লালন শাহ ফকিরের গান প্রশ্ন ও উত্তর ( Marks 2, 3, 5) | একাদশ শ্রেণি 2nd Semester WBCHSE
লালন শাহ ফকিরের গান প্রশ্ন ও উত্তর ( Marks 2)
“….স্ক্যাপারে তুই মূল হারাবি।।”-এখানে ‘মূল’ কী? কীভাবে তা হারিয়ে যাবে?
উত্তর: ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’-এর উল্লিখিত অংশে ‘মূল’ বলতে ‘মনের মানুষ’-কে বোঝানো হয়েছে, কারণ বাউল সাধকের চূড়ান্ত অন্বিষ্ট এই ‘মনের মানুষ’।
বাউল সাধকরা মানবতত্ত্বের সাধনা করেন। তাই লালনের মনে হয়েছে যে, এই মানবতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে বা মানুষকে উপেক্ষা করলে ‘মূল’ হারাতে হয় বা ‘মনের মানুষ’-এর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয় না।
“দ্বি-দলের মৃণালে/সোনার মানুষ উজ্জ্বলে”-মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: বাউল ধর্মসাধনায় ‘দ্বি-দল’ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ‘দ্বি-দল’ অর্থাৎ দুই দল আসলে দুটি অক্ষর-‘হ’ এবং ‘ক্ষ’। ‘হ’ হৃদয়ের এবং ‘ক্ষ’ ক্ষণ বা মুহূর্তের প্রতীক। এই দুই দলের মিলনে যে মৃণাল, তা আসলে ‘আজ্ঞাচক্র’। এই আজ্ঞাচক্রের নির্দেশনাতেই বাউল সাধকের কাছে তাঁর ‘মনের মানুষ’ (সোনার মানুষ) উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
“মানুষ-গুরু কৃপা হ’লে/জানতে পাবি।।”-কী জানতে পারার কথা বলা হয়েছে?
উত্তর: মানুষকে ভজনা করলে সোনার মানুষ হওয়া যায় এবং দ্বি-দলের মৃণালে সোনার মানুষ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গুরুর কৃপায় এই সত্যই বাউল সাধক জানতে পারেন।
“দেখনা যেমন আলেক লতা…”-যে প্রসঙ্গে কবি এ কথা বলেছেন তা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তর: গাছের মধ্যে অলক্ষে অবস্থান করে লতা। সেরকমই মানুষের মনের মধ্যে থাকে আর-এক মানুষ-‘মনের মানুষ’। তার অবস্থান দৃশ্যমানতার আড়ালে। সাধনার মধ্য দিয়ে তার স্বরূপকে উপলব্ধি করতে হয়। এই প্রসঙ্গেই মন্তব্যটি করা হয়েছে।
“মানুষ ছাড়া মন আমার”-‘মানুষ ছাড়া মন’ বলতে কী বোঝ? এর পরিণতি কী?
উত্তর: ‘মানুষ ছাড়া মন’ বলতে বোঝায় মানুষের সান্নিধ্যহীন অবস্থা।
• মন যদি মানবসর্বস্ব না হয় তাহলে ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধান অর্থহীন হয়ে যায়। লালন এই অবস্থাকে বলেছেন ‘শুন্যকার’-এ পর্যবসিত হওয়া।
“পড়বি রে তুই শুন্যকার”-কবির এই মন্তব্যের কারণ কী?
উত্তর: মানুষের যদি মানবতত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা না থাকে তাহলে তার পক্ষে মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া বা ঈশ্বর সন্ধান অর্থহীন হয়ে যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতেই লালন উল্লিখিত মন্তব্যটি করেছেন।
লালন শাহ ফকিরের গান প্রশ্ন ও উত্তর ( Marks 3)
“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”-মন্তব্যটির তাৎপর্য সমগ্র কবিতা অবলম্বনে আলোচনা করো।
উত্তর: বাউল সাধনা মানবতাকে ভিত্তি করে। লালনও তাঁর গানে লিখেছেন-“সকলের মূল মানুষনিধি, তার উপরে নাই রে বিধি/ভজনপূজন জপমালা।” পঠিত গানেও সেই মানবতত্ত্বের কথাই রয়েছে। শুদ্ধ মানুষ হয়ে উঠতে গেলে মানুষকে ভজনা করতে হবে। এই মানবতত্ত্বের সঙ্গেই জুড়ে থাকে আত্মতত্ত্ব অর্থাৎ নিজের ভিতরে থাকা শুদ্ধতম মানুষ বা মনের মানুষের সন্ধান। ‘মানুষে মানুষ গাথা’ আছে। লালন মনে করেন, সেই মানুষকে খুঁজতে গেলে মানবতাই একমাত্র পথ এবং যে মন, মানুষ থেকে বিযুক্ত হয়ে আচার-আচরণের দ্বারা ঈশ্বর সন্ধান করে, তার সব প্রচেষ্টা শূন্যতায় পর্যবসিত হয়।
“সোনার মানুষ উজ্জ্বলে”-‘সোনার মানুষ’ কে? সে কীভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে?
উত্তর: ‘সোনার মানুষ’ বলতে বাউল সাধনার চূড়ান্ত অন্বিষ্ট ‘মনের মানুষ’-এর কথা বলা হয়েছে।
বাউল সাধনায় মানুষ সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে এবং মানব শরীর সেখানে সাধনার একমাত্র ভিত্তি। ব্যক্তি মানুষ তখনই ঈশ্বরস্বরূপ হয়ে ওঠে যখন সে মানুষকে ভজনা করে। মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ‘মূল’ হারাতে হয়। অর্থাৎ, ‘মনের মানুষ’-এর সান্নিধ্য পাওয়া যায় না। সোনার মানুষ ‘উজ্জ্বল’ হয়ে ওঠে বাউল সাধনায় আজ্ঞাচক্রের নির্দেশনায়। আজ্ঞাচক্র হল দুই দলের মিলনে গঠিত মৃণাল। সেই দুই দল হল ‘হ’ এবং ‘ক্ষ’। ‘হ’ হৃদয়ের প্রতীক, আর ‘ক্ষ’ ক্ষণ বা মুহূর্তের প্রতীক।
“জেনে শুনে মুড়াও মাথা”-কাদের উদ্দেশে কবি এ কথা বলেছেন? এ কথা বলার কারণ কী?
উত্তর: প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণের প্রয়োজনে যারা মুণ্ডিতমস্তক হয়, তাদের উদ্দেশে লালন উল্লিখিত মন্তব্যটি করেছেন।
• প্রকৃত বাউল সাধকের মতোই লালন বিশ্বাস করতেন মানবতত্ত্বে। এই মানবতত্ত্ব আত্মদর্শনের কথা বলে, অর্থাৎ মানুষের নিজেকে নিজে জানার ওপরে গুরুত্ব দেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে যারা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আচরণ করে এবং আচার-অনুষ্ঠানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়, তারা যে ঈশ্বর-সাধনা থেকে দূরে সরে যায় সে কথাই এখানে বলতে চাওয়া হয়েছে।
“এই মানুষে মানুষ গাথা”-এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে বাউল দর্শনের যে বিশেষ দিকটি প্রকাশিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তর: লালন তাঁর গানে মানুষকে ভজনার কথা বলেছেন। “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”-এই সর্বমানবতাবাদের সঙ্গেই যুক্ত আছে বাউলদের আত্মতত্ত্বের ধারণা। মনের ভিতরেই রয়েছে শুদ্ধতম মানুষ, বাউলরা যাকে বলে ‘মনের মানুষ’ বা ‘সহজ মানুষ’। বাউলদের মানবতত্ত্বের কেন্দ্রে রয়েছে এই ‘মনের মানুষ’। লালনের কথায়, যেমন গাছের মধ্যে থাকে ‘আলেক লতা’, সেরকমই মানুষের মধ্যে থাকে আর-এক মানুষ, যাকে লালন তাঁর অন্য গানে বলেছেন ‘আলেক মানুষ’। সে কারণেই কবি বলেছেন ‘মানুষে মানুষ গাথা’।
“লালন বলে…”-লালন কী বলেন? সেই বলার সার্থকতা কী?
উত্তর: ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’-এর ভণিতায় লালন বলেছেন যে, মানুষ- আকার ভজনা করলেই একমাত্র ত্রাণ পাওয়া যায়।
লালন তাঁর বিভিন্ন গানে বারে বারে মানবতার কথা উচ্চারণ করেছেন। এই গানেও লালন বলেছেন মানুষকে ভজনার কথা। শুধু তাই নয়, মানুষের মধ্যেই যে শুদ্ধতম মানুষ বা মনের মানুষ রয়েছে তার সন্ধান করার কথাও কবি বলেছেন। মানুষ ছাড়া মন নিরর্থক। সেকারণে লালন বলেছেন যে, প্রকৃত মুক্তি পেতে গেলে মানুষ- ভজনা করতেই হবে।
লালন শাহ ফকিরের গান প্রশ্ন ও উত্তর ( Marks 5)
লালন শাহ্ ফকিরের গান’-এ বাউল সাধনার বিভিন্ন দিক যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা আলোচনা করো।
উত্তর: ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ লালন ফকিরের অন্যতম প্রতিনিধিস্থানীয় গান। স্বাভাবিকভাবেই বাউল সাধনার অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং অনুষঙ্গ এই গানে পাওয়া যায়।
প্রথমত, বাউল সাধকরা সর্বমানবতার ওপরে গুরুত্ব দেয়। এখানেও লালন ফকির বলেছেন, “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”।
দ্বিতীয়ত, বাউল দর্শনে আত্মতত্ত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে থাকে। এই কবিতাতেও মনের ভিতরে ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধান একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আছে,-“এই মানুষে মানুষ গাথা/দেখনা যেমন আলেক লতা”।
তৃতীয়ত, বাউল সাধনার অনেক পরিভাষা ও অনুষঙ্গ এই কবিতাতে পাওয়া যায়। যেমন-‘দ্বি-দলের মৃণাল’, ‘আলেক লতা’ ইত্যাদি। এইভাবে সাধনতত্ত্বের নিরিখে এবং জীবনবোধে ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ বাউল সাধনার এক উজ্জ্বল উদ্ধার।
‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’-এ বাউল সাধনার মানবতত্ত্বের যে প্রকাশ ঘটেছে, তা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তর: বাউল সাধনায় মনে করা হয়, মানবদেহ সব তত্ত্ব ও সত্যের ভিত্তি। লালন তাঁর অন্য গানে লিখেছেন-
"সহজমানুষ ভজে দেখ নারে মন দিব্যজ্ঞানে পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে।”
পঠিত গানেও লালন মানুষ ভজনার কথা বলেছেন। এই মানুষ সহজ-মানুষ। এই সহজ-মানুষের সমাধান না পেলে ‘মূল’ হারাতে হয়। সমগ্র গানে বারে বারে এসেছে এই ‘সোনার মানুষ’-এর কথা। ‘মানুষ-গুরু’র কৃপাতেই তার সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে বলে লালন মনে করেছেন। লালনের মতে সেই সোনার মানুষ ছাড়া মানব জীবন অসম্পূর্ণ। এভাবেই পঠিত গানে বাউল সাধনার মানবতত্ত্বের প্রকাশ ঘটেছে।
লালন শাহ্ কে ছিলেন? পাঠ্য লালন গীতিকা অবলম্বনে মূল বিষয়টি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: লালন ফকির ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন আধ্যাত্মিক সাধক। তিনি একাধারে সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক ও মানবতাবাদী। তিনি বাংলাদেশে বাউল গানের শ্রেষ্ঠতম রচয়িতা।
খাঁটি বা শুদ্ধ মানুষ হতে গেলে মানুষকেই ভজনা করতে হবে। মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধান পাওয়া যাবে না। দ্বি-দল প্রস্ফুটিত হয় আজ্ঞাচক্রে। আর সেই দ্বি-দলের পদ্মে ‘সোনার মানুষ’ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কেবল গুরুর কৃপা হলেই এই সত্য জানা সম্ভব। মানুষের মধ্যেই মানুষের গাথা বা কাহিনি রচিত হয়ে আছে আলেক লতার মতো। অর্থাৎ পার্থিব মানবশরীরের মধ্যেই বিরাজ করেন ‘সহজ মানুষ’, ঠিক যেমন লতা গাছের অলক্ষে বা দৃশ্যমানতার আড়ালে থাকে। এই সব কিছু জেনেও যে মুণ্ডিতমস্তক হয়, সে আসলে ‘জাত’-কে অবলম্বন করে মুক্তি খোঁজে। কিন্তু মানুষের সঙ্গসুখ ছাড়া মানুষের মন অর্থহীন এবং মহাশূন্য। তাই লালন বলেন যে, মানুষকে ভজনা করলেই একমাত্র ত্রাণ পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন – ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর