লালন শাহ ফকিরের গান কবিতার বিষয়বস্তু
লালন শাহ ফকিরের গান কবিতার বিষয়বস্তু
লালন শাহ ফকিরের গান’-পদটিতে বাউল লালন শাহ জানান যে মানুষকে ভজলে বা মানুষকে ভালোবাসলে, সেবা করলে সোনার মানুষ। অর্থাৎ প্রকৃত বা শ্রেষ্ঠ মানুষ হওয়া সম্ভব। বাউল লালন শাহ বিশ্বাস করেন, যিনি পরমাত্মা, তিনিই ঈশ্বর, তিনিই আল্লাহ, তিনিই মনের মানুষ-তিনি একই জন। তিনিই বিরাজ করেন মানুষের মধ্যে। মানুষকে ভালোবাসলে স্রষ্টাকে ভালোবাসা হয়, মানবসেবাই পরমাত্মার বা মনের মানুষের সেবা। নিজের ভিতরে মানুষ্যত্ব জাগিয়ে তুলে মানবসেবা বা মানবভজনা করলেই পরমাত্মা, ঈশ্বর, মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়। তাই মানুষকে বাদ দিয়ে নিজের মনুষ্যত্বকে ত্যাগ করে ঈশ্বরপ্রেমে মাতোয়ারা বা পাগল বা ক্ষ্যাপা মানুষ শত চেষ্টা করলেও প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। মানুষের প্রতি আমাদের যদি দয়া, মায়া ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ভক্তি না থাকে তাহলে আমরা মনুষ্যত্ব থেকে বিচ্যুত হব, প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারব না। মনুষ্যত্বহীন মানুষকেই বাউল লালন মূল হারাবি বলে উল্লেখ করেছেন।
‘দ্বি-দলের মৃণালে/সোনার মানুষ উজ্জ্বলে’-এটি বাউলদের একটি গুহ্যতত্ত্ব। মানবদেহের ভিতরে থাকা সুষুম্নানাড়ি পদ্মরূপে বিরাজমান। সেই নাড়ির দ্বি-দলে অবস্থান করেন সোনার মানুষ, পরমাত্মা বা মনের মানুষ। বাউলদের মতে, মানুষের দেহে রয়েছে সাতটি চক্র-১। মূলাধার চক্র ২। স্বাধিস্তান চক্র ৩। মণিপুরা চক্র ৪। অনাহত চক্র ৫। বিশুদ্ধ চক্র ৬। অজ্ঞান চক্র ৭। সহস্রার চক্র। এই দ্বি-দল বা অজ্ঞান চক্র মানুষের কপালে দুই ভ্রু-মাঝের স্থান মৃণালরূপ সুষুম্নানাড়ির সঙ্গে সবকটি চক্র যুক্ত। তাই, বাউল লালনের মতে প্রকৃত মানুষ হতে পারলে এই অজ্ঞান চক্র বা দ্বি-দলে মনের মানুষ বা ঈশ্বর অবস্থান করেন। আর এই পরমাত্মা বা মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া মনুষ্যত্ববোধ, মানবসেবা এবং গুরুর কৃপা বা আশীর্বাদ ছাড়া সম্ভব নয়।
পৃথিবীতে মানুষ মানুষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। বাউল লালন উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন, গাছে আলেকলতা বা স্বর্ণলতা থাকে। এই আলেকলতার নিজস্ব কোনো পাতা, ফুল, ফল, মূল কিছুই নেই। দেখে মনে হয় আলেকলতা যেন গাছেরই অংশ। আমরাও প্রত্যেক মানুষ আলেকলতার মতো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছি। আর পরমসত্তা, যাঁকে আমরা ঈশ্বর, আল্লাহ, God, ভগবান, মনের মানুষ-যাই বলি না কেন তিনি থাকেন মানুষেরই মধ্যে। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ এই পরমাত্মা বা মনের মানুষকে লাভ করার জন্য সর্বত্র খুঁজে বেড়াই এবং বিভিন্ন ধর্মীয় উপাচার যেমন সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে মাথা মুড়োনো ইত্যাদি করে থাকি। প্রকৃতপক্ষে মানুষ-ভজনার মধ্য দিয়েই পরমাত্মাকে জানা বা তার সান্নিধ্যলাভ করা যায়। আর তার ফলেই মানুষ এক মহিমান্বিত আধ্যাত্মিক স্তরে উত্তীর্ণ হয়। একে লালন জাতে ওঠা বলতে চেয়েছেন।
মানুষ ছাড়া পৃথিবীর সবকিছু শূন্যকার। বাউল লালন বলেন, মানুষ ভজলে প্রকৃত মানুষ হওয়া সম্ভব এবং পরমাত্মা বা মনের মানুষের সন্ধান পেয়ে এক আধ্যাত্মিক স্তরে উপনীত হয়ে অলীক চিত্তসুখ লাভ করা যায়। কেন-না মানুষের মধ্যেই অবস্থান করেন ঈশ্বর বা মনের মানুষ।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর