘হরিচরণ ব্রত’, ‘সুবচনি ব্রত’ ইত্যাদি।
৪. লোককথা কাকে বলে? লোককথার যে-কোনো দুটি শাখার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উত্তর: জাতির অভিজ্ঞতা, আত্মসন্ধান, গৌরববোধ, স্বদেশচেতনা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের চেতনা যখন ব্যক্তিমানুষের প্রতিভা আর কল্পনার লোকোত্তর বিস্তারে স্মৃতিরূপ লাভ করে, তখন তাকেই লোককথা বলা হয়। মনে রাখা দরকার, লোককথা প্রধানত শ্রুতিনির্ভর। লোককথা সাধারণত গদ্যে রচিত, পদ্যে যখন তা রচিত হয়, তখন তাকে বলে গীতিকা।
৫. প্রবাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
উত্তর: প্রবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
১. প্রবাদের আয়তন সংক্ষিপ্ত, প্রায়শই একটিমাত্র বাক্যের, কখনো- কখনো দুটি বাক্যের হয়।
২. প্রবাদের অপর বৈশিষ্ট্য রচয়িতার নামহীনতা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কবে, কোন্ যুগে, কোন্ প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে জানা যায় না।
৩. প্রতিটি প্রবাদই হল লোক-অভিজ্ঞতা এবং লোকদর্শনের একটি সংহত এবং সুন্দর ভাষাগত প্রকাশ।
৪. প্রবাদকে সার্থক করে তোলে এর সরল প্রকাশভঙ্গি এবং সহজ ভাষা।
৫. প্রবাদের মধ্যে প্রধান হয়ে ওঠে ব্যঙ্গ, শ্লেষ ও বক্রোক্তির সুর।
৬. আত্মসমালোচনাও কখনো-কখনো প্রবাদের বিষয় হয়ে ওঠে।
৭. প্রবাদের আর-একটি বৈশিষ্ট্য তার বিষয়বৈচিত্র্য।
৬. বাংলা প্রবাদের গঠনবৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
উত্তর: কতকগুলি সূত্রের উপরে বাংলা প্রবাদের সংগঠন দাঁড়িয়ে আছে-
১. বাংলা প্রবাদ সৃষ্টিতে ‘চিহ্ন’ খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। যেমন-‘সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে’, ‘চেনা বামুনের পৈতা লাগে না’। হাঁচি, পৈতা ইত্যাদি এখানে চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
২. বাংলা প্রবাদ অনেক সময়েই সংখ্যা দ্বারা নির্দিষ্ট হয়েছে। যেমন-‘দশচক্রে ভগবান ভূত’, ‘মরা হাতি লাখ টাকা’ ইত্যাদি।
৩. প্রবাদে অনেক সময়েই কার্য-কারণ সম্পর্কের বিস্তার দেখা যায়। যেমন-‘পেটে খেলে পিঠে সয়’, ‘কান টানলে মাথা আসে’ ইত্যাদি।
৪. প্রবাদের মধ্যে থাকে সাধারণীকরণের প্রবণতা। যেমন- ‘যে যায় লঙ্কায় সে-ই হয় রাবণ’।
৫. প্রবাদের মধ্যে দুটি বিষয়ের তুল্যমূল্য সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। যেমন-শক্তের ভক্ত নরমের যম’, ‘যেমন বুনো ওল, তেমন বাঘা তেঁতুল’ ইত্যাদি।
এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, প্রতিটি প্রবাদই আসলে যুক্তিশৃঙ্খলার ফল।
৭. বাংলা প্রবাদের বৈচিত্র্য বিষয়ে আলোচনা করো।
উত্তর: বাংলা প্রবাদ এক বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি-
১. প্রকৃতিগত বৈচিত্র্য: কিছু বাংলা প্রবাদ আছে লৌকিক; লোকের মুখে মুখে যুগ যুগ ধরে তাদের সৃষ্টি এবং টিকে থাকা। এদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু কিছু প্রবাদ লৌকিকভাবে সৃষ্টি হলেও সামান্য পরিবর্তন করে সাহিত্যে তাদের ব্যবহার ঘটেছে।
২. উৎসগত বৈচিত্র্য: বাংলা শব্দভান্ডারে যেমন বেশ কিছু আগন্তুক শব্দ পাওয়া যায় তেমনই আগন্তুক প্রবাদও পাওয়া যায়। সংস্কৃত ‘কণ্টকেনৈব কণ্টকম্’ বাংলায় হয়েছে ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’।
৩. বিষয়গত বৈচিত্র্য: বাংলা প্রবাদের বিষয়গত বিস্তার অসামান্য। সেখানে দেবদেবী, ইতিহাস, মানবদেহ, পুরাণ থেকে পরিবার জীবন, মানুষের আচার-আচরণ, পেশা, অসুখ ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়েও প্রবাদ রচিত হয়েছে।
৪. লোকশিক্ষা: প্রবাদের মধ্য দিয়ে জনসাধারণকে সচেতন করার বা শিক্ষা দেওয়ার একটা পরোক্ষ প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়।
৮. বাংলা প্রবাদে সমাজ বাস্তবতার যে প্রকাশ ঘটেছে তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।
উত্তর: লোকসমাজের সঙ্গে নিবিড় সংযোগের উদাহরণ বাংলা প্রবাদে প্রকাশিত হয়েছে।
১. পশুপাখি ও ভূপ্রকৃতি: কুমির, বাঘ, শকুন, বিড়াল, কাক ইত্যাদি পশুপাখির কথা যেমন বাংলা প্রবাদে আছে তেমনই নদী, খাল, বিল নিয়ে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির একটি ছবিও বাংলা প্রবাদগুলিতে পাওয়া যায়। যেমন-‘জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ’।
২. পেশা-পরিচয়: তাঁতি, বোষ্টম, বামুন, কৃষক, ফকির ইত্যাদি নানা পেশার মানুষের কথা প্রবাদে পাওয়া যায়। যেমন- ‘খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে/কাল হল এঁড়ে গোরু কিনে’।
৩. সমাজ-মনস্তত্ব: সামাজিক স্বার্থপরতার ছবি বাংলা প্রবাদে রয়েছে, যথা-‘কাজের বেলায় কাজি, কাজ ফুরোলে পাজি’।
9. তোমার অঞ্চলে প্রচলিত ছ-টি বিষয়ে প্রবাদ লিখে বাস্তবজীবনে সেগুলির বিভিন্ন প্রয়োগ-সার্থকতা ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: আমার অঞ্চলে প্রচলিত দশটি বিভিন্ন বিষয়ের দশটি প্রবাদ লিখে সেগুলির বাস্তবজীবনে প্রয়োগ-সার্থকতা ব্যাখ্যা করা হল-
১. স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ক: ‘সকালে শুয়ে সকালে উঠে, তার কড়ি না বৈদ্যে লুটে’-মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য সু-অভ্যাস গড়ে তোলা আবশ্যক।
২. সমাজ বিষয়ক: ‘কাজের বেলায় কাজি, কাজ ফুরোলে পাজি’-সমাজে স্বার্থপর লোকের সংখ্যা যে কম নয়, সে বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
৩. মনুষ্য-চরিত্র বিষয়ক: ‘অতি লোভে, তাঁতি নষ্ট’-লোভ থেকে মুক্ত হয়ে মূল্যবোধ গড়ে তোলার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
৪. সংঘশক্তি বিষয়ক: ‘একের বোঝা, দশের লাঠি’-একত্রিত, দলবদ্ধ থাকলেই প্রকৃত শক্তি পাওয়া যায়।
৫. অবাস্তবতা বিষয়ক: ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন’- অবাস্তব উচ্চাভিলাষ মানুষকে আদতে দুঃখী-ই করে তোলে।
৬. লোক-সিদ্ধান্ত বিষয়ক: ‘যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা’-পৃথিবীতে নিরপেক্ষ মানুষের সংখ্যা খুবই কম।
১০. বাংলায় ঘুমপাড়ানি ছড়াগুলির বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে লেখো।
উত্তর: বাংলা ‘ঘুমপাড়ানি ছড়া’-গুলির কেন্দ্রে রয়েছে শিশু। তাকে ঘুম পাড়ানোর নানা প্রণালী এই ছড়াগুলিতে ফুটে উঠেছে। এখানে রয়েছে এক ধরনের সর্বজনীন আবেদন। আবার ঘুমপাড়ানি ছড়াকার যখন বলেন-“দোল দোল দুলুনি/রাঙ্গা মাথায় চিরুনি/বর আসবে এখুনি/নিয়ে যাবে তখুনি”-তখন শিশুর অন্যতম আকর্ষণীয় শয্যা দোলনাকে আশ্রয় করে এমন এক ছবি তুলে ধরা হয় যা আমাদের সকলকেই চিরন্তন শৈশবে পৌঁছে দেয়। এই চিত্রমাধুর্যই ছড়ার প্রাণ। আবার নিদ্রাহীন শিশুকে ঘুমপাড়ানোর জন্য যখন ‘ঘুমপাড়ানি মাসি’ পিসি-কে আহ্বান করা হয় তখন ছড়া যেন অলৌকিকের প্রকাশ হয়ে যায়।
এইভাবেই জাদু শক্তিতে ঘুমপাড়ানি ছড়া শিশুমনকে আকৃষ্ট করে, তার চোখে নিদ্রার আবেশ তৈরি করে দেয়। বাংলা ‘ঘুমপাড়ানি ছড়া’-গুলিতে মা বা মাতৃসমাজের স্নেহভরা মনের মায়াময় বিস্তার ঘটে।
১১. বাংলা ছেলেভুলানো ছড়াগুলির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যা জান লেখো।
উত্তর: সংসারের অজস্র কাজের ফাঁকে অবোধ শিশুকে ভুলিয়ে রাখার জন্যই ছেলেভুলানো ছড়াগুলির সৃষ্টি, মায়ের মুখেই তাই ছেলেভুলানো ছড়ার বিকাশ। দু-হাঁটুর উপরে শিশুকে বসিয়ে দোল দিতে দিতে মা ছড়া কাটেন, আর অবোধ শিশু সেই সুরের মায়াজালে আটকে পড়ে। বৃহত্তম অর্থে ঘুমপাড়ানি ছড়াগুলি ছেলেভুলানো ছড়ার অন্তর্গত হলেও শিশুদের ভোজন, শয়ন, বিশ্রাম, কান্না ইত্যাদি নানাকিছু ছেলেভুলানো ছড়ার অন্তর্গত। “এ দুধ খায় কে রে/সোনা মুখ যার রে।/ঘন দুধের ছানা, সবাই বলে দেনা…”। কান্না থামানোর জন্যও থাকে অজস্র আয়োজন-
“হাল করিয়া হাসিয়া দুব দুধ খাইতে গাই। রাখাল রাখিতে দুব শ্যামের ছোট ভাই।”
কখনও ছেলে ভুলানোর জন্য বিয়েকে বিষয় করে তোলা হয়। শিশুকে শোনাতে গিয়ে ছড়া যেন এক সর্বমানবিক ব্যঞ্জনা লাভ করে। সোনা, মাইনকা (মানিক), মনা, কচিয়া (কচি), বাপো (বাপ) ইত্যাদি স্নেহের সম্বোধনে ছেলেভুলানো ছড়ায় মাতৃহৃদয়ের অসামান্য প্রকাশ ঘটেছে।
১২. ছড়ার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। যে-কোনো দুই ধরনের ছড়ার উদাহরণ দাও।
উত্তর: লোকসাহিত্যের প্রথম সৃষ্টি ছড়া। ছড়ার মধ্যে সুর থাকলেও ছড়া কিন্তু কখনোই লোকসংগীত নয়। কোনো একটি বিশেষ ভাবকে অবলম্বন করে লোকসংগীত রচিত হয়। কিন্তু ছড়ায় এরকম কোনো বিশেষ ভাবের সন্ধান পাওয়া যায় না। গীতিকার মতো কাহিনি নয়, ছড়ায় যা থাকে তা হল কথার ছবি আঁকার চেষ্টা। আবার প্রবাদের মতো ব্যঙ্গপ্রাধান্যও ছড়ায় নেই। সমালোচনা কিংবা আক্রমণহীন প্রশান্তিই ছড়ার প্রাণ। আবার ছড়ার সঙ্গে যখন হাততালি দিয়ে শিশুকে দোলানো ও নাচানো হয়, তখন শিশুর মধ্যে যে শারীরিক অনুভবের সঞ্চার হয়, তার সামাজিক তাৎপর্য অসীম।
• ঘুমপাড়ানি ছড়ার উদাহরণ হল- “ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি এসো”
১৩. ধাঁধার সঙ্গে শিক্ষা ও উপদেশ প্রদানের বিষয়টি কীভাবে জড়িত বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: ধাঁধার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করলেই ধাঁধার সঙ্গে শিক্ষা ও উপদেশ প্রদান যেভাবে জড়িয়ে আছে তা বোঝা যায়। ধাঁধায় যে মূল বৈশিষ্ট্যগুলি বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় সেগুলি হল-
১. ধাঁধায় থাকে ভাষার প্রতি দখল, চিন্তার উৎকর্ষ এবং ছন্দ সম্পর্কে স্বচ্ছ জ্ঞান।
২. ধাঁধায় প্রশ্নকর্তা এবং উত্তরদাতা দুজনেই সক্রিয় থাকে।
৩. ধাঁধা যেহেতু সক্রিয়তার চর্চা, তাই এখানে বুদ্ধির অনুশীলন যেমন ঘটে, অন্যদিক দিয়ে ধাঁধা এক রকমের মানসিক ক্রীড়াও বটে।
৪. ধাঁধায় বুদ্ধির অনুশীলন ঘটলেও তার মধ্যে প্রবাহিত থাকে এক নির্মল হাস্যরস।
৫. পরিচিত এবং দৈনন্দিন জীবন থেকে ধাঁধার উপকরণ সংগ্রহ করা হয়। যেমন-শিল, নোড়া, উনুন, ছাতা, লাঠি ইত্যাদি।
৬. ধাঁধায় বর্ণ, চিহ্ন, সংখ্যা, আকার, আচরণ, গুণ ইত্যাদির দিক দিয়ে সাদৃশ্য বা তুলনা আরোপ করে সংকেত তৈরি করা হয়। যেমন-একটুখানি গাছে/কেষ্ট ঠাকুর নাচে। = বেগুন > বর্ণসাদৃশ্য
সুতরাং, ধাঁধার সঙ্গে শিক্ষা এবং উপদেশ প্রদানের বিষয়টি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।
১৪. ধাঁধায় বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।
উত্তর : বাঙালির গার্হস্থ্য জীবন নানা ধরনের ধাঁধার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
চুনকাম করা ঘর কিংবা দুধভাত খাওয়া শিশুরা বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের প্রতীক হয়েই ধাঁধাতে উঠে আসে। একাধিক ধাঁধায় বিবাহসংস্কৃতির প্রতীক হয়ে এসেছে ‘সোনার টোপর’। আয়না, কাজলের ফোঁটা ইত্যাদি সাজসজ্জার দৃষ্টান্ত হয়ে ধাঁধায় এসেছে। ধাঁধার উত্তরের মধ্যে বঙ্গজীবনের নিবিড় রূপটি আরও স্পষ্ট হয়। বেশ কিছু ধাঁধার উত্তরে থাকে বাংলাদেশের পরিচিত ফল, প্রাণী ইত্যাদি। অবসর বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন হুঁকা এবং কলকেও কোনো কোনো ধাঁধায় উত্তর হিসেবে উঠে এসেছে। আগেকার দিনে নিম্নবর্ণের মানুষরা বিশ্বাস করত ধাঁধার জাদু শক্তিতে। কখনো-কখনো বিবাহ বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানেও ধাঁধার ব্যবহার চলত। সুতরাং, যে ধাঁধা এখন নিছকই শিশুমনের খোরাক, তার সামাজিক প্রেক্ষাপটকে কিন্তু কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
১৫. বাংলা ধাঁধার বিষয়বৈচিত্র্য উল্লেখ করো।
উত্তর: বিষয়বস্তু অনুসারে বাংলা লৌকিক ধাঁধাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়।
১. নরনারী ও দেবদেবী বিষয়ক: “মামা বলে মা/বাবা বলে মা/মা বলে মা/ছেলে ও মেয়ে বলে মা/এ আবার হল কী” (উত্তর- দেবী কালিকা)।
২. প্রকৃতি বিষয়ক: “এখান থেকে ছুঁড়লাম থাল,/থাল গেল সমুদ্রের পার।”
৩. গার্হস্থ্য-জীবন বিষয়ক: আত্মীয়, অনাত্মীয়, কাছের মানুষ, খাদ্যবস্তু, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত জিনিসপত্র, আচার- আচরণ-অনুষ্ঠান ইত্যাদিকে অবলম্বন করে এই ধাঁধাগুলি রচিত হয়েছে। এই রকমই পানিফল বিষয়ক একটি ধাঁধা হল- “ইনশিঙ্গ বিনশিঙ্গ মাথায় তিনটে শিং/পশু নয় পক্ষী নয় জলে পাড়ে ডিম”।
৪. পশুপক্ষী ও কীটপতঙ্গ বিষয়ক: বিভিন্ন কীটপতঙ্গ যেমন- পোকা, মাকড়সা, শামুক কিংবা শকুন, কাক ইত্যাদি পাখি ধাঁধার বিষয় হয়েছে। যেমন- “মামারাই রাঁধে, মামারাই খায়,/আমরা গেলে পরে দুয়ার দেয়।” উত্তর-শামুক।
লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক (Marks 5)
১. প্রবাদ ও প্রবচন বলতে কী বোঝ? দুটি বাংলা প্রবাদের উদাহরণ দাও।
উত্তর: প্রবাদের মধ্যে থাকে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা আর মানবিক আবেদন। সহজ প্রকাশভঙ্গি আর সরল ও সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনায় তা হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। সাধারণভাবে প্রবাদের সমার্থক হিসেবে ‘প্রবচন’ শব্দটিরও ব্যবহার ঘটে বাংলায়। ‘প্রবচন’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘প্রকৃষ্ট বচন’ বা ‘সদালাপ’। কঠোপনিষদে প্রবচন বিষয়ে বলা হয়েছে-“নায়মাত্ম প্রবচনেন লভ্যঃ”। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অবশ্য প্রবাদ ও প্রবচনের পার্থক্য নির্ণয় করে বলেছেন যে, প্রবাদের মধ্যে একটি গল্পের ভাব আছে কিন্তু প্রবচন ছাঁটা-কাটা কথা মাত্র, আনন্দ-দুঃখ বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানই তার সম্বল।
• দুটি ভিন্ন বিষয়ের ভিত্তিতে দুটি প্রবাদের উদাহরণ নীচে দেওয়া হল-
সমাজ বিষয়ক-‘তিলক কাটলেই বোষ্টম হয় না।’
দেবদেবী বিষয়ক- ‘রাখে হরি, মারে কে?’
২. লোকসাহিত্যে ছড়ার বিশিষ্টতা আলোচনা করো।
উত্তর: লোকসাহিত্যের প্রথম সৃষ্টি ছড়া। ছড়ার মধ্যে সুর থাকলেও ছড়া কিন্তু কখনোই লোকসংগীত নয়। কোনো একটি বিশেষ ভাবকে অবলম্বন করে লোকসংগীত রচিত হয়। কিন্তু ছড়ায় এরকম কোনো বিশেষ ভাবের সন্ধান পাওয়া যায় না। গীতিকার মতো কাহিনি নয়, ছড়ায় যা থাকে তা হল কথার ছবি আঁকার চেষ্টা। আবার প্রবাদের মতো ব্যঙ্গপ্রাধান্যও ছড়ায় নেই। সমালোচনা কিংবা আক্রমণহীন প্রশান্তিই ছড়ার প্রাণ। আবার ছড়ার সঙ্গে যখন হাততালি দিয়ে শিশুকে দোলানো ও নাচানো হয়, তখন শিশুর মধ্যে যে শারীরিক অনুভবের সঞ্চার হয়, তার সামাজিক তাৎপর্য অসীম।
৩. ‘খেলার ছড়া’-গুলি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।
উত্তর: খেলার ছড়াগুলি শিশুদের নিজেদের সৃষ্টি। অনেকসময় খেলাকে অবলম্বন করে এগুলি তৈরি হয়। কখনও ছড়াকে অবলম্বন করেও খেলার পরিকল্পনা হয়। এখানে দু-ধরনের ছড়া পাওয়া যায়- (১) বাইরের খেলাভিত্তিক ছড়া। বাইরের গ্রামীণ খেলার অন্যতম হাডুডু-কে নিয়ে লেখা ছড়া-“চু যা চরণে যাব।/পাতি নেবুর মাতি খাব।” (২) অন্দরের খেলাভিত্তিক ছড়া। বৃষ্টির দিনে যখন বাইরে যাওয়া যায় না, সেই সময় ঘরের মধ্যে খেলায় গুণে গুণে নির্দিষ্ট কাউকে চোর ইত্যাদি বানানোর জন্য ছড়া কাটা হত-
“আপন বাপন চৌকি চাপন, ওল, ঢোল, মামার খোল ওই মেয়েটি খাটিয়া চোর।”
খেলার ছড়াকে কখনও প্রশ্নোত্তরের আকারেও রূপ দেওয়া হয়। খেলার ছড়া সংঘবদ্ধতা এবং শৃঙ্খলাবোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। যদিও অঞ্চলভেদে এই খেলার ছড়ার বিভিন্ন রূপ দেখা যায়।
৪. প্রবাদের সঙ্গে ধাঁধার পার্থক্য কোথায়?
উত্তর: প্রবাদ ও ধাঁধা উভয়েই সংক্ষিপ্ত এবং উভয়েই পদ্যবন্ধ সরস রচনা কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের স্বরূপ সম্পূর্ণ আলাদা।
১. প্রবাদের অর্থ বুদ্ধি দ্বারা উপলব্ধি করতে হলেও ধাঁধার অর্থ অনেক বেশি বুদ্ধিগ্রাহ্য। কারণ ধাঁধার উদ্দিষ্ট অর্থ সম্পূর্ণ গোপনীয়।
২. প্রাত্যহিক জীবনের নানা ওঠা-পড়া এবং মেজাজের সঙ্গে প্রবাদের যোগ থাকে কিন্তু ধাঁধা হল বুদ্ধির খেলা; যার সঙ্গে অবসর যাপনের যোগ রয়েছে।
৩. প্রবাদের মধ্যে সমালোচনার প্রাধান্য থাকায় এর ভাষা অত্যন্ত তীব্র এবং প্রত্যক্ষ। অন্যদিকে, ধাঁধার ভাষা অনেকটাই কোমল এবং স্নিগ্ধ।
৪. প্রবাদের ভাষায় যেখানে পান্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়, ধাঁধার ভাষা সেখানে কবিত্বপ্রধান।
৫. প্রবাদ অপেক্ষা ধাঁধা প্রাচীন। কিন্তু সমাজজীবনের সঙ্গে যোগ থাকায় প্রবাদের যে আবেদন আজও আছে, তা ধাঁধার ক্ষেত্রে অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে।
৬. উচ্চ মননশীলতার নিরিখে প্রবাদ আধুনিক সাহিত্যেও গ্রহণযোগ্য হয়েছে কিন্তু ধাঁধার সেই গ্রহণযোগ্যতা এখনও তেমন তৈরি হয়নি।
আরও পড়ুন – বই কেনা প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর